দার্জিলিং সমস্যার সত্যিকারের সমাধান

লেখক
আচার্য সর্বাত্মানন্দ অবধূত

গত ১৯-২০ আগস্ট দার্জিলিং-এ নানাস্থানে  ভয়াবহ ধারাবাহিক বিস্ফোরণের পরে পরেই রাজ্য সরকার বিমল গুরুং ও  তার তিন সহযোগীর বিরুদ্ধে ইউ-এ-পি-এ এ্যাক্টের  ধারা  (রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ইত্যাদি ) রুজু করতে বাধ্য হয়৷ এতে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে,বিমলগুরুং নিজে ও তার আন্দোলন শুধু অবৈধ নয়, তা সন্ত্রাসবাদী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন৷ সম্প্রতি সঞ্জয় থুলুং নামে মোর্চার একজন বিশেষজ্ঞ উগ্রপন্থীর কথা জানা গেছে যে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ সহ আগেকার সব সন্ত্রাসবাদী ঘটনার হোতা ও বিমল গুরুং-এর আজ্ঞাবহ৷ এরকম অনেক সঞ্জয় থুলুং দার্জিলিং বা তার আশেপাশে ছড়িয়ে  ছিটিয়ে আত্মগোপন করে আছে৷ সরকার যথারীতি থুলুং বা অন্যান্যদের কেশ্রাগ্র স্পর্শ করা তো দূরের কথা, সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে ইউ-এ-পি-এ এ্যাক্ট ও রুজু করতে পারেনি৷

এদিকে, যেমন সব অনুমান করা হচ্ছিল, দার্জিলিংয়ের সবদলের নেতাদের রাজ্য সরকারের সঙ্গে বহু প্রতিক্ষিত আলোচনা সম্প্রতি নবান্নে অনুষ্ঠিত হ’ল৷  কিন্তু সেই বৈঠকে  গোর্র্খল্যান্ডের দাবী প্রসঙ্গে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর  উক্তি (পত্রিকায় যেমন প্রকাশিত)--- ‘এ আমাদের এখতিয়ারে নেই --- অনেকের মনেই বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে৷ পাহাড়ে একেবারে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি হচ্ছে ৩১ শে আগষ্ট থেকে ১২ দিনের জন্যে অর্র্থৎ আগামী ২২শে সেপ্ঢেম্বর পর্যন্ত বন্ধ প্রত্যাহার করা হয়েছে৷ ওই দিনেই কার্শিয়াং-এর সভায় গোর্র্খদের বর্তমান নেতা বিনয় তামাং স্পষ্ট বলেছেন যে গোর্র্খল্যান্ডের দাবী যে সংবিধাান সম্মত তা রাজ্য সরকার ও মুখ্যমন্ত্রী স্বীকার করেছেন৷ যে  মুখ্যমন্ত্রী এতদিন বারে বারে  বলে এসেছেন যে, দ্বিতীয় বঙ্গ বিভাজন যে কোন মূল্যে রুখে দেওয়া হবে---তাঁর মুখে এই বিভ্রম সৃষ্টিকারী উক্তি একেবারেই বেমানান ও অনভিপ্রেত৷ যাই হোক, ২২ সেপ্ঢেম্বর পর্যন্ত বন্ধ বন্ধ রাখার অর্থ হচ্ছে, এর মধ্যে  উত্তরকন্যায় পরবর্তী বৈঠক ও পাহাড়ে নাক গলাতে উদগ্রীব থাকা কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তবেপে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের  পরিণতি পর্যন্ত সমস্যা জিইয়ে রাখা৷ রাজনৈতিক সমাধান সবসময় এরকমই  আধাখ্যাচড়া  ও কূটনীতির  মারপ্যাচে  ভর্তি থাকা ব্যাপারই হয় যাতে কাজের কাজ কিছুই  হয় না৷

তবে ৯৪-৯৫ দিন  অতিক্রান্ত  পাহাড়ে  টানা বন্ধ এ সবচেয়ে বড় ও অনুকূল পরিস্থিতি যা তৈরী হয়েছে তা হচ্ছে পাহাড়বাসীর  চরম বিরক্তি, ধৈর্যচ্যুক্তি ও বিদ্রোহের ফলস্বরূপ মোর্চার  মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন তৈরী হওয়া, বিনয় তামাং-এর নেতা হিসেবে উঠে আসা ইত্যাদি৷ একটা কথা অতি স্পষ্ট যে বিমল গুরুং-এর অবস্থা  সুবাস ঘিসিং এর থেকেও খারাপ হবে৷  কিন্তু  তারপর? ঘিসিং-গুরুং এর পর হয়তো বিনয় তামাং  (তামাং ব্যাপার  কী রূপ  নেয় তা সময়ই  বলবে ), তারপর হয়তো কোনো থুলুং৷ পাহাড়ে এইভাবেই  কি চলতে থাকবে?

