ভয়ের রাষ্ট্র ভারত ঃ একটি অন্তর্তদন্ত 

লেখক
মিহির কুমার দত্ত

পূর্ব প্রকাশিতের পর

সাম্রাজ্যবাদ ও আন্তর্জাতিক পুঁজি যখনই কোন দেশে বাজার ও নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কা করে, তখনই তারা বুর্জোয়া উদারনীতির মুখোশটা খুলে ফেলে, আর বেরিয়ে পড়ে তাদের হিংস্র নখ ও দাঁত৷

এই নগ্ণ রূপকেই ফ্যাসিবাদ বলে অভিহিত করা হয়৷ কখনও সে ধর্মমত উন্মাদনার বেশ ধরে, কখনো জাতি বিদ্বেষের৷ আমাদের দেশে আজ যেমন বিজেপি ও আর .এস.এসের পরিকল্পিত উগ্র হিন্দুত্ববাদী গৈরিক ফ্যাসিবাদ৷ কিন্তু পন্ডিতদের মধ্যে ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক জারি রয়েছে৷ কেউ কেউ এটাকে ব্যবস্থা (system) হিসাবে গণ্য করেন৷ যেমন সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজবাদ ইত্যাদির মতো ফ্যাসিবাদ৷ একটি ব্যবস্থাতে তার অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও দর্শন ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে কাঠামো ও উপরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়৷ কিন্তু ফ্যাসিবাদ এরকম কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা নয়৷ তার নিজস্ব কোন অর্থনীতি , রাজনীতি ও দর্শন নেই৷ তা পুঁজিবাদী- সাম্রাজবাদী বিশ্ব ব্যবস্থারই অধীনে একটি নগ্ণ রূপ মাত্র৷ দমন-পীড়নের একটি সুনির্দিষ্ট তীব্রতম স্তর৷

ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ সাম্রাজ্যবাদী- পুঁজিবাদী মুনাফা ও রাষ্ট্রকাঠামোরই পাহারাদারী করে৷ অস্তিত্বের সংকট দেখা দিলেই সাম্রাজ্যবাদ তার জামার আস্তিন থেকে  এই লুকানো  অস্ত্রটি বের করে যেমন দুনিয়ার প্রথম তথাকথিত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকে ধবংস করার জন্য ইউরোপ ও আমেরিকার সামাজ্যবাদী শক্তিগুলি সম্মিলিতভাবে ও এককভাবে নাৎসি বাহিনীর আবির্ভাবে সাহায্য করেছিল৷ সেখানকার ধন কুবেররা টাকা পয়সা ধনসম্পদ , আধুনিক অস্ত্র, যুদ্ধ বিমান, সামরিক প্রশিক্ষণ সব কিছু দিয়েই হিটলারের ন্যাৎসি বাহিনীকে গড়ে উঠতে মদত দিয়েছিল৷ উদ্দেশ্যে ছিল তথাকথিত রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ও সেই সাথে নিজ নিজ দেশের শ্রমিকশ্রেণীকে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার অনুসরণ করতে বাধা সৃষ্টি করা ও সমঝে দেওয়া৷ কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে, রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘকে কখনই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না৷ শেষ পর্যন্ত সে লাল রক্ত বা নীল রক্তের তফাৎ করতে পারে না৷ সব রক্তই পান করার জন্য শেষে লোলুপ হয়ে ওঠে তাই শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করে হিটলার ক্ষান্ত থাকে নি, গোটা বিশ্বটাকেই গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল৷

গণতন্ত্র রক্ষায় গণদেবতা

তথাকথিত গণতান্ত্রিক ভারতে ‘‘শান্তিপূর্ণ’’ এলাকা আর ‘‘উপদ্রুত’’ এলাকাতে দুই ধরণের ‘‘গণতন্ত্র’’ই দেখতে পাওয়া যায় ৷ কলকাতা , দিল্লী , মুম্বাই, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোরে একধরণের গণতন্ত্র আবার কশ্মীর, উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মণিপুর, নাগাল্যাণ্ড, অরুণাচল প্রদেশ , মিজোরাম, অসম, ওড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়ের ‘‘উপদ্রুত’’ অঞ্চলে আরেকধরণের ‘‘গণতন্ত্র’’ ! একটা খোলস আঁটা মুখোশে ঢাকা, আরেকটা নগ্ণ৷ একই অঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ! একই ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রে কোথাও কোথাও চলে সিভিল আইন, আবার কোথাও সামরিক আইন বা আইন কানুনের বেমালুম অবলুপ্তি৷

বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও সেই একই কথা প্রযোজ্য৷ যেখানে যেদেশেই জনগণ ও জাতিগুলি সাম্রাজ্যবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদের জোয়াল থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে, সেখানেই বুর্জোয়া উদারনীতিবাদ অদৃশ্য হয়ে যায়৷ যাবতীয় নখ, দাঁত ব্যবহার করে সে তখন ফ্যাসিবাদের রূপ নেয় ভালোভাবে নজর করলে বোঝা যাবে--- বার্মা , ফিলিপাইনস্ , মালয়, ইন্দোনেশিয়া, পেরু, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনার মতো দেশগুলির দিকে ও সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া, উগাণ্ডাসহ সাহারান দেশগুলির দিকে৷ এসব দেশগুলিতে বিপ্লব বিদ্রোহ আটকাতে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে নৃশংস দাঁত ও নখ বের করে  সাম্রাবাদীরা পুতুল সরকার বানানোয় মত্ত৷ বার্মাতে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে মুসলীমদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের ৷ মুসলিম দেশগুলিতে সিয়ার বিরুদ্ধে সুন্নীদের ৷ আরব ইজরায়েলে ইহুদি বনাম মুসলীম৷ ভারতে ও বাঙলাদেশে হিন্দু বনাম্ মুসলিম ৷ অথচ সুইডেন, সুইজারল্যাণ্ড, হল্যাণ্ড  , ফ্রান্স, জার্র্মনী, ইটালি ও জাপানে বুর্জোয়া উদারনীতিবাদ স্ব-মহিমায় বিরাজ করছে কারণ ছোটো খাটো বিরোধিতা থাকলেও এসব দেশে সাম্রাজবাদী শোষণ লুন্ঠনের বিরুদ্ধে কেউ বিদ্রোহ করেনি, তাই ওঁ শান্তি৷ ইরাক ও আফগানিস্তানের জনতা যখনই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে তখনই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জন্ম দিয়েছে তালিবান, আই.এস.আই ও আলকায়দার মতো শক্তিগুলির৷ ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ার সভ্যতাকে যে দৈত্য কুলের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল, আজ সেই দৈত্যকুলকে আর বোতলবন্দী করা যাচ্ছে না৷

বর্তমান সময়ে ভারতের রাজননৈতিক আকাশে এক ঘন কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে৷ এখন সর্বত্র ধর্মমত ও রাজনীতিকে মিলিয়ে মিশিয়ে চলার লক্ষ্যে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার পথ চলতে চাইছে৷ বিজেপির নেতৃত্বে প্রথম এন.ডি.এ সরকার ১৯৯৮ সালে গড়ে ওঠার পর থেকেই ধর্ম ও রাজনীতির এক বিশেষ ধরণের ককটেল শুরু হয়েছে৷ বর্তমান সময়ে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ অতীতের সময় থেকে অনেকগুণ বেড়েছে৷ তাই, সাম্প্রদায়িকতার বিষময় ফলের কথা বিশ্লেষণ করতে হবে ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী তথা বিজেপির মতো রাজনৈতিক দলের সমস্ত কার্যকলাপ এর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামকে জোরদার করার জন্য পারিশ্রমী কাজ হলেও জনগণের দৃঢ় ঐক্যের ভীত মজবুত করতে হবে৷

একটা দেশ তৈরী হয় ধর্ম-বর্ণ-দল-বল-ধনী ও গরিব সকলকে নিয়েই৷ এখানে দলগত, মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও ধর্মীয় বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না৷ রাষ্ট্রীয় কাজে ও সুযোগ সুবিধায় সকলের অংশগ্রহণের অধিকার থাকবে৷ অন্যথা হলে জাতীয় চেতনা ঘটনে সমস্যা দেখা দিতে পারে৷

দেশপ্রেম মানুষের জন্মগত প্রবণতা৷ প্রতিটি মানুষই দেশকে ভালোবাসে৷ ভাবাদর্শগতভাবে যে কেউ যে কোনও দল করতে পারে৷ কেউ ভিন্নমতাবলম্বী হলে অথবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলেই তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া যায় না৷ তাহলে আর গণতন্ত্র থাকে না৷ গণতন্ত্রের মূল কথাই বহুদলীয় ও বহু মতাদর্শে ও বহু মানুষের বিভিন্ন চিন্তার এক স্বয়ংসম্পূর্ণ সুব্যবস্থা৷ এ ব্যবস্থাকে অস্বীকার করার মানেই গণতন্ত্রকে অস্বীকার করা৷ এর মানে হলো দেশের ঐক্যে  আঘাত করে ভবিষ্যৎ anti-liberation মনোভাবকে উস্কে দেওয়া৷

