ছাত্র সমাজ বর্তমানে কোন্ পথে পরিচালিত! 

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

Student agitationবেশ কিছু দিন যাবৎ  গণমাধ্যমগুলিতে  কলকাতা মহানগরী  ও রাজ্যের বিভিন্ন কলেজগুলিতে  ছাত্রভর্তির বিষয়ে যে সংবাদ সমূহ পরিবেশিত হয়ে চলেছে তার অভিঘাতে জনসাধারণ, বিশেষতঃ ছাত্র-ছাত্রাদের অভিভাবকগণ আতঙ্কিত ও সন্ত্রস্ত৷ প্রথমতঃ উচ্চমাধ্যমিক ও তার সমতুল পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর কলেজগুলিতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ভর্ত্তির ফর্ম তোলা ও সেই ফর্মগুলি পূরণ করে যথাস্থানে জমা দেওয়া৷  এরপর মেধা ভিত্তিক বিভিন্ন বিষয়ের অনার্স ও পাসকোর্সে ভর্ত্তির জন্য মেধাতালিকা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কলেজে নিজ নিজ কাগজ পত্র দেখিয়ে  ভর্ত্তির পালা ৷ আসল সমস্যাটা শুরু হয় এই পর্যায়ে ৷  ভর্ত্তির জন্যে আসা ছাত্র-ছাত্রারা কলেজের অফিসঘর বা গেটে পৌঁছানোর আগেই  সেই কলেজের কোনো সিনিয়র ছাত্র  বা প্রাক্তন ছাত্র বা কোনো কলেজ কর্মী অথবা বহিরাগতদের দ্বারা পাকড়াও হয় ও  বিভিন্ন কায়দার মারপ্যাঁচে  ঠিক জায়গা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না৷  এরপর শুরু হয় টাকার খেলা৷ ভর্ত্তি করানোর বিনিময়ে  বিষয় অনুযায়ী  টাকার অঙ্ক নিরূপিত হয় আর তা পাঁচ-দশ হাজার থেকে  ষাট-সত্তর হাজার বা তারও বেশী হতে পারে৷ এভাবেই চলছে ভর্ত্তির তোলাবাজির কারবার৷ ছেলেমেয়েদের ভর্ত্তির জন্যে অভিভাবক অভিভাবিকারা দাবী অনুযায়ী টাকা দিতে বাধ্যও হচ্ছেন৷  বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পেরে  রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বার বার  এই বিষয়ে অভিযুক্ত ভর্ত্তি তোলাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর বার্র্ত্ত শুণিয়েছেন৷  কিন্তু নগদ টাকার স্বাদ পেয়ে  তারা এখন বেপরোয়া৷  ফলে তোলাবাজিতে লাগাম পরানো যায় নি৷ ফন্দিফিকিরের রকম ফের করে তারা নিজেদের পথেই চলেছে৷ শেষপর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে যথাযথ পদক্ষেপ করতে নির্দেশ দিয়েছেন ও কলেজগুলির কর্ত্তৃপক্ষকে এই বিষয়ে আরও  সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন ৷ সর্বশেষ, ছাত্র-ছাত্রাদের যাতে কলেজে এসে কাগজপত্র বা টাকা জমা না দিতে হয় তারজন্যে শিক্ষামন্ত্রী কলেজ গুলিকে ওয়েবসাইটে  মেধাতালিকা প্রকাশ করতে ও সেই তালিকা অনুযায়ী ছাত্র-ছাত্রারা যাতে  নির্দিষ্ট ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিতে পারে  তার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়েছেন৷  বাকি কাগজপত্র ক্লাস শুরুর সময় পরীক্ষা করা হবে৷  তথাপি বহু জায়গায় ভর্ত্তি তোলাবাজি ও এই তোলাবাজিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ বোমাবাজি ইত্যাদির সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে৷ এত নিষেধ, নির্দেশ, হুঁশিয়ারি সত্বেও কলেজে কলেজে গোলমাল চলছে কোথাও ভর্তি তোলাবাজি কোথাও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে৷  ইতোমধ্যে কয়েকজন তোলাবাজকে গ্রেফতারও করা হয়েছে৷

