দেশের ভয়াবহ বেকার সমস্যা ঃ সমাধান কোন্ পথে?

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

সাম্প্রতিক  এক সংবাদে প্রকাশ উত্তরপ্রদেশে পুলিশের  টেলিকম বিভাগে  পিয়নের ৬২টি  শূণ্যপদের  চাকরীর জন্যে  দরখাস্তের আবেদন  করা হয়েছিল৷  আবেদনকারীদের যোগ্যতা নির্র্ধরিত  ছিল অন্ততঃ  পঞ্চম  শ্রেণী পাশ৷ এই ৬২টি শূণ্যপদের  জন্যে আবেদনকারীদের মধ্যে  ছিল ৫০ হাজার  গ্রাজুয়েট, ২৮০০০ মাষ্টার ডিগ্রি পাশ ও ৩,৭০০ পি.এইচ.ডি৷ মোট  আবেদন  জমা  পড়েছিল                        ৯৩,০০০৷ তারমধ্যে  পঞ্চম  থেকে দ্বাদশশ্রেণী  পর্যন্ত  আবেদনকারী ছিল ৪,৭০০৷

 সামান্য এক পিয়নের  চাকরীর জন্যে বিপুল সংখ্যক  পি.এইচ.ডি মাষ্টার ডিগ্রি করা ও গ্র্যাজুয়েট  আবেদনকারীর চিত্র আমাদের দেশের  বেকার সমস্যার  তীব্রতাকেই  নগ্ণভাবে তুলে ধরেছে৷ মানুষ  কোনো বিষয়ে  মাষ্টার  ডিগ্রির  মতো  উচ্চশিক্ষা লাভ করেও  যদি তাকে  সামান্য পিয়নের  কাজের  জন্যে অর্র্থৎ ফাইলপত্র বহনের  কাজের জন্যে  হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে  হয়, তাহলে  বোঝাই  যায়, আমাদের দেশের মানব সম্পদ  কী ধরনের  নষ্ট হচ্ছে৷

আমাদের  দেশের  অর্থনীতি দ্রুত গতিতে  এগিয়ে  চলেছে  বলে প্রধানমন্ত্রী  থেকে  শুরু করে  সব  মন্ত্রীরাই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে  চলেছেন৷  কিন্তু  এই তো  উন্নতির হাল৷ দেশের  অর্থনৈতিক  উন্নতির  প্রথম  কথাটাই  হ’ল সকলের  কর্মসংস্থানের  ব্যবস্থা  করা৷ সাধারণ  অশিক্ষিত  বা স্বল্প শিক্ষিত মানুষ তো দূরের কথা উচ্চশিক্ষিতরাও  এত  বেশি  বেকার --- এতো  কল্পনা করতেও কষ্ট হয়৷ তাহলে শিক্ষারই  বা কী মূল্য?  এ শিক্ষা মানুষকে  কতটুকুই বা  উৎসাহিত করবে?

 এটা শুধু যে উত্তরপ্রদেশের  অর্থনৈতিক  চিত্র তা নয়৷ সারা দেশের এই একই অর্থনৈতিক চিত্র৷  এ রাজ্যেও দেখা গেছে, কয়েকশ’ খালিপদের  জন্যে  লক্ষ লক্ষ  মানুষ আবেদন  করে ও  পরীক্ষা  দেয়৷

তাছাড়া, বিভিন্ন জেলায় যে কোনো  গ্রামে  খোঁজ নিয়ে  জানা যাবে, এই এলাকার  অধিকাংশ  যুবক ছেলে ভিন্ রাজ্যে  গিয়েছে কর্মের সন্ধানে৷  কর্মের সন্ধানে  তারা সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছে,  কোথাও হয়তো অস্থায়ীভাবে কাজ  জুটছে৷

পরে আবার দেখা যাচ্ছে ওই সব এলাকার স্থানীয় যুবক-যুবতীরা কাজ  পাচ্ছে না ওই  এলাকায়  অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে ও  বহিরাগতদের সঙ্গে স্থানীয়দের  সংঘর্ষ দেখা দিচ্ছে৷  এইভাবে দারুণ অর্থনৈতিক অনিশ্চিততার অস্থিরতার  মধ্যে  দেশের  যুবসমাজ  হাবুডুবু খাচ্ছে৷

প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজ্যের  মুখ্যমন্ত্রীরা  দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের  নিজ নিজ  স্থানে  শিল্প  গড়ার  জন্যে  কাতর আবেদন জানাচ্ছেন৷ পুঁজিপতিদের এই অভিযানে  এ রাজ্যের  এক সময়ের  কট্টোর  মাকর্সবাদী মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও কম যেতেন না৷

এ কথা সবার জানা৷  দেশ স্বাধীন হবার পর কেন্দ্র  ও সমস্ত  রাজ্যের  মুখ্যমন্ত্রীরাই এভাবে  দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের  পদতলে  তৈলমর্দন করেছেন৷  পুঁজিপতিরা বিভিন্ন স্থানে  পুঁজি বিনিয়োগ করে  অনেক বড় বড়  কলকারখানা বানিয়েছেন৷  কিন্তু  দেশের  বেকার সমস্যা কি  মিটেছে?  সেটা তো  দূরের কথা বেকার সমস্যা হ্রাসও পায়নি৷ ক্রমশঃ তা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ মাঝে মাঝে  তো ধনী দেশগুলির  অনুকরণে  বেকারদের  ভাতা দেওয়ারও  ব্যবস্থা হ’ল৷ বোঝানো  হ’ল ---  কাজ না করেও  যদি  ভাতা পাওয়া যায় তাহলে ক্ষতি কী?  ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলিতে তো  পুঁজিপতিদের  অভাব নেই৷ অর্থ বিনিয়োগের  জন্যে  অর্থেরও অভাব নেই  বড় বড়  শিল্পও গড়ে উঠছে ৷ কিন্তু  ওই দেশগুলিতেও বেকার সমস্যা  ক্রমবর্ধমান৷ আমেরিকা  যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তণ  প্রেসিডেন্ট ওবামা বর্তমান প্রেসিডেণ্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ক্ষমতায় এসেই  তাদের প্রথম ভাষণে বলতে শোণা গিয়েছিল যে, বেকার সমস্যাই তাদের  দেশের  প্রধান সমস্যা৷