এহেন পরিস্থিতিতে যে প্রশ্ণটা সামনে উঠে এসেছে তা হচ্ছে দার্জিলিং সমস্যার  সত্যিকারের সমাধান  কোন পথে? এখন  সেই সমাধান  কীভাবে হবে বা হতে পারে৷ সেটাই দেখা যাক৷ কোনো দেশ বা রাষ্ট্র তখনই ‘নেশন’ হতে পারে যখন সেখানকার সকলেই বর্ণ, সম্প্রদায়, তথাকথিত ধর্ম (রেলিজন) জাতপাত ইত্যাদি সর্বপ্রকারের ভেদাভেদ  ভুলে একটা সাধারণ চেতনা  বা সেন্টিমেন্টের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে৷ ভারতবর্ষে স্বাধীনতা  আন্দোলনের  তীব্রতার  এক পর্র্যয়ে  এই পরিস্থিতি তৈরী হয়েছিল অর্র্থৎ ভারত সত্যি সত্যি  একটা নেশন  হয়েছিল৷ কিন্তু  সেই সুযোগকে  কাজে লাগিয়ে  স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এরকমই  নেশন-মূলক ঐক্যবদ্ধতা বজায় রাখার স্বার্থে আর একটি চেতনা বা সেন্টিমেন্টাল আন্দোলনের  আশ্রয় নেওয়ার অতীব প্রয়োজন ছিল৷ কিন্তু তা হয়নি৷ ভারতের সত্যিকারের জননায়ক, নয়নের  মণি, বিপ্লবের অগ্ণিস্ফূলিঙ্গ  নেতাজী সুভাষ (আর হাতে গোণা আরও দু’তিনজনমাত্র) এই প্রয়োজন অনুভব করেন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রাপ্তির আরও বড় আন্দোলনের কথা বলেছিলেন৷ কিন্তু তখনকার স্বার্র্থন্বেষী রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতার গদিতে বসতে অতি ব্যাকুল ছিলেন৷ তারা ভারতের বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে খন্ডিত স্বাধীনতা প্রাপ্তিকেই সহর্ষে স্বীকার করে বসল৷ ফলে আজ ভারত ভীষণ অর্থনৈতিক সংকটে দীর্ণ, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাষ্পে ৷জর্জরিত৷ ঠিক এমতাবস্থায় আজ যেটা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন তা হচ্ছে, সকলকে ঐক্যবদ্ধ করতে একটা তীব্র অর্থনৈতিক আন্দোলন অবিলম্বে গড়ে তোলা৷  অর্থনীতির নিয়মানুযায়ী সেটা শুরু করতে   হয় মাইক্রোস্তরে--- অর্র্থৎ ভারতের বেত্রে সেটা হচ্ছে একই অর্থনৈতিক স্বার্থ , ভাষা-সংসৃকতি , একই সেন্টিমেন্টাল লিগ্যাসী ইত্যাদির ভিত্তিতে বিভিন্ন সামাজিক আর্থিক অঞ্চলগুলির অর্থনৈতিক স্বয়ংম্ভরতা অর্জনের আন্দোলন৷ এটাই প্রাউটিষ্ট সমাজ আন্দোলন৷ এইভাবেই একসময় ভারত, এশিয়া ও সমগ্র পৃথিবী একটি অভিন্ন সামাজিক আর্থিক স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রহে পরিণত হবে৷ এইভাবেই সত্যিকারের ঐক্যবদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হবে৷

