গত ২৭ শে অক্টোবর সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে আয়োজিত রাওয়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ত্রিপুরার কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডঃ আদিত্য মহান্তি তাঁর ভাষণে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন৷ তিনি বললেন, আজকের সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা মানুষ আজ দিশা হারিয়েছে৷ মানুষ ভুলে গেছে তার লক্ষ্য কী? শিক্ষিত থেকে সাধারণ মানুষ এই একই ব্যাধিতে আক্রান্ত৷ কেবল সাময়িক আত্মসুখের পেছনে সবাই উন্মত্তের মত ছুটে চলেছে৷ আর সীমাহীনভাবে এই আত্মসুখের উন্মত্ততায় মানুষ প্রকৃতপক্ষে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের বিরুদ্ধে ছুটে চলেছে, বৃহত্তর সমাজের চরম ক্ষতি ডেকে আনছে৷ মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রকৃতপক্ষে পারস্পরিক সম্পর্ক কী সেটাই সে জানে না৷ তাই সমাজের প্রতি তার কর্তব্য, পরিবেশের সঙ্গে তার কর্তব্য সেটাই সে বিস্মৃত৷ আর নিজের প্রকৃত কল্যাণটাই বা কী বা কোন পথে এ সম্পর্কে ই মানুষ আজ সম্পূর্ণ অজ্ঞ৷ সমাজের সমস্ত সমস্যার মূল কিন্তু এখানেই৷
এই পরিস্থিতিতে আনন্দমার্গের প্রবর্তক শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী মানুষকে তার জীবনের সঠিক দিশা দেখিয়েছেন৷ মানুষের জীবনের পরমলক্ষ্য ও কর্তব্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন৷ সমাজের সমস্ত সমস্যার প্রকৃত সমাধানের পথ নির্দেশনা দিয়েছেন৷ এটাই মানবসমাজকে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সবচেয়ে বড় অবদান৷
মূলনীতি যদি ভুল হয়, তাহলে কর্মধারা যাই হোক না কেন তা শেষ পর্যন্ত ভুল হতে বাধ্য ও তা শেষ পর্যন্ত মানুষের কল্যাণ না করে অকল্যাণই সাধন করতে বাধ্য৷ জীবনের তথা সমাজের এই মূল নীতিটাই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি সুস্পষ্টভাবেই ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন৷
ডঃ আদিত্য মহান্তির এই বিশ্লেষণ গভীরভাবে অনুধাবনযোগ্য৷ মানুষের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে পন্ডিত মহলে, দার্শনিক মহলেও মতভেদের অন্ত নেই৷ যাঁরা জড়বাদী, তাঁরা ঈশ্বরকে স্বীকার করেন না, মনের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকেও তাঁরা স্বীকার করেন না৷ মনকে মস্তিষ্কের একটা গুণ বলেন৷ দৈহিক প্রয়োজনের পূর্ত্তি হলেই মানুষের সমস্ত সমস্যার অবসান হবে বলে তাঁরা মনে করেন৷ তাঁদের কাছে মানসিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই৷ তাঁরা মনে করেন, সমাজের সামাজিক -অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমেই সমাজের সমস্ত সমস্যার সমাধান সম্ভব ও মানুষের সর্র্বত্মক কল্যাণ সম্ভব৷ এই ধারণার বশবর্তী হয়ে মার্কসবাদীরা বিপ্লবের নামে সারা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে সমাজব্যবস্থা পাল্টাতে উদ্যোগী হলেন৷ অনেক দেশে তাঁরা ক্ষমতার আসনেও এলেন৷ শেষ পর্যন্ত সর্বত্র চরম নিষ্ঠুরতাপূর্ণ একনায়কতন্ত্রের শেষে মার্কসবাদের অপমৃত্যু ঘটল৷