 গত ১৩ই জুলাই  উত্তরবঙ্গের কোচবিহার ও  দক্ষিণবঙ্গের জয়নগরের ধ্রুবচাঁদ কলেজে  গুলি-বোমার ব্যবহারের সংবাদ প্রকাশ্যে এসেছে৷  ধ্রুবচাঁদ কলেজে কোনো ছাত্রসংসদ না থাকায় সেই কলেজে টি.এম.সি.পি দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত৷ একদল সেখানকার  স্থানীয় বিধায়ক  বিশ্বনাথ দাসের নিয়ন্ত্রণাধীন আর অন্য দলের রাশ  তৃণমূল নেতা গৌর সরকারের হাতে৷ এমতাবস্থায় ঐ কলেজে ভর্তি সংক্রান্ত ও অন্যান্য কাজকর্ম  কাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এ বিষয়ে দুপক্ষের বিবাদ রয়েছে৷  এই দুই নেতার শক্তি প্রদর্শনের জেরেই  কলেজে মারামারি ও বোমাবাজি হয়৷  কোচবিহারেও  টি.এম.সি.পি-র দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের কারণে  ঐ কলেজেরই   টি.এম.সি.পি ইয়ূনিটের আহ্বায়ক মাজিদ আনসারীকে গুলি করা হয়৷ শুধু এই দুই কলেজেই নয়, সাম্প্রতিক কালে বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই  নিজেদের গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার জন্যে  দুই বা ততোধিক স্থানীয় নেতার  দখলদারীর লড়াই চলেছে পুরোদমে৷

প্রকৃত পক্ষে এই ধরণের অশান্তি ও গন্ডগোলের মূলে রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের দলীয় বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ সংঘাত৷ আবার প্রত্যেক স্থানীয় নেতা-নেত্রী কোনো না কোনো কেন্দ্রীয় উচ্চ নেতৃত্বের  অনুগামী বা গোষ্ঠীভুক্ত৷   একসময়ে রাজনীতির লড়াই ছিল আদর্শের লড়াই , নীতির লড়াই৷  এখন রাজনীতি থেকে নীতি-আদর্শের বিসর্জন ঘটিয়ে সগৌরবে বিরাজমান স্বার্থের সংকীর্ণতা ও ক্ষমতালিপ্সা৷ নেতা-নেত্রী যদি শাসক দলের হন তবে তো কথাই নেই৷  ক্ষমতার মধু সংগ্রহ করার লক্ষ্যে  যেকোনো অনৈতিক পথ অবলম্বন করতে তাঁরা পিছপা হননা৷ এর জন্যে বেশীরভাগ সময়েই প্রয়োজন হয়  পেশী শক্তি ৷ আর পেশী শক্তির উৎস  কখনো অসামাজিক  দুষৃকতী আবার কখনো যুবশক্তি বা ছাত্র সমাজ৷ অল্প বয়সী ছাত্র-ছাত্রাদের সামনে রয়েছে বিরাট সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ জীবন ৷ কিন্তু বর্তমান বৈশ্যতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা ও সামাজিক অব্যবস্থার ফলশ্রুতি রূপে প্রাপ্ত  যুব সমাজের বেকারিত্ব ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সুযোগ নিয়ে  রাজনীতির কারবারীরা  ঐ ছাত্র-ছাত্রাদেরকে  দাবার বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করে৷  কিছু অর্থ, মোবাইল, বাইক , বিভিন্ন রকমের সস্তা প্রলোভন ও সামান্য রাজনৈতিক দাদাগিরির ক্ষমতার লোভে ছাত্রসমাজও প্রলুদ্ধ হয়৷ বিভিন্ন কলেজ , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রসংসদ নিজেদের কব্জায় রাখার উদ্দেশ্যে  রাজনীতিকরা  ওইসব ছাত্রদের ব্যবহার করে৷ ফলে ছাত্র সংসদের নির্র্বচনগুলিতেও দাঙ্গা হাঙ্গামা, রক্তারক্তি, গুলি বোমার লড়াই একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে৷  এই সবেরই নবতম সংযোজন বেলাগাম ভর্তি-তোলাবাজি৷ প্রাপ্ত অর্থের কিয়দংশ  থাকে তোলাবাজদের হাতে,  বাকিটা যায় নেতার কাছে ও ঘুরপথে দলের তহবিলে৷  শাসক বিরোধী সবদলেরই একই কায়দা--- যে যেখানে সুযোগ পায় সেখানে কাজে লাগায়৷ ভর্তি তোলাবাজিতে শুধুমাত্র ছাত্ররাই নয়, শিক্ষাকর্মী ও অন্যান্য কর্মীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণ অবশ্যই থাকে--- নইলে এতবড় একটা কর্ম কাণ্ড  সম্ভব নয়৷ হয়তো কলেজ কর্ত্তৃপক্ষও দেখে না দেখার ভান করেন৷ কারণ  কলেজ চালাতে গেলে ও নিজেদের গদি টিকিয়ে রাখতে গেলে ছাত্রসংসদের নেতা-নেত্রী ও দলীয় নেতা-নেত্রীদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন হয়৷ সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ এলে তারা নড়ে চড়ে বসেন ও ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন৷ গোটা ব্যাপারটা এইভাবেই চলছে৷