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, সাতের ও আটেব দশকের শুরুতে মধ্যপ্রদেশের ছত্রিশগড় অঞ্চলে এই প্রাউটিস্ট সমাজ আন্দোলন  তীব্র রূপ নেয়৷ তারই ফলশ্রুতিস্বরূপ  পরবর্তীকালে ছত্রিশগড় ভারতের পৃথক রাজ্যের স্বীকৃতি পায়৷ যে যাই বলুক বা দাবী করুক, বাস্তব সত্য হচ্ছে ছত্রিশগড়ের সাধারণ মানুষের দাবী অনুযায়ী ওই প্রাউটিস্ট আন্দোলনের  প্রাণপুরুষ স্বগত আচার্য নরেন্দ্রদেবের মূর্ত্তি রাজধানী শহর রায়পুরের মধ্যস্থলে স্বমহিমায় বিরাজমান আছে৷ এমনিভাবেই অন্ধ্রপ্রদেশের সবচেয়ে অনুন্নত ও প্শচাৎপদ অঞ্চল তেলেঙ্গানায় এই প্রাউটিষ্ট সমাজ আন্দোলন গড়ে ওঠে৷ যার পরিণতিতে তেলেঙ্গানা পৃথক রাজ্য হিসাবে স্বীকৃত হয়৷ এমনিই প্রাউটিষ্ট সমাজ আন্দোলন চলছে আমটা মরাঠীতে, বিদর্র্ভে, অসি পঞ্জাবীতে, অঙ্গীকা-মগধ-মিথিলাঞ্চলে, আর এই বাঙলাতেও এই  একই আন্দোলন শুরু থেকে আজও সদাজাগ্রত আছে ও থাকবে৷

সবশেষে পাহাড়ের গোর্র্খ ভাই-বোনেদের উদ্দেশ্যে  ও অন্যান্যদের উদ্দেশ্যেও বলছি--- আপনারা ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর  লোকেরা নেপাল থেকে বাঙলায় এসে বসবাস শুরু করেন৷ তার আগে থেকেই লেপচারা বাঙলার স্থানীয়  মানুষ হিসেবে এখানে আছেনই৷ সেতো অনেক বছর আগেকার কথা৷ এত দীর্ঘ বছর ধরে পুত্র-কন্যা, পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করে অপনারা সকলেই মনেপ্রাণে, বাঙলার সামাজিক -আর্থিক সাংসৃকতিক ভাগ্যের  সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন৷ কই, আপনারা তো এখানকার উপার্জনের টাকা পয়সা বিদেশে কোথাও আপনাদের পরিবার  পরিজনকে পাঠান না৷  আপনারা এখানে উপার্জিত  প্রতিটি পাই-পয়সা এখানেই ব্যয় করেন৷ এটাই স্পষ্ট বাস্তব৷ তাই আপনারা সব অর্থেই  এই বাঙলার  বসবাসকারী, বাঙলার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ  একান্তভাবে বাঙালী৷  এখানেই আপনাদের ঋদ্ধি-বৃদ্ধি -সিদ্ধি, এতেই  আপনাদের শান্তি সুস্থিতি, বৈভব-গৌরব৷ ডিসাইড এ্যান্ড রুল এই বৃটিশ বিভাজনের রাজনীতির ধবজাধারী আজকের রাজনৈতিক নেতারা আপনাদের সামনে ‘গোর্র্খল্যান্ড’নামে একটা ললিপপ বা খুড়োর কল ঝুলিয়ে রেখেছে৷  তার বিষময় ফল তো আপনারা এত বছর ধরে ভুগলেন৷  এখন ভারত ও বাঙলার লোক হিসেবে আপনারাও চিনিস্থানের বিপদের মুখে৷ তাই অলীক, অবাস্তব, কোন ছোট আবেগের বশবর্তী হয়ে আপনারা আর  চলবেন না৷

আর একটা কঠোর বাস্তবতার কথা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই৷ বাঙালী আজ ঘরপোড়া গোরু সমগ্র বাঙালীর সত্যিকারের বাসভূমি বাঙালীস্তান আজ আট-নয় ভাগে বিভাজিত৷ তাই আবার বাঙলা-ভাগ বাঙালীরা যেকোনো মূল্যে রুখে দেবে৷ বাঙালীর এই ক্ষমতা সর্বজন স্বীকৃত৷  আপনারাও তো বাঙলা তথা ভারতের গৌরব৷ তাই আসুন বাঙলাকে নোতুনভাবে গড়ে তুলি, এইভাবে আমরা সার্থক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করি ৷  এইভাবেই বাঙলার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ও শুধু স্থায়ীভাবে হাসবে না, পাহাড়-বাঙলা সত্যি সত্যি  বাঁচবেও৷