বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ২২ টাকা প্রতি কেজিদরে ৷ এখন শ্রাবণ মাস৷ আর দুমাস পরে কি দামে পৌঁছাবে আলুর দাম? এই প্রশ্ণ কিন্তু ‘‘ঘন্টা খানেক সঙ্গে সুমন’’ নামক কোনও টিভির শোয়ের হোষ্ট করছে না৷ এ প্রশ্ণ আজ সারা বাংলার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ বাজারে পৌঁছে সব্জিতে হাত দিয়ে আঁতকে উঠছে৷ পুঁই শাক, ভেণ্ডি, পটল, কুমড়ো, শশা, বেগুন, পেঁপে সবার একদর ২৫ টাকা কেজি৷ কোথাও চিচিঙ্গে , ঝিঙে, টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৩০টাকায়৷ আদা ১৩০ টাকা কেজি৷ পকেটে একশ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে বাড়িতে এসে পৌঁছাবে মোট আড়াই কিলো সব্জি৷ মাছ, তেল, চাল, ডাল, মশলার হিসাব আলাদা করতে হবে৷ ৬ জন মানুষের সংসারে দিনে ২০০ টাকার কাঁচা বাজার না হলে আধপেটা খেয়ে থাকতে হবে৷ এটাই আজকের বাস্তব চিত্র৷
প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে৷ সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে পরিস্থিতি৷ খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই এখন সবচেয়ে বড়ো দায়৷ মূল্যবৃদ্ধি আগামী দিনে কোথায় পৌঁছাবে তা ভাবলে আতঙ্ক হয়৷ সমাজ সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন যে, বাজারে সব্জির মূল্যবৃদ্ধি কখনই চাষী করে না৷ তা হলে মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় কারা? সব্জি ব্যবসার ক্ষেত্রে চাষী যে ফসল ফলায় সেই সব্জি তাদের কাছ থেকে কিনে নেয় গ্রামীণ ভেন্ডাররা৷ তারপর তাঁরা পাইকারি বাজারের ফড়ে বা এজেন্ট বা দালালের কাছে বিক্রি করে৷ খুচরো ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে এসে আমাদের কাছে বিক্রি করে৷ চাষী ও ক্রেতার মাঝে এভাবেই বিভিন্ন ভাগে কিংবা ধাপে ধাপে ফড়ে, দালাল বা এজেন্টের হাত ঘুরে সব ধরনের সব্জি বা নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যর দাম নিয়ন্ত্রণ বা মূল্যবৃদ্ধি ঘটে ৷ আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে এসব চলছে৷ সবাই সবকিছু জানার পরও চুপচাপ, নীরব দর্শক৷ চাষীর হাত থেকে ফসল চলে যাওয়ার পর কিভাবে কোথায়--- কাদের দ্বারা মূল্যবৃদ্ধি ঘটে তা সরকার জানা সত্ত্বেও চুপ করে বসে থাকে৷ যখন সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ দেখায় ভাঙচুর চালায়, তখন দেবদূতের মতো হাজির হয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের নাগালে রাখার গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়ে সব ধরনের মিডিয়াকে ডেকে ঘন্টা কাঁসর বাজিয়ে ঘটা করে ঘোষণা করে টাক্স ফোর্স তৈরী করা হলো৷ আজ থেকে আটমাস আগে এভাবেই টাক্সফোর্স গড়ে তোলা হয়েছিল৷ কিন্তু আজ পর্যন্ত বোঝা যায়নি ‘টাক্সফোর্স’ আসলে কি? এটা গায়ে চরাতে হয় নাকি মাথায় মাখতে হয় নাকি সানগ্লাসের মতো চোখে গুজতে হয়?