প্রকৃতপক্ষে ছাত্রসমাজের এই অধঃপতনের মূল কারণ সার্বিক সামাজিক অবক্ষয় ও মানবিকতার অবমূল্যায়ন৷ বর্তমান ধনতান্ত্রিক প্রভাবপুষ্ট  সমাজ ব্যবস্থায় নৈতিকতার মান  ক্রমশঃ অধোগামী৷ স্বার্থসিদ্ধির জন্যে মানুষ আজ যেকোনো অনৈতিক-বেআইনী কাজকর্মে লিপ্ত হতে কুণ্ঠিত হয় না৷ বৃহত্তর সমাজের  চরম ক্ষতির বিনিময়েও এক শ্রেণীর লোভী মানুষেরা  হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা চালিয়ে যায়৷ ক্ষমতার উচ্চাকাঙ্খা  ও  অমিত সম্পদ কুক্ষিগত করার তীব্র বাসনা  তাকে আরও বেশী আগ্রাসী করে তোলে৷ একই কারণে বর্তমান কালের রাজনীতিকরা ব্যষ্টিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ বা দলীয় স্বার্থের জন্যে সাধারণ মানুষের সর্বনাশে অগ্রণী  ভূমিকা নেয়৷ তাঁদেরই প্ররোচনায় যুবসমাজ ও ছাত্রসমাজ  আদর্শহীন, নৈতিকতা বর্জিত,  অসত্য ও অধর্মের ঘূর্র্ণবর্তে নিমজ্জিত হয়ে দিশাহীন অবস্থায় পতিত৷ জনসেবার নামে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সম্পদ প্রাপ্তির প্রয়াসে রাজনীতিকরা সদাব্যস্ত৷ একটা সময় রাজনীতিতে আদর্শবান সৎ মানুষদের দেখা যেত৷ সর্ব সাধারণের জন্যে তাঁদের স্বার্থত্যাগ, সেবাপরায়ণতা ও মানব দরদী মনোভাব ছিল সকলের অনুকরণ যোগ্য ৷ কিন্তু বর্তমানের রাজনীতিকদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে যেন তেন প্রকারেণ নির্র্বচনী বৈতরণী পার হয়ে  শাসনক্ষমতা ও মসনদ লাভ৷ যার ফলে  সমাজে আজ এত হানাহানি, রেষারেষি, হিংসা ও অসহিষ্ণুতা , অনাচার ও অবিচার৷  সামাজিক এই পরিবেশের দ্বারা স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র সমাজ তথা যুব সমাজও প্রভাবিত৷

