দার্জিলিংয়ে গোর্র্খ জনমুক্তি মোর্র্চর অবৈধ আন্দোলন বন্ধ করতে সরকার কি সত্যিই আগ্রহী? প্রশ্ণটা বেশ কয়েকদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছে নানা মহলে৷ গত ১৬ আগষ্ট মদন তামাং হত্যা মামলায় বিমল গুরুং অব্যাহতি পাওয়ায় এই প্রশ্ণটা আবার চাগিয়ে উঠেছে৷ এটা জেলা দায়রা আদালতের রায়৷ তাই সিবিআই যদি সত্যিই আন্তরিক হয় তাহলে তারা উচ্চ আদালতগুলিতে (হাইকোর্ট-সুপ্রীমকোর্ট) মামলা লড়তে পারে ও নিম্নকোর্টের রায় বাতিল করাতে পারে৷ কিন্তু সেটা তারা সেভাবে করলে তো? কিন্তু গোড়াতেই তো গলদ৷ প্রথম সি-আই-ডি চার্জশিটে গুরুংয়ের নাম নেই৷ এফ-আই-আর-এও নাম নেই৷ সিবি আই তদন্তের পরে ফাইনাল চার্জশিটেও গুরুংয়ের নাম নেই৷ শুধু সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে নূতন করে তদন্ত করে৷ সিবিআই চার্জশিটে বিমল গুরুংয়ের নাম জুড়ে দেয়৷ কিন্তু কত বড় আশ্চর্যের কথা আর সিবিআই কর্র্তদের পক্ষে কতখানি লজ্জার কথা,যে বিমলের দেহরক্ষী দীনেশ সুববার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ (সে পলাতক) সে যে বিমল গুরুংয়ের দেহরক্ষী (আসলে তাকে দিয়েই গুরুং মদনকেহত্যা করিয়েছে), সে ব্যাপারে কোন সাক্ষীর তালিকা পর্যন্ত দায়রা আদালতে পেশ করতে পারেনি সিবিআই৷ কয়েকদিন আগে কলকাতা হাইকোর্টে এই সংক্রান্ত একটি মামলায় আইনজীবিদের সওয়াল জবাবে বোঝা গিয়েছিল যে সিবিআই খুব নড়বড়ে করে মামলা সাজিয়েছে৷ দায়রা আদালতে বিচারপর্বে এই মামলা টেকানো মুস্কিল হবে৷ আর ইতোমধ্যে গোর্র্খ জনমুক্তি মোর্চার প্রত্যক্ষ ও প্রবল সমর্থনে বিজেপির মিঃ সুরেন্দ্র সিং আলুওয়ালিয়া পার্র্লমেন্টের এমপি হয়ে গেছেন৷ আর সকলেই জানে সিবিআই পরম প্রভুভক্ত জীববিশেষ, দিল্লীর প্রভুদের অঙ্গুলী হেলনে কাউকে জেলে পচিয়ে মেরে দিতেও পারে, আবার কারোর বিরুদ্ধে মামলা লঘু করে দেওয়া তো তাদের হাতের প্যাঁচ৷ আর, বলিহারী রাজ্যের সি-আই-ডি, তাদের অপদার্থতা কতখানি যে মদন তামাং হত্যার পরেই তো দীনেশ সুববার নাম পত্রপত্রিকায় বেরিয়েছিল৷ অন্ততঃ সে যে গুরুংয়ের দেহরক্ষী তাও জানা হয়ে গিয়েছিল৷ তাকে ধরতে পারা তো দূরের কথা (ধরার যে বিশেষ চেষ্টা হয়েছিল তাও শোনা যায় নি) বিমলের নাম চার্জশিটে তখনই কেন অন্তর্ভুক্ত করা হ’ল না? আর যে সিবিআইয়ের এত সুনাম (!) তারাও এতদিনে দীনেশকে ধরতে কেন ব্যর্থ? গত ১২ জুন তারিখে বহুদিন ধরে ও বহু যত্ন করে তৈরী করা পরিকল্পনা অনুযায়ী আচমকা পেট্রোল বোমা নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ, আর আক্ষরিক অর্থেই পাহাড়ে আগুন জ্বালানো থেকে শুরু করে গোর্র্খ জনমুক্তির মোর্র্চর হিংস্র আন্দোলনের নামে যা চলছে তা স্পষ্টতঃ একটি সন্ত্রাসবাদী কাজ কারবার৷ পেট্রোল বোমা তো আছেই, চোরা গোপ্তা আক্রমণ , গুলি চালানো, কয়েকশ’ কোটি টাকার সম্পত্তি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া, রেললাইন উপড়ে ফেলা, একজন আধা সেনা জওয়ানকে পিছন থেকে আক্রমণ করে খুকরি দিয়ে পিঠ গভীরভাবে চিরে দেওয়া, বড় বড় খুকরী নিয়ে খোলা মিছিল ও আস্ফালন, বাকী আর রইল কী? এতদিন সবাই জানত যে এসব আকছার হয় ভূস্বর্গ-কশ্মীরে৷ সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নাকি বড়ই বেয়াদপ, তাই সরকার পুরোদস্তুর মিলিটারী দিয়ে সেখানে দমন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷ সেই কশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তো আগে থেকেই ও এখন পর্যন্ত পাথর ছঁুড়ে আন্দোলন করছে৷ তারা আগুনে কোটি কোটি টাকার সরকারী সম্পত্তি নষ্ট করেছে বলে এখন পর্যন্ত শোনা যায় নি৷ অথচ দার্জিলিংয়ে গুরুংদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ শুরু হওয়ার কিছুদিন পরেই জানা গিয়েছিল যে, গুরুংদের সঙ্গে বিদেশী রাষ্ট্র---নেপাল, অসম ও উত্তরপূর্বের কয়েকটি নিষিদ্ধ আত্মাগোপনকারী সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে এমনকি চীনের লোকেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে৷ তার কিছুদিন পরেই দার্জিলিং-য়ে