পশ্চিমবঙ্গের বাস্তব চিত্রটা হলো গত আট মাসে একবারও সেই তথাকথিত ‘টাক্সফোর্সের’ একটাও মিটিং হয়নি৷ সেখানে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ তো অনেক দূরের ব্যাপার৷ মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে হলে অনেক সততার পরিচয় দিতে হয়৷ মিডিয়াসর্বস্ব প্রচার দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি রোখা যায় না৷
আজ থেকে ৮ মাস আগের খাদ্যদ্রব্যের বাজার মূল্য ও আজকের বাজার মূল্য আকাশ পাতাল পার্থক্য৷ ‘টাস্কফোর্সে’র সদস্যরা সবই জানেন৷ কিন্তু দাম কমানোর ব্যাপারে তাদের ভূমিকা ঠঁুঠো জগন্নাথের মতো৷ এসব কমিটি তৈরী করে তার কাজকর্ম পরিচালনা করার জন্যে প্রচুর টাকা খরচ হয়৷ কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না৷ পরিবর্তে মাঝে মাঝে দলবেঁধে মিডিয়াকে সঙ্গে করে নিয়ে এবাজার, ও বাজার , সে বাজারে ঢুকে দু-চার জন গরিব সব্জি বিক্রেতার দিকে বড়ো বড়ো রক্তচক্ষু দেখিয়ে ধমকিয়ে-চমকিয়ে শেষে সব্জি পাওয়া যাচ্ছে ১২ টাকায় সেই সব্জির দাম বেঁধে দেওয়া হয় ২০টাকায় এরকম বৈপ্লবিক কর্ম পরিচালনা করে যে যার বাড়ি চলে যাওয়া ও সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে সবাইকে ওয়াকিবহাল করার মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ দায়িত্ব পালন করা হয়েছে এমন ভাব প্রকাশ ছাড়া আর কোনও কাজ আজ পর্যন্ত ‘টাক্সফোর্স’ করেনি৷
যেখানে সবার আগে প্রয়োজন ছিল অসাধু ব্যবসায়ী ফড়ে বা দালালদের গ্রেপ্তার করে, সকল কালোবাজারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার মতো আবশ্যিক কাজটা করে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা৷ সেখানে লোক দেখানো কাজ করার ফলে অসাধু ব্যবসায়ী ও কালোবাজারীরা বহাল তবিয়তে নিজেদের কাজ করে যেতে পারছে৷ তাদের গায়ে এতো টুকু আঁচড়ও লাগছে না৷ আর লাগবেই বা কি করে? এই ‘ টাস্কফোর্সের মাথায় যিনি বসে আছেন তিনি নিজেই কলকাতার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো পাইকারি মার্কেটের মালিক৷ তিনি তার আশ্রয়ে থাকা ফড়ে , দালাল কিংবা এজেন্টদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেবেন? অথবা জেলে পুরে দেবেন? এমন আশা বোধ হয় আমাদের না করাই ভালো৷ কারণ এটা হবে দিবা স্বপ্ণ৷ সোনার পাথরবাটির মতো৷ কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো ব্যাপার ৷ যা কিনা শুনতে ভালো লাগে বেশ৷ কিন্তু বাস্তবে তা কখন্ সম্ভব হয় না৷ হতে পারে না৷ সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে কি করে সেই সর্ষে দিয়ে ভূত ছাড়াবে আমাদের ওঝা?
আজ দেশের মানুষের আর্থিক অবস্থা যে জায়গায় পৌঁছেছে তাতে সবার আগে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ মানুষকে বেঁচে থাকার জন্যে ন্যূনতম প্রয়োজনের জিনিষপত্র কেনার সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা করাই সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ হওয়া উচিত৷ এইরকম লাগামছাড়া দামবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রনে একদিকে যেমন অসাধু ব্যবসায়ী, কালোবাজারিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া দরকার৷ তেমনি দরকার খাদ্যদ্রব্যের রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করা কিংবা সকল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেওয়া৷ এই ব্যবস্থা চালু করলেই ফড়েদের জুলুম, দালালদের দাদাগিরি বন্ধ হবে৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ চাইলেই সরকার কর্ণপাত করবে কেন? আসলে ফড়েদের , দালালদের রাজত্ব খতম হলে৷ কালোবাজারিদের রমরমা বন্ধ হলে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ও তাঁদের পরিচিত জনদের কোষাগারে টান পড়তে পারে৷ তাই হয়ত সরকারি হুকুম জারি হয় না মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে৷
- Log in to post comments