দূষিত রাজনীতি

সাংসদ কেডিসিংকে নিয়ে অনেক রহস্য ধীরে ধীরে উদ্ঘাটিত হচ্ছে ও বর্তমান রাজনীতির কুৎসিৎ চেহারাটাও ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে৷ প্রথমে নারদা ষ্টিং অপারেশন মারফৎ জনসাধারণ দেখল, কীভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা অবৈধ ভাবে লেনদেন হচ্ছে, যাতে বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতারা জড়িত৷ তারপরআবার বিস্ময়ের সঙ্গে সাংবাদিক ম্যাথু স্যামুয়েলের স্বীকারোক্তি শোনা গেল, সে যে দলের নেতাদের দুর্নীতি তুলে ধরতে চায় সেই দলেরই এক সাংসদের কাছ থেকে সে ৮০ লক্ষ টাকা নিয়ে ওই ষ্টিং অপারেশনে ব্যবহার করেছে৷ জিনিসটা ধাধাঁর মতই মনে হল ! রাজনীতিতে তবে সবই চলে ! এরপর রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগও তদন্তে নেমে পড়ল তদন্তে এই পর্যন্ত যা ধরা পড়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে রহস্যের এখানেই শেষ নয়, বোধহয় শুরু এখনও অনেক কিছু চমকপ্রদ রহস্য আছে৷ বিরাট রহস্য উপন্যাস!! কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সত্যিই বিষধর সাপের দেখা মিলছে সারদার মত কে ডি সিংও আর এক চিট ফাণ্ড (চিটিং ফাণ্ড) অ্যালকেমিষ্টের মালিক৷ এই চিট ফাণ্ডে নানান আকর্ষণীয় প্রলোভন দেখিয়ে জনসাধারণের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হচ্ছে৷ রাজনৈতিক নেতাদের সামনে রেখে আমানতকারীদের কাছ থেকে যেমন মোটা টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে তেমনি আইন ও প্রশাসনের হাত থেকে বাঁচতে কেডিসিং আমানতকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত বিপুল অঙ্কের টাকার একটা বড় অংশ খরচ করেছে রাজনৈতিক দলের পেছনে৷ রাজনৈতিক দলের প্রচারের নির্বাচনী প্রচারে টাকা ঢালা, নেতা-নেত্রীদের বিমান যাত্রা, তাদের হাসপাতালের খরচ---সব ব্যাপারেই দরাজ হস্তে কোটি কোটি টাকা খরচ করত সে জনগণকে ঠকিয়ে, তাদের টাকা নিয়ে তারা রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ীর বিয়ে, অন্নপ্রাশন প্রভৃতি অনুষ্ঠানেও দেদার টাকা ঢালত৷

জনগণের কাছ থেকে লুটের টাকায় এইভাবে পুঁজিপতিদের হাত ঘুরে রাজনৈতিক নেতারা দেদার বিলাস ব্যসন চালায়৷

পুঁজিপতিদের সঙ্গে এইভাবে অবৈধ যোগসাজসের ফলে আজকের গণতন্ত্রে নির্বাচনটাই প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এতে প্রকৃত জনমত যাচাই হচ্ছে না, জনগণকে চমক দিয়ে---তাদের বিভ্রান্ত করে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে অবৈধভাবে তাদের ব্যালট পেপার লুণ্ঠন করা হচ্ছে৷ নগদ টাকা দিয়ে মাদকদ্রব্য খাইয়ে সস্তা সেণ্টিমেণ্টে তাদের বিমূঢ় করে গণতন্ত্রকে গুণ্ডাতন্ত্রে বা শঠতন্ত্রে পরিণত করা হচ্ছে৷

এটা যে এক বিশেষ কোন দল করছে তা নয়, সমস্ত বড় বড় রাজনৈতিক দলের এই একই চেহারা৷ নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজীগরে৷ পুঁজিপতিরা সেই দক্ষ বাজীগর আর বড় বড় রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা হলেন বাজীগরের হাতের পুতুল৷ কেন্দ্র থেকে রাজ্য---সমস্ত নির্বাচনে এখন শুধুই টাকার খেলা৷ কোটি কোটি টাকার হরির লুট আর এই হরির লুটের বিপুল পরিমাণ টাকা পুঁজিপতিরা ছাড়া দেবেই বা কে? তাই নেতা-নেত্রী ও মন্ত্রী-পারিষদদের লাফালাফির পেছনে রাশ ধরা থাকে ধনকুবেরদের হাতেই৷

তাই তো স্বাধীনতার পর ৭০ বছর পার হয়ে গেল, এখন উচ্চবিত্তদের বিপুল আর্থিক উন্নতি ঘটলেও দেশের অর্থনীতির রথটাকে যারা মূলতঃ টেনে নিয়ে চলেছে, যারা খাদ্য উৎপাদন করছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন করছে সেই চাষী ও শ্রমিকরা যেই আঁধারে ছিল সেই আঁধারেই আছে৷ তাই প্রায়ই শোণা যাচ্ছে ঋণের দায়ে আলুচাষী, ধানচাষী, বাদামচাষী বা অন্যান্য চাষী বা শ্রমিক, মজদুররা আত্মহত্যা করছে৷ দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনের নূ্যনতম চাহিদা পূরণের গ্যারাণ্টি দেওয়া যেখানে কল্যাণমূলক সমাজব্যবস্থার প্রাথমিক কর্তব্য, সেটাই এখন দূর অস্ত্৷ শুধু উচ্চবিত্তরা সাইনিং ইণ্ডিয়ার রঙিন বেলুন ওড়াচ্ছেন, আর শাসক দলের নেতানেত্রীরা তাই দেখে মহানন্দে গদীর সুখ উপভোগ করছেন৷

রাজনীতির পেছনে পুঁজিপতিদের টাকার ভেল্কির কারণে রাজনীতি আজ কেবল ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতাতে পরিণত হয়েছে সেবার ভাবনা পুরোপুরি উধাও৷

রাজনীতিতে ক্ষমতার নেশা ও পুঁজিপতিদের অবৈধ হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে এই রাজনীতি দিয়ে সমাজের প্রকৃত কল্যাণ হতে পারে না৷ পুঁজিপতিদের প্রভাব মুক্ত সেবাব্রতী, ত্যাগী, নেতানেত্রীরাই একমাত্র পারবে রাজনীতিকে আজকের এই সর্বগ্রাসী দূষণ থেকে মুক্ত করে একে প্রকৃত জনসেবা-নীতিতে পরিণত করতে৷