দেশপ্রেম বনাম রাজনৈতিক ভণ্ডামি

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

ভারতবর্ষের মাটিতে দেশপ্রেম, দেশের জন্যে আত্মত্যাগ, নিঃস্বার্থভাবে দেশকে ভালোবাসা, দেশমাতৃকার পরধীনতার শৃঙ্খল মোচনে আত্ম বলিদানের সঙ্গে আগষ্ট মাসের সম্পর্ক সুনিবিড়৷ সাম্রাজ্যবাদী, অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকবর্গের নিষ্ঠুর নিপীড়ন, লাঞ্ছনার হাত থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করার সংগ্রামে যে সকল দেশপ্রেমিক গণ আত্মনিয়োগ ও সর্বস্ব পণ করে স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন, তাঁদের জীবনের সঙ্গে আগষ্ট মাস        ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত৷ ১৮৭২ সালের ১৫ই আগষ্ট শ্রী অরবিন্দ ঘোষের জন্ম৷ তিনি প্রথম জীবনে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন ও অত্যন্ত মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজদের গোলামী করবেন না বলেই ইচ্ছাকৃতভাবে আই.সি.এস. পরীক্ষার অশ্ব চালনা বিভাগে অনুপস্থিত ছিলেন৷ স্বদেশী আন্দোলনের কারণে তাঁকে কারবরণও করতে হয়৷ তবে পরবর্ত্তীকালে আধ্যাত্মিক পথের অনুসারী হয়ে ঋষি অরবিন্দ নামে পরিচিত হন ও পন্ডিচেরীতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন৷ ১৯০৮ সালের ১১ই আগষ্ট অগ্ণিযুগের বীর-বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু মুজাঃফরপুর জেলে অত্যাচারী ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ড হত্যা ষড়যন্ত্রের মামলায় ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করে মাত্র ১৮ বছর বয়সে শহীদ হন৷ এই তরুণ শহীদের আত্মবলিদান লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী,  তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীকে নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে ও স্বদেশী আন্দোলন আরও ব্যাপক ও তীব্রতর হয়ে ওঠে৷ স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, দেশপ্রেমের মূর্তপ্রতীক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু কূটচক্রী ইংরেজ ও তৎকালীন দেশীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের চক্রান্তে কলকাতায় স্বগৃহে অন্তরীণ ছিলেন৷ সেই সময় ইংরেজদের রক্তচক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে ভ্রাতুষ্পুত্র শিশির কুমার বসু ও কতিপয় শুভাকাঙ্খীদের সহায়তায় ১৯৪১ সালের ১৭ই জানুয়ারী গভীর রাত্রে কলকাতা ত্যাগ করে দেশান্তরী হন৷ এরপর বহু কষ্টবরণ করে বিভিন্ন ছদ্মবেশে অনেক দুর্গম পথ পেরিয়ে সিঙ্গাপুরে পৌঁছান ও রাসবিহারী বসুর গড়ে তোলা আজাদহিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত হন৷ সেখানেই তিনি নেতাজী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন৷ নেতাজী জাপান ও অন্যান্য দেশের সহায়তায় আজাদহিন্দ বাহিনীকে শক্তিশালী করে তোলেন ও ভারতবর্ষের পথে অগ্রসর হন৷ শেষ পর্যন্ত আজাদ হিন্দ বাহিনী মণিপুরে ভারতের মাটিও স্পর্শ করেছিল৷ কিন্তু হঠাৎ ১৯৪৫ সালের ২৩ আগষ্ট টোকিও রেডিওতে ঘোষণা করা হয় যে, তাইহোকু বিমানবন্দরে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর সর্র্বঙ্গ পুড়ে যায় ও তিনি মৃত্যুবরণ করেন৷ যদিও ভারতবাসী এই ঘটনার সত্যতা মেনে নিতে পারেনি৷ পরবর্ত্তীকালে বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণ, তথ্যানুসন্ধান, তদন্ত কমিশন ইত্যাদির মাধ্যমে এখনও এই রহস্যের উন্মোচন সম্ভব হয়নি৷ অনেকের মতে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনার পরেও বিভিন্নস্থানে নেতাজীর উপস্থিতি চিহ্ণিত হয়েছে৷ নেতাজী সম্পর্কিত বহু তথ্য এখনও বিভিন্ন দেশের মহাফেজ খানায় ফাইল বন্দি হয়ে আছে যা কোনো অজ্ঞাত কারণে প্রকাশিত হয়নি৷ বাঙালী তথা ভারতবাসীদের আশা, একদিন অবশ্যই এই সত্য প্রকাশিত হবে ও নেতাজীর সম্পূর্ণ জীবনপঞ্জী নূতনভাবে রচিত হবে৷ তবে যাই হোক ,নেতাজীর রহস্যময় অন্তর্ধানের সঙ্গে আগষ্টমাসের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাপতন৷

১৯৪২ সালের আগষ্ট মাসে সমগ্র দেশে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন সংঘটিত হয় যার নাম‘‘ইংরেজ, ভারত ছাড়ো আন্দোলন’’৷ এই আন্দোলনের চাপ, সশস্ত্র বিপ্লবীদের মরণপণ বিদ্রোহ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণামে উদ্ভূত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতে অবস্থান নিরাপদ মনে করেনি৷ শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসেই দেশীয় নেতৃত্বের হাতে ভারতবর্ষের শাসনভার প্রত্যর্পণ করে বিদায় নিতে বাধ্য হয়৷ অবশ্য এই দেশ ছাড়ার আগে হিন্দু-মুসলমান দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে অখন্ড ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসকেরা দুটি নোতুন রাষ্ট্রে ভাগ করে ফেলতে সমর্থ হয় তৎকালীন কতিপয় উচ্চাকাঙ্খী স্বার্থপর, মসনদ লোভী অপরিণামদর্শী নেতৃত্বের যোগ সাজসে৷ হিন্দুস্তান (ভারত) ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি, হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের লক্ষ লক্ষ দেশবাসীর অসহায় দেশান্তরণ, জাতি দাঙ্গায় রক্তের হোলি খেলা , দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী পারস্পরিক অবিশ্বাস-অশান্তির বাতাবরণ ভারতবর্ষের সনাতন মৈত্রী, সম্প্রীতি ও প্রেমের ঐতিহ্যকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে৷ এরফলে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর অখন্ড ভারতের পূর্ণ স্বরাজ প্রাপ্তির জন্যে আত্মত্যাগ, হাজার হাজার বিপ্লবীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্মোৎসর্গ , লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা লাভের প্রত্যাশা চিরদিনের মতো ধবংসপ্রাপ্ত হয়৷

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারতের জনগণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও দেশভাগের দুষ্ট ক্ষত তৎকালীন ভারতের শাসনব্যবস্থায় যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল৷ প্রথমতঃ দেশীয় শাসকবর্গ ব্রিটিশ ঘরানার উত্তরাধিকারকেই বহন করছিলেন, দ্বিতীয়তঃ দেশের সংবিধান ও শাসন পরিচালনার নির্দেশনামা ব্রিটিশ পদ্ধতিরই অনুসারী ছিল, তৃতীয়তঃ ব্রিটিশ শাসনকালে যে সকল পুঁজিপতিরা