পা পা করে কালধর্মে দেশ এগিয়ে চলেছে কারণ কিছুই থেমে থাকে না৷ আজ অনেকেই আছেন যাঁরা সেই ১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭ সালের কথা স্মরণ করতে পারেন৷ আজকের মত সেদিন টি.ভি.র মত ব্যাপকভাবে প্রচার মাধ্যম ছিল না৷ সংবাদপত্রের সংখ্যাও ছিল গুটি কয়েক তবে সেদিন সরকারী বেতারযন্ত্র ছিল খুবই সচেতন৷ বেতারে যেভাবে সংবাদ পরিবেশিত হত, আজ কিন্তু তেমনভাবে কলকাতা বেতার কেন্দ্র ও দিল্লির বাংলা প্রচারকেন্দ্র থেকে তেমন গুরুগম্ভীর ভাষায় সংবাদ প্রচারিত হয় না৷ অনেক টিভিতে সংবাদ প্রচারিত হয় ঠিকই কিন্তু সংবাদের বিষয়বস্তু ও সংবাদ প্রচারের ধরণটি মনকে আকৃষ্ট করে না৷ সেদিনের সংবাদ প্রচারে যে দৃঢ় গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর শোনা যেত তেমনটি আজ আর নেই৷ নানাধরণের বিজ্ঞাপনের মাঝে সব সংবাদই যেন গৌণ হয়ে যায়৷
যাইহোক, দেশের প্রকৃত দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলি যেন অনেক সময় বিজ্ঞাপনের ভিড়ে হারিয়ে যায়৷
সাতদশক হলো আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি৷ সেই স্বাধীনতা কিন্তু রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের অকালে নিহত হওয়ার এক মর্র্মন্তিক পরিণতির বিষময় ফলস্বরূপ৷ এই স্বাধীনতা (?) পূর্বপাকিস্তানের ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে যে সমস্ত অহিন্দু হতভাগ্য মানুষ (শিশু নরনারী) বাস করতেন তাঁদের অনেককেই উদ্বাস্তু হতে হয়৷ যে অভিশাপ বহন করে চলেছেন উদ্বাস্তু হয়ে অধুনা বাংলাদেশের উৎখাত হওয়া হিন্দুরা যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন৷ তাঁদের আজও উদ্বাস্তু হওয়ার হাত থেকে মুক্ত হওয়ার কোন সুরাহা হয়নি৷ বরং জঘন্য দলীয় রাজনীতির নাগপাশে আবদ্ধ হতভাগ্যরা দিনযাপনের গ্লানি ভোগ করে চলেছেন পূর্বভারতে৷ ভারত স্বাধীনতা পেয়েছে অঙ্গহানি ঘটিয়ে! ভারতবর্ষের দুটি ডানা কিন্তু হতভাগ্য পক্ষীর ন্যায় বিচ্ছিন্ন হয়েছে৷ যে দুটি বর্তমানে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ৷ দুটি দেশেই কিন্তু অদ্যাবধি নির্র্যতন চলছে এক নাগাড়ে যাঁরা আজও সেখানে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন অবস্থার বিপাকে৷ বাংলাদেশের মাটি প্রায় হিন্দু শূণ্য হয়ে পড়েছে৷ তাদের জমিজমা ঘর বাড়ি ইচ্ছাকৃতভাবে আজও কেড়ে নিয়ে বিতাড়িত করা হচ্ছে যেটা প্রতিদিনের এক করুণ কাহিনী৷ যাঁরা পড়ে আছে তাঁরা মৃতকল্প হয়ে৷ যেখানে অমুসলমানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৯ শতাংশ সেখানে তাঁদের সংখ্যা দাড়িয়েছে বর্তমানে প্রায় ৫ শতাংশর মত, কোথাও কোথাও একেবারে শূণ্যতে দাঁড়িয়েছে৷ হিন্দু ও অমুসলমানদের জমি ফেরত দেওয়ার যে আইন বাংলাদেশে হয় সেটাকে নানা কূটকৌশলে সরকারী কর্মচারীগণ বানচাল করেই দিয়ে চলেছে৷
যে অখন্ড বাংলা ভারতের স্বাধীনতার জন্যে হোতা হিসাবে এগিয়ে আসে, সেই অখন্ড বাংলাকে ষড়যন্ত্র করে ইংরেজ সরকার নিজেদের কিছু স্তাবকদের হাতে দেয়৷ দেশকে দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে কাল্পনিক জনসংখ্যা গণনা করে র্যাডক্লিপের একটি লাল দাগের ভিত্তিতে৷ তাঁর ধারণায়ই ছিলনা কোথায় কতটা কোন সম্প্রদায়ের জনগণ বাস করেন৷