ছাত্রজীবন হল গড়ে ওঠার সময়৷ ছাত্র-ছাত্রার প্রকৃত চরিত্র নির্র্মণ এই সময়েই সম্ভব৷ তাই তাঁদের  সুন্দর, সুস্থ সাংস্কৃতিক  পরিবেশে শুভ মানবিক গুণাবলী, সুকোমল বৃত্তিগুলির উন্মেষ তথা অনুশীলনের সুযোগ প্রদান করা একান্ত প্রয়োজন৷ এই বিষয়ে পিতা মাতা, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সামাজিক পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম৷ শৈশবাবস্থা থেকেই  ছাত্র-ছাত্রাদের মধ্যে উচ্চ আদর্শের বীজ বপন করে সুশিক্ষার দ্বারা  তাদের নৈতিক চরিত্রের ভিত্তি মজবুত করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ৷ এই দৃঢ় নৈতিকতার শিক্ষা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাকে ভবিষ্যতে সুনাগরিক ও সত্যিকারের মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে৷ আধ্যাত্মিক আদর্শের ভিত্তি সুদৃঢ় না হলে নৈতিক ও চারিত্রিক বলিষ্ঠতা সম্ভব নয়৷ বৃহতের ভাবনা , উন্নত আদর্শের শিক্ষা ও  আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন মানুষকে সত্য-ধর্ম-ন্যায়- নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত করে৷ আর এই মানুষেরাই সমগ্র সমাজকে এক ও অবিভাজ্য মানব সমাজ হিসাবে দেখে--- কোনো জাত-পাত, ধর্ম-সম্প্রদায়গত খণ্ডিত ভেদ ভাবনার দ্বারা তারা প্রভাবিত হয় না৷

এই মহান উদ্দেশ্য সাধনে আনন্দমার্গ আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন করেছে৷ যার মূল সূত্রটি হল---‘‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে’’৷ সর্বাত্মক মুক্তিই এই শিক্ষাপদ্ধতির একমাত্র উদ্দেশ্য৷ শৈশব থেকেই আধ্যাত্মিকতার আদর্শে ও সুস্থ সাংস্কৃতিক  পরিবেশে প্রকৃত মানুষ গড়ে তোলার ব্রত নিয়ে পৃথিবীর ১৮২ টি দেশে আনন্দমার্গ পরিচালিত বিদ্যালয়গুলি নিরলস কর্মসাধনায় নিয়োজিত৷ জীবপ্রেম, ভালবাসা, মায়া-মমতা প্রভৃতি সুবৃত্তির প্রসার  ও অনুশীলনের মাধ্যমে নব্যমানবতার আদর্শে জীব, জড়,উদ্ভিদ, মানুষ  সকলের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও সকলের সার্বিক উন্নতি সাধনে সদা সচেষ্ট থাকার শিক্ষাই ছাত্র-ছাত্রাদের প্রদান করা হয় এই সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে৷ এই শিশুরাই সত্য,ধর্ম, নৈতিকতা, ন্যায় নিষ্ঠা প্রভৃতি শুভগুণাবলীকে নিজেদের মজ্জাগত করে নেওয়ার ফলে  ভবিষ্যতে  শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সুনাগরিক হয়ে উঠবে ও দেশ তথা সমাজের সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে৷ মানুষের সমাজে দেশে দেশে  এই সুন্দর মানুষগুলির সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাবে ততই সমগ্র মানব সমাজ শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত ও সকল জীবের বাসযোগ্য হয়ে উঠবে৷ তাই ছাত্র সমাজকে কুচক্রী দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে অন্ধকুপের দিকে পরিচালিত না করে  সত্যিকারের আলোকোজ্জ্বল সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করার লক্ষ্যে  প্রতিটি পিতা মাতা, অভিভাবক অভিভাবিকা, শিক্ষক শিক্ষিকাকে এগিয়ে আসতে হবে ও আনন্দমার্গের যুগান্তকারী  শিক্ষা পদ্ধতিকে সমাজে  আরও প্রসারিত করে সমগ্র সমাজকে কলুষমুক্ত করার অঙ্গীকার বদ্ধ হয়ে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত ও আনন্দময় করে তুলতেই হবে৷ এছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও পন্থা নেই৷