দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও লোকপাল নিয়োগ

জনগণের সেবার জন্যেই রাজনীতি৷ আর তত্ত্বগতভাবে  গণতন্ত্র মানেও  সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে ব্যবস্থায় জনগণের দ্বারা,  জনগণের  জন্যে, জনগণের  সরকার  তৈরী হয়৷  সে অবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের  অবশ্যই  কঠোর নীতিবাদী সেবাব্রতী হতে হবে, সমস্ত  দুর্নীতি ও শোষণের  বিরুদ্ধে তাঁদের  আপোষহীন সংগ্রাম  চালিয়ে  যেতে হবে৷ এই কারণেই  সবাই গণতন্ত্রকে সমর্থন করে৷

কিন্তু, বাস্তবে  কী হয়৷ স্বাধীনতার  পর থেকে  স্বাধীন ভারতে  যতগুলি সরকার  ক্ষমতাসীন  হয়েছে, সবার বিরুদ্ধেই  ভুরি ভুরি-দুর্নীতির  অভিযোগ উঠেছে৷ নেতা-মন্ত্রী-আমলারা সবার বিরুদ্ধেই দুর্নীতির  অভিযোগ৷

রক্ষকই যদি ভক্ষক হয়,  তাহলে জনগণকে  কে রক্ষা করবে?  প্রাক্তন এক  প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, জনসাধারণের উন্নয়নকল্পে সরকার যদি একটাকা বরাদ্দ করে  তার মাত্র ১৬ পয়সা  জনগণের কাছে পৌঁছে৷  বাকি সব নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের পেটে চলে যায়৷ এ অবস্থায় দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের  দাবী সমস্ত  নীতিবাদী মানুষের  কাছ থেকে৷

২০১১ সালে আন্না হাজারে  দিল্লির রামলীলা ময়দানে  দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের লক্ষ্যে  মূলতঃ লোকপাল  বিলের  দাবীতে  আমরণ অনশনে বসেছিলেন৷ শাসকদল, বিরোধী দল, সুপ্রিমকোর্ট প্রভৃতির  দ্বারা মিলিতভাবে  এই লোকপাল  নিযুক্ত হবেন৷ এই লোকপাল শাসকগোষ্ঠীর  প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত  দুর্নীতির  অভিযোগ  উঠবে  তার  তদন্ত  ও বিচারে মুখ্য ভূমিকা  নিতে  পারবে৷  প্রধানমন্ত্রীর  বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ  উঠলেও তিনি  তার বিচার  করতে  পারবেন৷ অনুরূপভাবে  রাজ্যেও ‘লোকায়ুক্ত’ নিয়োগের  দাবীও রেখেছিলেন আন্না হাজারে৷

আজ থেকে সাত  বছর আগে  যখন তিনি  লোকপালের দাবীতে অনশন  আন্দোলন শুরু করেছিলেন,  তখন  কেন্দ্রে  কংগ্রেস পরিচালিত ইয়ূপিএ. সরকার  ক্ষমতায় ছিল৷ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন  মনমোহন সিং৷  স্বাভাবিকভাবে  আন্না হাজারের আন্দোলনে কংগ্রেস দারুণভাবে  বিব্রত হয়ে পড়েছিল৷ সে সময় নিজেদের  দুর্নীতিবিরোধীর  ভাবমূর্ত্তি তৈরী করতে বিজেপি, সি.পি.এম  প্রভৃতি  সমস্ত বিরোধী দলই  আন্না হাজারেকে  জোরদার  সমর্থনে  নেমেছিল৷ বর্তমানে দিল্লির  আপ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী কেজরীওয়াল, কিরণবেদী প্রভৃতি  তখন আন্না হাজারের  দক্ষিণাহস্ত  ছিল৷

আন্না হাজারের এই আন্দোলনের পর তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার লোকপাল বিলের খসড়া প্রস্তুত করার জন্যে  কমিশন গড়ার  দাবীও মেনে নিয়েছিল৷ তারপর কংগ্রেস সরকারও কিছু  করেনি, পরবর্তীকালে  বিজেপি  সরকার  এসেও  বিশেষ কিছু করেনি৷ কেজরীওয়াল তো প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে নেমে কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল দিল্লির শাসন ক্ষমতা  অধিকার  করেছেন৷ কিন্তু তারপরে তো কেজরীওয়ালের  সরকারের মন্ত্রী আমলাদের বিরুদ্ধে বহু দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে৷

আন্না হাজারের দাবীগুলিকে বাস্তবায়িত করার পথে  আর কেউই এগোয়নি৷  বিজেপি নেতারা  সেদিন  আন্না হাজারের দাবীগুলিকে  পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন, কিন্তু ক্ষমতায় এসে কেন  সেই দাবীগুলিকে বাস্তবায়িত করতে আর আগ্রহ দেখাচ্ছেন না? কেজরীওয়ালও এখন ‘লোকাযুক্ত’ নিয়োগের পথে অগ্রসর  হচ্ছেন না কেন?

আসলে বোঝা যাচ্ছে, দুর্নীতিতে  সবাই ডুবে আছেন৷  তাই দুর্নীতি  দমনে লোকপাল বা লোকাযুক্ত নিয়োগ ও তাদের মাধ্যেেম  প্রশাসনে  দুর্নীতি নির্মূল করতে কেউই আর চাইছেন না৷

তাই এখন আন্না হাজারে আবার যখন একই দাবীতে দিল্লির-রামলীলা ময়দানে   অনশন আন্দোলন  নেমেছেন, এখন কিন্তু বিজেপি তাঁকে  সমর্থন করছে না, শুধু বিজেপি  কেন,  কোনো রাজনৈতিক দলই এখন আর কোনও উচ্চবাচ্য করছেন না৷

লক্ষ্যণীয়  মিডিয়ারাও এবার প্রথম দিন দায়াসারাভাবে  একটু  সংবাদ পরিবেশন করে, পরে চুপচাপ৷ কারণ কী?

বর্তমান সংবাদপত্র,  দূরদর্শন প্রভৃতি  প্রায়  সমস্ত মাস-মিডিয়াই পঁুজিপতিদের  কবলিত৷ শোষক পঁুজিপতিগোষ্ঠী কখনই দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন চায় না৷  কারণ এই রন্ধ্রপথেই  তো  তারা  তাদের  শোষণের  রথ গড়গড়িয়ে চালিয়ে যায়৷ তাই  আন্না হাজারেকে  এবার কেউই সমর্থন জানাচ্ছে না৷

আসলে প্রচলিত গণতন্ত্রে অজস্র ফাঁক-ফোকর  রয়েছে, আর মধ্য দিয়ে  দুর্নীতিবাজ ও শোষকরা অবাধ দুর্নীতি ও শোষণ চালিয়ে যেতে পারে৷ এই ব্যবস্থায় যেমন জনগণ অর্থনৈতিক  গণতন্ত্রও লাভ করতে পারে না, তেমনি কঠোরভাবে  নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত মানুষও জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্র্বচিত হওয়ার সুযোগ পায় না৷ কারণ  এই  ব্যবস্থায় নির্বাচনে জিততে হলে বিশাল  অর্থবল ও পেশীবল দরকার৷ এই পরিস্থিতিতে কঠোর নীতিবাদী মানুষের পক্ষে এই বিশাল অর্থবল ও পেশীবলের সহায়তা পাওয়া সম্ভবই নয়৷