দূষণ-দানব

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

সাম্প্রতিক খবর, রাজধানী দিল্লি এখন দূষণ-দানবের কবলে৷ বাতাসে ধূলিকণা, ধোঁয়া ও ক্ষতিকর গ্যাসের আধিক্য এতবেশি যে জনস্বাস্থ্যের বিপদ ডেকে আনছে৷ সরকার সুকল বন্ধ রেখেছেন৷ কারণ ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পক্ষে বাইরের এই ধূলা-ধোঁয়া মিশ্রিত হাওয়া নানান্ ব্যাধির কারণ হচ্ছে৷ সকালে প্রাতঃ ভ্রমণ বন্ধ হয়ে গেছে বয়স্কদের৷ ধোঁয়াশার (অর্র্থৎ ধোঁয়া ও ধূলার মিশ্রণ) আস্তরণে এমনভাবে আবহাওয়া দূষিত হয়ে গেছে যে  সকাল-সন্ধ্যায় শ্বাসের সঙ্গে প্রচন্ড বিষ প্রবেশ করছে ফুসফুসে৷

প্রকৃতির বুকে ছুরি চালিয়ে অতি-নগরায়ণের অবিসংবাদিত কুফলগুলি  একে একে  পরিস্ফুট হচ্ছে৷ এই মূলতঃ এই কারণেই আবহাওয়া দূষিত হয়ে উঠছে ও মানুষের জীবনধারণের পক্ষে বিষময় হয়ে উঠছে৷

এখন কোথায় দূষণ নেই? দূষণ তো প্রায় সর্বত্রই৷ যে গঙ্গাজলকে সর্বকলুষনাশী বলা হয়, সে গঙ্গাজলে বেপরোয়াভাবে কলকারখানার বর্জ্যপদার্থ, মানুষের দেহের বর্জ্য সহ সমস্ত রকমের নোংরা ও পচা দ্রব্যসামগ্রী ফেলে আমরা পবিত্র গঙ্গাজলকে অপবিত্র করে দিয়েছি , সব নদীজলকেই এভাবে দূষণযুক্ত করে তুলেছি৷

আজ দিল্লির আবহাওয়া অস্বাভাবিকভাবে দূষিত হয়ে উঠেছে, এবার কলকাতারও পালা আসছে৷ যেখানেই অতিনগরায়ণ হয়েছে৷ সেখানে বিপদ ঘনিয়ে আসছে৷

আমাদের প্রতিদিনকার খাদ্যতেও নিজেদের ব্যষ্টিগত লাভের জন্যে নানান্ ভেজাল মিশিয়ে চলেছি৷  বাধ্য হয়ে তাই আমাদের খেতে হচ্ছে৷ নিত্যদিনের শব্জি, মসলা ও মিষ্টিতে নানান্ ক্ষতিকর রঙ মিশিয়ে আমরা খাদ্যকে অখাদ্য করে তুলেছি৷ দেশজুড়ে দুর্নীতি৷ দুর্নীতিটাই এখন দেশের   কিন্তু মূল সমস্যা৷ এই সমস্যা সবকিছুর মূলে নিহিত থেকে অজস্র সমস্যার শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি করছে৷ আমরা আমাদের কর্তব্য ভুলে  কেবল লোভদানবের  দ্বারা প্রেষিত হয়ে নিজেদের লাভের জন্যে সইচ্ছা তাই করছি, সমাজকে ধবংসের পথে নিয়ে যাচ্ছি৷ আসলে আমরা আমাদের নিজেদের  হিত-অহিত বোধটাই হারিয়ে ফেলেছি৷ নিজেই নিজের পায়ে কুড়ুল  মারছি৷ এটাই তো দূষণের গোড়া৷

আমরা কেবল  আমাদের  বাহ্যিক  হিতটাই---বাহ্যিক আরাম ও সুখটাই দেখি৷ আমরা আমাদের নিজেদের মনের ভেতরটারও খোঁজ রাখি না৷

শরীর, মন ও আত্মা--- এ তিন  নিয়েই আমাদের সত্তা৷ এ তিনের  মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা  করতে হবে৷ দৈহিক হিতের সঙ্গে মানসিক ও আত্মিক হিতসাধনও  জরুরী তারজন্যে উপযুক্ত মানসিক, নৈতিক তথা আত্মিক শিক্ষার আবশ্যকতা বুঝতে হবে বৈকি৷

এই বিশ্বের বিভিন্নতার মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হবে৷ মাটি-জল-বাতাস, দেহ-মন-আত্মা, কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য, মানুষ-তরুলতা ও আরণ্যক প্রাণী এই সবকিছুর  মধ্যে ত্র্যম্বক সামঞ্জস্য বিধান করেই আমাদের জীবন ও জগৎকে সুন্দর করার সাধনায়  ব্রতী হতে হবে৷ না হলে আমরা ধবংসের পথে  এগিয়ে যাব৷ প্রাউট-প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর ‘প্রমা’ তত্ত্বের মধ্যে এই কথাটাই বলেছেন৷ তিনি বলেছেন, ‘‘ব্যষ্টি ও সমষ্টি দেহের কল্যাণ সাধনায় এমনভাবে কাজ করতে  হবে যাতে শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক তথা স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ---এই তিনের  মধ্যেই একটা সুসামঞ্জস্য থাকে’’৷

আমরা তা করিনা৷ এটাই সমস্ত সমস্যার মূলীভূত কারণ৷ সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে আমরা  একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলি, সামগ্রিক অখন্ড ভাব না নিয়ে খন্ডভাব নিয়ে--- ক্ষুদ্রভাব নিয়ে চলি--- তাই আমরা নিজেদের স্থূল স্বার্থসিদ্ধির নেশায় মত্ত হয়ে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের কথা চিন্তা করি না, তা যদি করি, তাহলে দেখব, সমস্যা আসবে, কিন্তু সব সমস্যার মেঘ ধীরে ধীরে কেটে যাবে৷ উজ্বল দূষণমুক্ত নীলাকাশ আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে৷