মোর্র্চর আশ্রয়ে নিষিদ্ধ মাওবাদী সংঘটনের লোকেদের উপস্থিতি জানা গিয়েছিল৷ তারও কিছুদিন আগে অসমে একজন মোর্র্চ সমর্থক নিষিদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদী তথা বিচ্ছিন্নতাবাদী খাপলাং গোষ্ঠীর কাছে ট্রেনিং নিয়ে ফেরার পথে ধরা পড়েছিল৷ তারপর থেকে দুই রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এনিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য শোণা যাচ্ছে না৷ এই যদি পরিস্থিতি হয়, তাহলে সঙ্গত কারণে শুধু সন্ত্রাসবাদী কেন, গুরুংদের তথাকথিত আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলা হচ্ছে না কেন? এই তো অল্প কয়েকদিন আগে , পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হ’ল যে ১২ই জুনের অতর্কিত আক্রমণ ও বেআইনি আন্দোলনের অন্যতম অভিযুক্ত মোর্চার উগ্রবাদী সমর্থক ও গুরুংয়ের ডানহাতকে সি-আই-ডি গ্রেফতার করেছে৷ সে সম্ভবতঃ এখন কলকাতাতেই সিআইডি হেফাজতেই আছে৷ তার কাছ থেকে এতদিনে অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া উচিত ছিল৷ কই তারও তো কোনো সাড়াশব্দ নেই৷ এদিকে গুরুং হত্যা মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার ফলে সে তো এখন গোপন ডেরা থেকে বেরিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে৷ কিন্তু ভিতরের কথা গুরুংও ভাল করে জানে বোঝে৷ তার নিজের অস্তিত্বই আজ প্রচন্ড সংকটের মধ্যে৷ চারিদিক থেকে প্রবল চাপের মুখে তাকে যুব মোর্র্চর অনশন প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে৷ এখন তার কাছে--- আজ হোক, কাল হোক---বনধ্ প্রত্যাহার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই৷ এতদিন দলের উগ্রপন্থীদের লেলিয়ে দিয়ে, প্রশ্রয় দিয়ে তান্ডব করার পর, আত্মঘাতী পোড়ামাটি নীতি নিয়ে চলার পর গুরুং আজ উভয়সঙ্কটে৷ তার অবস্থা ন যযৌ ন তস্থৌ৷ এটা করার সঙ্গে সঙ্গে গুরুংয়ের নেতৃত্ব নিয়ে টানাটানি পড়বেই৷ আর সেক্ষেত্রে তার ক্রেডিবিলিটি সামান্যতম থাকবে না৷ দার্জিলিংয়ে তার ক্রেডিবিলিটি নিয়ে লোকে প্রশ্ণ করবেই--- এতদিন ধরে এত কিছু করে আমরা শেষে এই পেলুম ! গুরুং তোমার এই ক্ষমতা! দার্জিলিং-য়ে এতদিন ধরে একপক্ষীয় কান্ড-কারখানা চলেছে৷ এবার সরকারে (পড়ুন রাজ্য সরকার) গুরুংকে সন্ত্রাসবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে গ্রেফতার করুক৷ তারপর গোর্র্খ জনমুক্তি মোর্র্চকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে কিনা সেটা সরকার বিবেচনা করে দেখুক৷ কিন্তু হা হতোস্মি ! এখানকার বা কেন্দ্রের সরকারের সদিচ্ছা বা সদর্থক মনোভাবের পরিচয় কবেই বা কে পেয়েছে? চাপে না পড়লে তারা কখনই কিছু করে না৷ সব রাজনৈতিক দলই আগে নিজেদের ও দলের স্বার্থরক্ষার কথা ভাবে৷ এখানকার রাজ্য সরকার হয়তো এখনও ভাবছে, ভেবেই চলেছে, কোনটা করলে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙ্গবে না৷ তাই বর্তমানের দার্জিলিং সমস্যার কোন রাজনৈতিক সমাধান হয় না৷ তাদের কাছে সেই উপযুক্ত স্থায়ী সমাধান আশা করাও দুরাশা৷ এখন যেকোনো মূহুর্তে দার্জিলিং-য়ে বনধ্ প্রত্যাহার হয়ে যেতে পারে৷ তাহলেই সব সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান হয়ে যাবে? মোটেই নয়৷ এইতো গত ৯ই আগষ্ট ‘সকল মারাঠা সমাজ’ নামে এক নাগরিক মঞ্চের ডাকে ৯ লক্ষ লোকের সুশৃংখল মিছিলে মুম্বাই শহর একেবারে অবরুদ্ধ হয়ে গেল৷ এটাই সত্যিকারের সমাধান৷ জনতার আন্দোলন, জনতার গর্জন আর প্রাউটিষ্ট সমাজ আন্দোলন৷ বাঙলাতেও এখন ১৫ কোটি জনসংখ্যা৷ সব ভেদাভেদ ভুলে, বাঙলার বৃহত্তর স্বার্থে কোন পতাকা ছাড়াই কয়েক লক্ষ মানুষের শিলিগুড়ি থেকে পাহাড় বা কলকাতা শহরের এক বৃহৎ অংশ জুড়ে মিছিল করা যায় না? এটা সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক জন-আন্দোলন, বাঙলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে এটা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার৷ এটা করতেই হবে, এটা করা এখন নিতান্ত প্রয়োজন৷ (ক্রমশ)
- Log in to post comments