এখানে  উল্লেখ্য, বেকার ভাতাটা  কিন্তু  বেকার  সমস্যার  আদৌ সমাধান নয়৷  কারণ, এতে দেশের  যুবশক্তি অলস  হয়ে যায়৷  দেশের উন্নতিতে  তাদের  সক্রিয় সহযোগিতাও  পাওয়া  যায় না৷ --- যা দেশের পক্ষে  অশনি  সংকেত৷  মানব সম্পদ  দেশের  সবচেয়ে  মূল্যবান  সম্পদ৷  সে সম্পদের  যথাযথ বিকাশ  অর্র্থৎ  শারীরিক, মানসিক  ও আত্মিক এই  ত্রিমুখী বিকাশ না হওয়া মানে  সভ্যতার  বিকাশ রুদ্ধ হওয়া--- শুধু রুদ্ধ  হওয়া  নয় মানব সভ্যতাকে  ধবংসের  দিকে ঠেলে দেওয়া৷

 তাই  পুঁজিবাদী অর্থনীতি  ব্যবস্থা  বেকার সমস্যা সমাধানের পথ নয়৷ তাছাড়া, পুঁজিপতিররা  অত্যাধুনিক  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে শিল্প গড়ে তোলেন  তাকে বলা হয়৷ ‘ক্যাপিট্যাল ইনটেনসিব্ ইন্ডাষ্ট্রি’৷  মূলধন নিবিড় শিল্প৷

যে সমস্ত এলাকা ‘ডেফিসিট লেবার’  এলাকা--- অর্থাৎ কর্মপ্রার্থী কম সেখানে  এই ধরণের  শিল্প বাঞ্জনীয়৷ কিন্তু  যেখানে  ‘সারপ্লাস লেবার’ অর্র্থৎ   যেখানে কর্মপ্রার্থীর  সংখ্যা প্রচুর --- সেখানে  ‘লেবার ইনটেনসিব্ ইনডাষ্ট্রি’ গড়ে  তোলা উচিত৷ ‘লবার ইনটেনসিব্ ইনডাষ্ট্রি’ বলতে বোঝায়--- যে সব ইনডাষ্ট্রিতে  মূলধন কম লাগে কিন্তু বেশী  মানুষের কর্মসংস্থান  হয়৷  পুঁজিপতিরা  এধরণের  শিল্প  চায়না৷ কারণ  এতে  তাদের লাভ  অনেক কম হয়৷  তাই আমাদের দেশে  বেকার সমস্যার  সমাধানের  জন্যে  পুঁজিপতিদের  আমন্ত্রণ জানানোর  প্রয়োজন নেই৷  তাতে  লাভের চেয়ে  ক্ষতি বেশিই৷  তাতে সমস্যার  সমাধান  না হয়ে সমস্যা বৃদ্ধি পাবে৷

তাহলে উপায় কী?  ‘প্রাউট’র মতে এর উপায় হ’ল  সমবায়ের  বিকাশ৷  সমবায়ের  মাধ্যমে  জনগণের  ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র  পুঁজি একত্রিত  করে  স্থানীয় অঞ্চলেরই কৃষিজাত  সম্পদ ও অকৃষি সম্পদের  ওপর ভিত্তি  করে ব্যাপক  শিল্প-বিকাশ  ঘটাতে  হবে৷ ওই এলাকায় কৃষির  আধুনিকীকরণ  করে কর্ষকদের  আয় বাড়াতে  হবে৷ আর  সঙ্গে সঙ্গে  ওই এলাকার  উদ্বৃত্ত শ্রমিকদের  (শিক্ষিত ও অশিক্ষিত)  কর্মে নিযুক্ত করবার  জন্যে কৃষিজাত-দ্রব্য-ভিত্তিক শিল্প ও কৃষি-উপকরণ তৈরীর উপযোগী কৃষি সহায়ক শিল্প  গড়ে তুলতে  হবে৷

এটা মনে রাখতে হবে, সমবায়কে সফল করতে গেলে স্থানীয়  মানুষের  মধ্যে  সমবায়ের  উপকারিতা  সম্পর্কে  ভালভাবে  প্রশিক্ষণ দিতে হবে, মানুষের  সামবায়িক মানসিকতা সৃষ্টির  জন্যে  ও তাদের  নৈতিক বিকাশের  জন্যেও উপযুক্ত  ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে৷ এসব না  করে  সমবায়ের বিকাশ  ঘটানো  যাবে না৷

পুরোনো ধনতান্ত্রিক রীতিনীতির  চর্বিতচর্বন না করে এই প্রগতিশীল  সমাজতান্ত্রিক  নীতিকে  বাস্তবায়িত  করে দেশের বেকার সমস্যাসহ সার্বিক  উন্নয়ণ  যজ্ঞে দেশনেতাদের  ঝাঁপিয়ে  পড়তে  হবে৷  পরিকল্পিতভাবে  কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে  না পড়ে কেবল ক্ষমতার কাড়াকাড়ির  জন্যে  কর্মতৎপরতা দেখিয়ে  প্রকৃত দেশোন্নয়ন সম্ভব নয়৷