আজ সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি জালের মত বিছিয়ে রয়েছে৷ প্রকৃতপক্ষে আজকের সমাজে বোধ করি সবচেয়ে বড় সমস্যা এই দুর্নীতির সমস্যা৷ ১৯১২ সালে দিল্লীর রামলীলা ময়দানে দেশব্যাপী দুর্নীতি দমনের দাবীতে আন্না হাজারে অনশন শুরু করেছিলেন৷ তিনি সংসদে লোকপাল বিল পাশের দাবী তুলেছিলেন৷ যাতে করে কেন্দ্র ও রাজ্যসরকারের ক্ষমতাসীন নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে৷ সারা দেশ জুড়ে এই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল৷ আন্না হাজারের এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংঘটক ছিলেন কেজরিওয়াল৷ তাদের এই আন্দোলন সারা দেশ জুড়ে জনগণে বিপুল আশার সঞ্চার করেছিল৷
তাই কেজরিওয়াল যখন দিল্লীতে সরকার গড়ে দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলবার কথা ঘোষণা করলেন, তখন দিল্লির সর্বস্তরের মানুষ কেজরিওয়ালকে সমর্থন করেছিলেন৷ কেননা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন সবাইকারই কাম্য৷
তাই ২০১৩ সালে কেজরিওয়াল একেবারে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে দিল্লির শাসনক্ষমতা দখল করেন৷ সারা দেশ জুড়ে মানুষ দু-হাত তুলে তাঁকে আশীর্বাদ করতে থাকেন৷ এটা কেজরিওয়ালের অসামান্য ক্ষমতার পরিচয় বলে সবাই বলতে শুরু করেন৷ কেজরিওয়াল ও তার একান্ত সমর্থকরা স্বপ্ণ দেখেন, সারা দেশে কেজরিওয়ালের ‘আম আদমি পার্টি’ ক্ষমতায় আসাটা এখন কেবল সময়ের ব্যবধান৷
কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে মানুষের সমস্ত আশায় জল ঢেলে কেজরিওয়াল সরকারের নানান দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ পেতে থাকে৷ প্রকাশ পেল, কেজরিওয়ালের মন্ত্রীসভার আইন মন্ত্রী জিতেন্দ্র তোমর শিক্ষাগত জাল সার্টিফিকেট ব্যবহার করেছেন৷ এই অভিযোগে তাঁকে জেল হেফাজতে যেতে হয়৷ তারপর জনগণের দেওয়া ৫২৬ কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া নিয়েও নানান কেলেঙ্কারী ফাঁস হয়৷ তার পর একাধিক বিধায়ককে দুটি লাভজনক পদে বসানোরও অভিযোগ ওঠে কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে৷ এমনিতে এক এক জন বিধায়ক বেতন ও ভাতা মিলে পান মাসে ৮৪ হাজার টাকা৷ তার ওপরও নানানভাবে কোষাগার থেকে অর্থ তছরূপের ঘটনার কথা প্রকাশ পায় সংবাদপত্রে৷ এমনি নানান দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে কেজরিওয়ালের ‘আপ’ সরকার৷ সর্বশেষে প্রাপ্ত সংবাদ, কেজরিওয়াল মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য কপিল মিশ্র অভিযোগ এনেছেন , মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল নিজে জনৈক পঁুজিপতি সত্যেন্দ্র জৈনের কাছ থেকে ২ কোটি টাকা ঘুষ নিতে দেখেছেন, স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এর পরিবর্তে তাঁকে কোনো ব্যবসায়িক সুবিধা চাইলে দেওয়ার জন্যে ৷ এই নিয়ে হৈ হৈ পড়ে গেছে৷
এমনিভাবে দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসনের জন্যে জনগণ যে বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে কেজরিওয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলেন তা চরম হতাশায় পরিণত হয়েছে৷
এর আগে, কেন্দ্রে তখন ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসীন৷ তখন প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির ঘুঘুর বাসা ভাঙবার জন্যে জয়প্রকাশ নারায়ণ দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন দেশজুড়ে সেই উত্তাল আন্দোলন মুকাবিলা করতে ইন্দিরা গান্ধিকে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে হয় ও তার পরবর্তী পর্র্যয়ে ইন্দিরা গান্ধিকে হটে যেতে হয়৷ কেন্দ্রে তখন সেই প্রথম জয় প্রকাশের আশীর্বাদ ধন্য অকংগ্রেসী জনতা সরকার তৈরী হয়েছিল৷ দেশবাসীর মনে দেশজুড়ে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের বিশাল প্রত্যাশা জেগেছিল৷ কিন্তু , অচিরে সেই জনতা সরকার ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়৷ জনগণের আশাও সেই সঙ্গে ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়৷ এমনিভাবে বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে মানুষের মনে আশা জাগিয়ে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় আসছে৷ কিন্তু অচিরেই সব আশা হতাশায় পরিণত হচ্ছে৷
কিন্তু কেন? সেটা বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার৷ যুগান্তকারী প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার বলেছেন, রাজনৈতিক নেতারা বত্তৃণতার তুবড়ি ফাটিয়ে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ করতে পারবেন না৷ এজন্যে চাই জনমনের পরিবর্তন, এজন্যে চাই ব্যাপকভাবে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা৷ তাছাড়া, বর্তমান পঁুজিবাদী সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোটাই দুর্নীতির জন্মদাতা৷ এই ব্যবস্থায় রাজনীতিটা সেবার জন্যে নয়, ক্ষমতা দখলের জন্যে, আর প্রকৃতপক্ষে পঁুজিপতিগোষ্ঠী বর্তমান প্রশাসনের নিয়ন্তা৷ ‘নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজীগরে’৷ এ ঠিক তেমনি৷ পঁুজিপতি দক্ষ বাজীগরেরাই রাজনীতি পুতুল খেলার আসল নিয়ন্ত্রক৷ আর নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে গেলেও এখন যে কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন হয় তা সরবরাহ করে এই পঁুজিপতি গোষ্ঠী৷ এই সুবাদে প্রশাসনের ওপর তাঁরা পুরো নিয়ন্ত্রণ কায়েম থাকে৷
এটা লক্ষ্যণীয় একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নির্বাচন করতে হলেও তাঁর অনেক শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অন্যান্য যোগ্যতা দেখা হয়৷ কিন্তু বর্তমানে একজন জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্যে সেরকম কোনো যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না৷ যদি প্রকৃত শিক্ষিত, সমাজ সচেতন ও কঠোর নীতিবাদী মানুষের কেবল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার থাকত তাহলে পরিস্থিতির অনেকটা পরিবর্তন হত৷ আদর্শ শাসনব্যবস্থা চাইলে নির্বাচক মন্ডলীরও নির্বাচক হওয়ার নূন্যতম যোগ্যতা থাকাটা জরুরী৷
কিন্তু প্রচলিত গণতন্ত্রের জয়ঢাকের শব্দে সত্য চাপা পড়ে যাচ্ছে৷ তাই সত্যিকারের দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ চাইলে এ ব্যাপারে গভীর চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে, প্রচলিত ব্যবস্থায় দুর্নীতিরাজকে হটানো প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব৷ চাই সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন৷
- Log in to post comments