বর্তমান বিশ্বজুড়ে যে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, তার মূলে রয়েছে আত্মসুখতত্ত্ব৷ নিজেই সুখে থাক৷ সবাই সুখ চায়৷ আর এই সুখপ্রাপ্তির জন্যে যত পার ভোগ্যদ্রব্য করায়ত্ত কর৷ এই ভোগবাদের উন্মাদনায়, বলতে গেলে, সারা বিশ্ব আজ উন্মাদ হয়ে উঠেছে৷ মানুষ হয়ে উঠছে চরম স্বার্থপর৷ এই স্বার্থপরতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি সমাজের নানান অমানবিক ঘটনায়৷ এরই ফলে চলছে সর্বত্র ব্যভিচার , নারী নির্র্যতন, অবাধ দুর্নীতি ও শোষণ৷ সমাজে অন্যের প্রতি দায়বদ্ধতা, পরিবেশ-চেতনা, সবকিছু ভুলে পৃথিবীটাকে আজ নরক বানিয়ে ফেলা হচ্ছে৷
তথাকথিত ধর্মের ক্ষেত্রেও আজ অজস্র কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, অযৌক্তিক ও অমানবিক লোকাচার মানব সভ্যতাকে বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত করে ফেলেছে৷ আর সেই বদ্ধ জলাশয় মারাত্মক সব ব্যাধির ডিপো হয়ে উঠেছে৷ মানুষের সমাজ প্রগতির রাস্তা ভুলে গেছে৷ বিভিন্ন ধর্মমতের (রিলিজিয়ন) অনুগামীরা মানবসমাজের শান্তিকে চরমভাবে বিঘ্নিত করছে৷
আধ্যাত্মিক জগতের বিভিন্ন দর্শন দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ কোনোটাই নিপীড়িত মানবতার মুক্তির যথার্থ পথ দেখাতে পারছে না৷ মানুষের সমাজ অন্ধকারে পথ হারিয়েছে৷
এই পরিপ্রেক্ষিতে যুগপুরুষ শ্রীশ্রীআনন্দমূত্তিজী মানুষকে নোতুন পথের সন্ধান দিয়ে বলেছেন, দ্বৈতবাদ নয়, অদ্বৈতবাদও নয়, মানুষের যথার্থ আদর্শ হ’ল ‘অদ্বৈত-দ্বৈতাদ্বৈতাবাদ’৷ অর্র্থৎ শুরুতে অদ্বৈত, তারপর দ্বৈত, অন্তিমে আবার অদ্বৈত৷ অর্র্থৎ এক পরমব্রহ্ম থেকে জগৎ তথা জগৎবাসীর সৃষ্টি৷ এই জগৎবাসীর জীবনের পরম লক্ষ্যও সেই এক পরমব্রহ্মে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া৷
জীবনের লক্ষ্য হবে ব্রহ্ম-পরমাত্মা৷ একই আত্মার প্রবাহ সবার মধ্যে৷ একই আত্মিক সূত্রে সবাই বাঁধা রয়েছে৷ তাই পারস্পরিক ভালবাসা-বিশ্বপ্রেম এটাই স্বাভাবিক৷ সমস্ত মানুষই শুধু নয়, জীবজন্তু, পশুপাখী, তরুলতা সবাইকে ভালবাসতে হবে৷ এই পৃথিবীর সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলতে হবে জীবনের চরিতার্থতার পথে৷ এটাই মানুষের জীবনের প্রকৃত আদর্শ৷ এটাই সমস্ত মানুষের প্রকৃত কল্যাণের পথ ৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি এরই নাম দিয়েছেন নব্যমানবতাবাদ৷ এই নব্যমানবতাবাদই নিপীড়িত মানবতার একমাত্র আশ্রয়৷ আজকের সমস্ত সমস্যার সমাধান এই নব্যমানবতার পথেই আসবে৷
এই নব্যমানবতাবাদে মানুষকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে৷ তারজন্যে চাই উপযুক্ত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা৷ সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের নামে যে সমস্ত অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ডগ্মা তথা ভাবজড়তা রয়েছে--- এই সবকিছুর ঊর্ধে উঠতে হবে৷ এই যুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত আধ্যাত্মিক মানবতাবাদই আজকের সমাজের সমস্ত সমস্যার একমাত্র সমাধান৷
- Log in to post comments