ভারতের জনগণ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে যুদ্ধ করেছে সকল প্রকার শোষণ , বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত একটি গণতান্ত্রিক স্বদেশ ভূমির জন্য৷ স্বাধীন দেশের মানুষে মানুষে নোতুন করে বৈষম্য সৃষ্টি বা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য নয়৷ বর্তমান শাসক গোষ্ঠী স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনার জায়গায় আঘাত করে দেশপ্রেমের মৌলিক চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী গণবিরোধী ফ্যাসিবাদী চরিত্র অর্জন করে ছাত্রসমাজ, যুব সমাজ, কৃষক সমাজ তথা সকল সমাজের যৌক্তিক ও ন্যায্য দাবী উপেক্ষা করে বিভিন্নভাবে জাতিকে বিভক্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে৷ আজ সবাইকে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে৷

আমরা কখনই এটা ভুলে যেতে পারিনা যে আমাদের দেশ ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান-খ্রীষ্টান-বৌদ্ধ-জৈন-শিখ প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মমতের মানুষ বাস করেন৷ বিভিন্ন ধর্মমতে বশ্বাসী মানুষের মধ্যে অগ্রসর ও অনগ্রসর বা পশ্চাদপদ অংশের মানুষও রয়েছে৷ তাই ধর্মমত নিরপেক্ষতার আদর্শই পারে সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও সংহতির এক সুদৃঢ় মেল বন্ধন তৈরী করতে সেই কারণেই সম্প্রদায়িকতা বিরোধী শ্রমিক, কৃষক ও সকল মেহনতকারী মানুষের ঐক্য গড়ে তোলার কাজে আমাদের সকলের একটা ভূমিকা নিতে হবে৷ সেই কাজে আমাদের সকলকেই নিরলস প্রচেষ্টায় যুক্ত থেকে গণআন্দোলণের ভিত্তিকে শক্ত ও তাকে প্রসারিত করতে হবে৷ এর মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, অগণতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদপন্থী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে মতাদর্শ গত সংগ্রাম গড়ে তোলা যাবে ও এটাই এই মুহূর্তের জরুরী কাজ৷

এ আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে যে অগ্রণী ভূমিকা নেবে, তাকে সবার আগে বুঝে নিতে হবে যে এই সময়ে সবচেয়ে বড় বিপদ উপস্থিত হয়েছে গণতন্ত্র ও দেশের সাম্প্রদায়িক ঐক্য সংহতি ও সম্প্রীতি রক্ষার প্রশ্ণে৷

 আজ লড়াই করতে হবে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য ৷

আজ লড়াই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার৷

আজকের লড়াই ধর্মমতের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভাজনের নীতির বিরোধিতায় আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার৷

 আজ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও অগণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিভাজন করে, সমর্থণের বিষয় নির্ণয় করার লড়াই৷

আজ দরিদ্র জনসাধারণের ন্যায্য দাবীতে আন্দোলন, কর্ষক সমাজের জন্য ফসলের ন্যায্য মূল্য আদায়ের লড়াই৷

আজ সমস্ত রকম শোষণের মূলকে, সমূলে উৎপাটিত করার লড়াই৷

আজ সমস্ত রকমের হামলার হাত থেকে মানবাধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সরব হওয়ার লড়াই ৷

আজ সমস্ত রকম পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার লড়াই কারণ পুঁুজিবাদী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যই এরকম, স্বার্থ আর মুনাফা ছাড়া মানুষ আর কোন কিছুকেই গুরুত্ব দেয় না৷ যেখানে প্রাপ্তি যোগের সম্ভাবনা নেই, তার প্রতি মানুষ কোন আগ্রহবোধ করে না৷ কথায় আছে পুঁজিবাদী সমাজের কুকুর বিড়ালও নাকি স্বার্থপর হয়ে যায়৷ সেখানে মানুষতো কোন ছার৷ সেই মানুষকেই নোতুন দিশা দেখানো, নোতুনভাব ও আদর্শের সঙ্গে পরিচয় ঘটানো ও এক নোতুন সমাজ দর্শণের সঙ্গে তার পরিচয়ের মাধ্যমে তাঁকে নবজন্ম প্রদান করার লড়াই৷