ফুলে ফেঁপে উঠেছিল --- দেশীয় শাসকদের ওপর তাঁদের কর্ত্তৃত্বই বজায় রইল পুরোদমে৷ ফলে স্বাধীনতার সুফল সেভাবে জনসাধারণের কাছে পৌঁছতে পারেনি--- বরং পুঁজিবাদী শোষণের বেড়াজাল আরো বিস্তৃত হয়েছিল৷ জনগণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেলেন৷ স্বাধীনতার পর যত সময় গড়িয়েছে, পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে৷ দলীয় রাজনীতির বিষময় ফলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, পেশীশক্তির ব্যবহার, হিংসা, জনসাধারণের মধ্যে দল-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়-ভাষাগত বিভাজন, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা ইত্যাদি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে৷ জনসেবার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে শুধুমাত্র দল গোষ্ঠী ও ব্যাষ্টিস্বার্থ চরিতার্থ করার দিকে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীগণ অত্যধিক মনোযোগী হয়েছেন৷ এরই সুযোগ নিয়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত মুনাফাবাজ চোরা কারবারী, মজুতদার, শিল্পপতি ও পুঁজিপতির দল৷ লাভের অঙ্ক বৃদ্ধির জন্যে অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যশস্য, দুধ, পানীয়, ঔষধ, ফলমূল, শাকসব্জি, সবেতেই মারণরোগ উৎপাদনকারী ভেজাল মিশিয়ে দেশের মানুষের চরম সর্বনাশ ডেকে আনছে৷ কোনোরকম নিয়মের তোয়াক্কা না করে জল-বায়ু-পরিবেশ দূষণকে এমন পর্যায় নিয়ে চলেছে যার ফল হচ্ছে মারাত্মক৷ বনজসম্পদের অনিয়ন্ত্রিত ধবংসের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে ও সাধারণ তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সংঘটিত হচ্ছে৷ এগুলির প্রভাবে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়- যথা- খরা, বন্যা, ভূমিকম্প, বজ্রপাত ইত্যাদির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে যার পরিণামে কোটি কোটি মানুষ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর জীবনহানি ঘটছে তথা প্রাকৃতিক সম্পদের বিনাশ হয়ে চলেছে৷ দেশের প্রশাসনে যে সকল নেতৃবৃন্দ রয়েছেন, তাঁরা ওই সব বিষয় জেনেও না জানার ও দেখে না দেখার ভান করছেন---যেহেতু নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্যে তাঁদের এই পুঁজিপতি-ব্যবসায়ী -শিল্পপতিগোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করতে হয়৷ শুধু তাই নয় দেশের অর্থনীতি, শিল্পনীতি, কৃষিনীতি ইত্যাদিও এইসব পুঁজিপতিদের নির্দেশে ও সুবিধার্থে রচিত হয়--- তা সরকার যে দলের দ্বারাই পরিচালিত হোক না কেন৷ এই গোষ্ঠির প্রভাব প্রতিপত্তি এতটাই প্রবল যে এরা প্রয়োজনে ঘঁুিুট সাজিয়ে যে কোনো সরকারকে ফেলে দিতে পারবে৷ বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণকে ভগবান বলা হলেও প্রকৃত পক্ষে তাঁদের অবস্থা ঠঁুটো জগন্নাথের মতো ৷ শুধু মাত্র নির্বাচনের সময় ভোটদানই তাঁদের একমাত্র দায়িত্ব--- তা ও পেশীশক্তির আস্ফালন, মার দাঙ্গা বোমা, বন্দুকের রমরমা বাজারে সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না৷