লর্ড মাউন্টব্যাটন ভারতে আসেন ১৯৪৬ সালে গভর্ণর জেনারেল হয়৷ তিনি লন্ডন থেকে র্যাডক্লিপকে নিয়ে আসেন দেশভাগের কাজে কিছু টাকার বিনিময়ে৷ কিন্তু দেশভাগের পর ভয়ংকর দাঁঙ্গা হয়৷ বহু মানুষ মারা যায়৷ তাতে তিনি ভয়ংকরভাবে মানসিক দিক থেকে আঘাত পান৷
ইতিবৃত্ত বলে যে ১৯০৬ সালের ১লা আগষ্ট আগাখাঁ লর্ডমিন্টোর সহিত সাক্ষাৎ করে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্র্বচন ব্যবস্থার দাবী করেন৷
এই ইনধনই ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ায়৷ মুসলীম লীগ ছিল কংগ্রেস বিরোধী একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান৷ ঢাকার নবাব সলিমউল্লাহ ইংরেজের দেওয়া অর্থে মুসলীম লীগ নামে এক সাম্প্রদায়িক দল তৈরী করেন৷ ১৯০৯ সালে মোগলে মিটো সংস্কার আইনে উল্লেখ্যযোগ্য বিধান হলো সাম্প্রদায়িক নির্র্বচনের ব্যবস্থার প্রবর্তন৷
নানাভাবে এই সাম্প্রদায়িকতা ভারতবর্ষের বুকে প্রবল থেকে প্রবলতর হয় কয়েকটি স্বার্র্থম্বেষী তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদের কায়েমী স্বার্থের কারণে৷ তাঁরা হলেন মুসলীমলীগের মহম্মদ আলী, জিন্না, সলিমউল্লাহ, কুখ্যাত সুরাবর্দী ও অন্যান্যরা৷ এদিকে কংগ্রেসের কিছু নরমপন্থী স্বার্র্থন্বেষী নেতা যাঁরা হলেন জহওরলাল নেহেরু, বল্লভভাই প্যাটেল আরো অনেকে যাঁরা ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা না করে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ করে নেন৷ ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা দেওয়ার কথা ছিল, সেটিকে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক নানা কারণে৷ এই সাম্প্রদায়িকতাই ইংরেজকে ভারতের বুকে দাদাগিরি করার সুযোগ দিয়ে আসছে৷ একথাটি খুবই সত্য যে ভারতবর্ষের মানুষ বুঝতেই পারেনি যে তারা স্বাধীন হবে৷ ১৫ ই আগষ্ট সকালে অনেকে দেখলো তার রান্নাঘর পাকিস্তানে পড়েছে৷ ১৯৪৬ সালে আগষ্টমাসে বাংলার মুসলীমলীগের কুখ্যাত শাসক ও মন্ত্রী মেদিনীপুরের মি:সুরাবর্দী অবিভক্ত বাংলায় কট্টর মুসলমানদের উষ্কানী দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগায় যেটা কলকাতা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নামে খ্যাত৷ তাতে নিরীহ অসংঘটিত অমুসলমানগণ নির্মমভাবে নিহত ও আহত হন সারা বাংলার মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় ৷ নোয়াখালি দাঙ্গা স্মরণীয়৷ র্যাডক্লিপের সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার পর ভারতবর্ষ হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান হয়৷ পূর্ণ বাংলার তিনচতুর্র্থংশ জোর করে পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত করা হয়৷ লক্ষ লক্ষ হিন্দু ও অমুসলমান উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়, তাদের সমস্যার সমাধান আজও হয়নি৷ কিন্তু পঞ্জাব ভাগ হবার পর প্রায় ৪৫ লক্ষ শিখ উদ্বাস্তুদের পূনর্বাসন দেওয়া হয় দিল্লি ও তার আশপাশে তৎকালীন পুনর্র্বসন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মি: খান্নার তত্ত্বাবধানে৷ এদিকে স্বাধীনতার দিন থেকে এক নাগাড়ে নির্র্যতন চলছে অধুনা বাংলাদেশে যা