স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বা স্বাধীনতা পরবর্ত্তী কিছুদিন রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দের মধ্যে নীতিবাদ, ন্যায় পরায়ণতা, দেশভক্তি, কর্ত্তব্য নিষ্ঠা , সততা, সহনশীলতা, মানুষের প্রতি ভালবাসা ও মমত্ব বোধ, সহানুভূতি, সহমর্মিতা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলীর সমাবেশ পরিলক্ষিত হতো৷ সেই রাজনীতিবিদগণ চিরনমস্য৷ তাঁদের আত্মত্যাগ, দেশের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, জনসেবার প্রতি নিষ্ঠা, মানুষের বিপদের দিনে আত্মীয় বন্ধুর মতো আচরণ সকলকে আকর্ষণ করত৷ তার পর সময় যত এগিয়েছে তাঁরাও বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির মত হারিয়ে গেছেন৷ আর সেই স্থানে বাহুবলী, অহংকারী , বদমেজাজী, হীনস্বার্থবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যষ্টিরা রাজনীতির মঞ্চে অবতীর্ণ হয়ে গণতন্ত্রকে ফাঁকাবুলি ও ধাপ্পাবাজির আসরে পরিণত করেছে৷

 বিগত কয়েক বছরে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অত্যন্ত বিষিয়ে উঠেছে৷ জনস্বার্থের অগ্রাধিকার ও জনগণের সেবার পরিবর্তে রাজনৈতিক চমক ও ভন্ডামিই বেশি প্রকট৷ ২০১৬ সালের ৮ই নবেম্বর হঠাৎ দেশ থেকে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে দেওয়া হয়৷ ঘোষণানুযায়ী , এই উদ্যোগের ফলে জাল নোট, কালোধন, সন্ত্রাসবাদ, নিয়ন্ত্রণ করা যাবে৷ দেশের কোটি কোটি মানুষের তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা৷ এটিএম , ব্যাঙ্ক, পোষ্টফিসের সামনে লাইনে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভোর থেকে রাত পর্যন্ত হত্যে দিলেন৷ পারিবারিক প্রয়োজনে চিকিৎসা ও আকস্মিক আবশ্যকতায় নিজের কষ্টার্জিত অর্থ পেতে মানুষের হয়রানি সারাদেশকে রাস্তায় নামিয়ে ফেলেছিল৷ হাজার হাজার ক্ষুদ্র শিল্প, কুটির শিল্প, নগদের অভাবে বন্ধ হল৷ লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার, কর্মহীন, সম্বলহীন হয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করলেন৷ অসংখ্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হল৷ অথচ ২২ মাস পরে ২০১৮ সালের আগষ্টের শেষ সপ্তাহে রিজার্ভব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্টে জানানো হয়েছে যে, প্রায় ৯৯.৩ শতাংশ বাতিল টাকা ব্যাঙ্কে ফিরে এসেছে৷ বাকি টাকার সিংহভাগ নেপাল ও ভুটানে যাদের কাছে ছিল তা রিজার্ভব্যাঙ্কে জমা পড়ে নি৷ এছাড়া বহু মানুষ যারা বিদেশে ছিলেন তাঁরা ঝামেলা এড়াতে ব্যাঙ্কে অচল টাকা জমা করেননি৷ তাহলে কালো টাকা গেল কোথায়? দ্বিতীয়তঃ জাল টাকার সংখ্যা অতি নগণ্য, বরং নোতুন ২০০০ টাকার জাল নোটই বেশি সংখ্যক পাওয়া গেছে৷ তৃতীয়তঃ সন্ত্রাসবাদ এই ২২ মাসে কমার চেয়ে বেড়েছে অনেকটাই ৷ বলা হয়েছিল, ক্যাশলেস বা লেশ ক্যাশ অর্থনীতি ও ডিজিটাল ইকোনমির কথা৷ তথ্যানুযায়ী এক্ষেত্রেও ফল খুব একটা আশাপ্রদ নয়৷ শিক্ষা, কর্মসংস্থান,সচেতনতা, বৃদ্ধি না পেলে এই প্রকল্প সার্থক হওয়া সম্ভব নয়৷ শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষের সর্বনাশ ও রাজনৈতিক চমকের ঢক্কা নিনাদ ব্যতীত নোটবন্দিতে আর কোন লাভ হয়নি৷ দেশবাসীকে জাত-পাত-ধর্ম-সম্প্রদায়-ভাষার ভিত্তিতে বিভাজিত করে ভোটের ক্রীড়নকে পরিণত করা হয়েছে৷ যারফলে সামাজিক বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেয়েছে লাগামছাড়া ভাবে৷ গো রক্ষা, গো-মাংস ভক্ষণ, গো-পাচার, প্রভৃতির ধূয়ো তুলে গণপ্রহারের ঘটনাগুলি সারা দেশে গণসন্ত্রাসের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে৷ বিভিন্ন অন্যায্য, অপ্রয়োজনীয় ঘটনাক্রমকে কেন্দ্র করে শিল্প সংস্কৃতির সুস্থ পরিবেশকে হিংসা ও সন্ত্রাস কবলিত করা হয়েছে৷ গণতন্ত্রের কাঠামো হিসেবে চিহ্ণিত সংবাদ মাধ্যম ও প্রতিবাদী স্বরকে স্তব্ধ- সন্ত্রস্ত করার চেষ্টা হয়েছে৷ গৌরী লঙ্কেশ-কালবুর্গি হত্যা, অতিসম্প্রতি মাওবাদী সংস্রবের অভিযোগে ও প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত সন্দেহে ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখা, অরুণ ফেরেরা, ভার্নন গঞ্জালভেস প্রমুখ বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত পাঁচ জন বুদ্ধিজীবি সমাজকর্মীকে দেশের ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য থেকে গ্রেপ্তার --- এই বিষয়টির সত্যতা প্রমাণ করেছে৷ শুধু তাই নয়, তাঁদের সুপ্রিমকোর্টে তোলা হ’লে বিচারপতি গণ বলেছেন, ‘‘বিরুদ্ধ মত হল গণতন্ত্রের সেফটি ভালভ’’ ও তাঁদের পুলিশ হেফাজতে না দিয়ে গৃহবন্দি করে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন৷

দেশের অর্থনৈতিক চালচিত্রও খুব একটা সন্তোষজনক অবস্থায় নেই৷ প্রথমতঃ নোটবন্দির ফলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছে , কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে, জিডিপি ও সার্বিক বৃদ্ধির হার কমেছে--- এইসব কুফলের পূর্বাভাস নোটবন্দির সময়ে বিশেষজ্ঞ মহল দিয়েছিলেন ও বাস্তবেও তাই ঘটেছে৷ এছাড়া প্রতিদিন হরেক রকম নিয়ম নির্দেশাবলী দেশের মানুষকে যৎপরোনাস্তি হয়রান করেছে৷ ফলশ্রুতিতে রিজার্ভব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ও সরকারের ওপর মানুষের আস্থা তলানিতে নেমে এসেছে৷ সর্র্বেপরি লাগামহীণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, প্রতিদিন পেট্রোল ডিজেলের মূল্যের ঊধর্বগতি ও ডলারের তুলনায় টাকার  মূল্য হ্রাস , ব্যাঙ্কের আমানতে সুদ হ্রাস, ইত্যাদি সাধারণ মানুষের জীবন যন্ত্রণাকে আরো দুর্বিষহ করে তুলেছে৷ ব্যাঙ্কগুলিতে অনাদায়ী ঋণ কয়েক লক্ষ কোটি টাকা ও ঋণ খেলাপীদের দেনা ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে ফেলার কারণে ব্যাঙ্কগুলিরও নাভিঃশ্বাস অবস্থা৷ গোদের ওপর বিষফোঁড়ারূপে ব্যাঙ্ক প্রতারণার ফলে (বিজয় মাল্যের প্রায় ৯ হাজার কোটি, নীরব মোদি-মেহুল চোক্সির প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা ও অন্যান্য অনেকের হাজার হাজার কোটি টাকা) ব্যাঙ্কগুলিকে গুনাগার দিতে হচ্ছে৷ অথচ ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের ৫/১০ লক্ষ টাকা ঋণ পেতে জুতোর শুকতালা ক্ষইয়ে ফেলতে হচ্ছে ৷ ব্যাঙ্কগুলির বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে উদ্ধারের ও উজ্জীবনের জন্যে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিচ্ছে