বর্তমানে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্ণিত৷ ওখানকার কট্টর গোঁড়া মুসলমানরা হিন্দু ও অন্যান্যদের সর্বস্বান্ত করে ছাড়ছে৷ তার কোন প্রতিকার নেই৷ ৭০ বছর পর যে ১৫ই আগষ্ট স্বাধীনতা এদেশে পালিত হল তাতে সরকারী তরফে অনেক হই হুল্লোর হল, লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ হলো কিন্তু হত দরিদ্র দুর্দ্দশাগ্রস্ত মানুষের মনে কতটুকু দাগ কেটেছে তার সন্ধান কে জানে! পশ্চিমবঙ্গের নদনদীগুলির বাঁধ ভেঙ্গেছে, নিচু জমির ফসল জলের নিচে গেছে, মানুষ মারা পড়েছে, বাড়িঘর সবই ধবংস হয়েছে৷ কেন্দ্র সরকার কিছু সাহায্য পাঠিয়েছে অসমে বিহারে কিন্তু হতভাগ্য পশ্চিমবাঙলায় তো অদ্যাবধি কোন সাহায্য আসেনি, আসার কোন সংবাদ নেই৷ প্রায় প্রতিবছর মানুষ বানভাসি হয়ে অত্যন্ত কষ্টভোগ করছে ও মারা পড়ছে৷ নদনদীগুলির কোন সংস্কার নেই৷ কি কেন্দ্র ও কি রাজ্যগুলি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় শাসকগণ শুধু সব ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন৷ বিজেপির নতুন সরকার ঘোষণা করেছেন আগামী ২০২২ সালের মধ্যে ‘নূতন’ ভারত গড়ার, স্বচ্ছ ভারত, দরিদ্রমুক্ত ভারত, সাম্প্রদায়িকতা মুক্তভারত, আরো কত কি৷ তিন বছরে কেন্দ্র সরকার কতটুকু দেশের উন্নতি করেছেন তার সমীক্ষা কি হয়েছে? অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয় দেশভাগ করে যে স্বাধীনতা এসেছে তার ফলে অখন্ড বাঙলা ও পঞ্জাবের চরম ক্ষতি হয়েছে৷ অন্যান্য এলাকার মানুষ হয়তো স্বচ্ছন্দে আছেন৷ আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি , চরম বেকার সমস্যা, আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি, হাসপাতালগুলিতে চরম অব্যবস্থা সরকারের চরম ব্যর্থতাই প্রমাণ করে৷ তাই প্রয়োজন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা৷ মেকী রাজনৈতিক স্বাধীনতা তো গরিবকে আরো গরিব করছে আর ধণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ধনী আরো ধনী হয়েছে৷ সত্যকথা বলতে কি এদেশের কি রাজ্য ও আর কি কেন্দ্র শুধু ধোঁকা দিচ্ছে ঝুড়ি ঝুড়ি প্রতিশ্রুতি দিয়ে৷ জনগণ আশা করেন জনগণের জন্য শাসকগণ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় কিছু সুরাহা করুক৷ দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে ‘স্বাধীনতা দিবস’-এর মহিমা গরিব সাধারণের কাছে দিনের পর দিন যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে৷
এবারে তো পাড়ায় পাড়ায় তেমন পতাকা উত্তোলন হল না৷ পাড়ায় মিছিল বেরুলো না৷ রাজনৈতিক দলগুলি ১৫ই আগষ্টের কথা ভুলে গেছে৷
রাজনৈতিক দলগুলির নোংরা দলবাজির কারণে জনগণ এদেশ যে স্বাধীন সেটা যেন ভুলে যেতে বসেছেন৷ দলবাজিতে মত্ত দলগুলির ক্যাডার, নেতা নেত্রীগণ নাগরিকদের নাগরিক জ্ঞানই করেন না৷ আর কেন্দ্র থেকে রাজ্যের শাসকগণ গণতন্ত্রকে একেবারে বিরোধী শূন্য করতেই আদাজল খেয়ে লেগেছেন৷ এটাই ভারতের মতো দেশের মারাত্মক দুরারোগ্য ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তাই দেশের স্বার্থে তরুণ তরুণীদের ও চিন্তাশীল নাগরিকদের প্রকৃত রাজনৈতিক সচেতন হয়ে নেতা ও নেত্রী সকলকে মনে করিয়ে দিতে হবে দলের চেয়ে দেশ ও দেশের জনগণ অধিক গুরুত্বপূর্ণ৷
- Log in to post comments