যা জনগণের কর প্রদত্ত টাকা৷ সেই টাকায় উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, শিল্প স্থাপন হলে জনসাধারণের উপকারে লাগত৷ সরকার এই সব ব্যর্থতাকে ঢাকতে গিয়ে মাঝে মাঝে চমক ও ধাপ্পার আশ্রয় নিচ্ছে৷ দেশের জনগণের মনে শাসক দলের সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব দূর করার লক্ষ্যে নানাবিধ ফন্দিফিকির চালানো হচ্ছে৷ এমনকি প্রাক্তণ প্রধান মন্ত্রীর অস্থি-ভস্ম বিসর্জনের উদ্দেশ্যে অস্থিকলস রাজনীতির দ্বারা সারাদেশে সহানুভূতির বাতাবরণ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে, যাতে আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে এর সুফল কাজে লাগানো যায়৷ অথচ জীবিত অবস্থায় তাঁকে দীর্ঘদিন অবহেলা করা হয়েছিল৷ এই সব ঘটনাক্রম রাজনৈতিক ভন্ডামী ও দেউলিয়াপনা ছাড়া আর কিছুই নয়৷ সাম্প্রতিক অসম, মণিপুরে এন.আর.সি. বা নাগরিকপঞ্জী ও ইনার লাইন পারমিট ইত্যাদি সংক্রান্ত যে কর্মকান্ড ও পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তাও এই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ ৷ আর এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঙালী৷ প্রায় ৪০ লক্ষ বাঙালিকে এর জন্যে মাশুল গুনতে হচ্ছে৷ যদিও বাঙলা ও বাঙালীর প্রতি বিদ্বেষ, বিমাতৃ সুলভ মনোভাব স্বাধীনতার আগে থেকেই অবিরামভাবে চলেছে--- যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় যা কখনোই কাম্য নয়৷

প্রকৃত দেশসেবা করতে হলে রাজনীতিবিদদের দেশের মানুষকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসতে হবে৷ দাম্ভিকতা, ভাঁওতাবাজি বা ভন্ডামীর দ্বারা জনসেবা সম্ভব নয়৷ সত্যিকারের মানবপ্রেম ও নৈতিকতা না থাকলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়যুক্ত হওয়াও যায় না৷ আর নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে আধ্যাত্মিকতার পথে চলতেই হয়৷ প্রতিটি মানুষকে গোষ্ঠী-সম্প্রদায়-ভাষা নির্বিশেষে সুবিচার প্রদান করতে হবে, কোনোরকম শোষণকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না৷ জগতের প্রতিটি জীব, উদ্ভিদ, জড়,মানুষ পরমপিতার সন্তান সন্ততি--- এই ভাবনা জাগ্রত না হলে জীবপ্রেম, মানবপ্রেম বা দেশপ্রেম কখনই খাঁটি হতে পারে না৷ মানুষের সমাজ এক ও অবিভাজ্য ৷ পৃথিবী বা দেশের সমগ্র সম্পদে প্রতিটি মানুষের সমানাধিকার, এই সহজ সরল সত্যটাকে উপলদ্ধি করতেই হবে৷ পুঁজিপতিদের ঘরে সম্পদের পাহাড় জমতে দেওয়া চলবে না৷ সেই কারণে দেশ ও সমাজের নেতৃত্বে একমাত্র আধ্যাত্মিকতায় প্রতিষ্ঠিত, নৈতিকতায় দৃপ্ত , চারিত্রিক দৃঢ়তায় বলিষ্ঠ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে সদা সতর্ক ব্যষ্টিরাই অংশগ্রহণ করবেন৷ প্রয়োজনে দেশ কাল পাত্রের পরিস্থিতি-পরিবেশ অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনার জন্যে সংবিধান সংশোধন বা নূতন সংবিধান রচনা করতে হবে, যেন প্রতিটি নাগরিক সুবিচার ও উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করতে পারেন ও সমাজ থেকে সমস্ত দুর্নীতি অন্যায় অবিচার শোষণ চিরদিনের মতো লয়প্রাপ্ত হয়৷