‘‘ধ্যানের আলোয় বসিয়ে দোব করবো নোতুন ধরা রচনা’’

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

আগামী ১৪ই সেপ্ঢেম্বর,২০১৮ প্রভাত সঙ্গীতের আবির্ভাবের ৩৬ বৎসর পূর্ণ হতে চলেছে৷ এর মধ্যে প্রভাত সঙ্গীতের বিপুল জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কেননা, প্রভাত সঙ্গীতের  যে প্রতিযোগিতা  হচ্ছে তাতে  হাজার  হাজার  মানুষ--- আবাল-বৃদ্ধবণিতা  অংশগ্রহণ  করছেন৷  পঃবঙ্গ, ত্রিপুরা, অসম, ঝাড়খন্ড---বিভিন্ন রাজ্য থেকেই  প্রতিযোগীরা  আসছেন৷  তাছাড়া বর্হিভারতে  বিভিন্ন  দেশেও প্রভাত সঙ্গীতের  চর্র্চ  হচ্ছে৷  প্রভাত সঙ্গীতও কেবল  বাংলা  ভাষায় নয়, অঙ্গিকা, মৈথিলী, ভোজপুরী, অবধি, হিন্দী, উর্দু, ইংরেজী প্রভৃতি  বিভিন্ন ভাষায় রয়েছে৷

এই ‘প্রভাত সঙ্গীত ’বলতে  প্রভাতকালে  গাইবার জন্যে  রচিত  সঙ্গীত  নয়,  জীবনের  অন্ধকার  ঘুচিয়ে  প্রভাত-এর সূচনা করার সঙ্গীত৷ আমরা  তো  বেশির ভাগ মানুষ  অন্ধকারে হাতড়ে চলেছি৷  জীবনের  প্রকৃত লক্ষ্য  কী?  কর্তব্য কী?  কীভাবে  সমাজে  প্রকৃত  শান্তি   আসবে? কীভাবে সমাজ যথার্থ প্রগতির  পথে  এগিয়ে  চলবে? --- এ সম্পর্কে  কোনো  সুষ্পষ্ট ধারণাই আমাদের নেই৷ আর  এই কারণেই অজস্র ভয়ঙ্কর জটিল সমস্যা মানুষের প্রগতি  পথকে  রুদ্ধ করে দিয়েছে৷ মানুষ সবাই  মিলে  মিশে সমস্ত  বাধার  প্রাচীর  সরিয়ে  প্রগতির  পথে  এগিয়ে  চলার  পরিবর্তে  পারস্পরিক  হানাহানি, শোষণ, দুর্নীতি, খুন, আত্মহননে মেতে রয়েছে৷

বলা বাহুল্য, এই সবই  জীবনের  ঘন অন্ধকার৷ আর এই অন্ধকারের  অবসান ঘটিয়ে  প্রভাতের অরুণ আলোর পথের  সন্ধানই দিচ্ছে  প্রভাত সঙ্গীত৷ তাই বলছে ---

‘‘মনকে  কোন ছোট কাজেই 

নাবতে দোব না,

ধ্যানের আলোয় বসিয়ে দোব,

করব নোতুন ধরা রচনা৷ (প্রভাত সঙ্গীত নং-১৬৩)

 মানুষের  জীবনের  দুটো  দিক৷  একটা তার আত্মগত দিক, আর একটা তার  সমাজগত দিক৷ মানুষকে  একই  সঙ্গে  আত্মবিকাশের সাধনা করে যেতে  হবে, সঙ্গে সঙ্গে  জগতের কল্যাণ  সাধন  করে যেতে হবে, মানুষের  দুঃখ-কান্না ঘুচিয়ে তারমুখে  হাসি ফুটিয়ে তুলতে হবে৷  এটাই  মানবজীবনের আদর্শ হওয়া উচিত৷ এই  আদর্শবোধের  অভাব হলেই  জীবনে ও  সমাজে  অন্ধকার  নেমে আসে৷  এ কথাই  এই প্রভাত  সঙ্গীতে  সুস্পষ্টভাবে  বলা হচ্ছে৷

আজকাল  অনেকেই  জগৎকল্যাণব্রতের  কথা স্বীকার  করেন কিন্তু  আত্মবিকাশের  জন্যে  সাধনার  উপযোগিতা  স্বীকার  করেন না৷ কিন্তু  প্রভাত সঙ্গীত  আত্মবিকাশের  ওপরই সবচেয়ে  বেশি গুরুত্ব দিয়েছে৷ কারণ জীবনে  আত্মবিকাশের সাধনা  না  থাকলে --- আধ্যাত্মিক বিকাশ  না হলে  মনের  শুভচেতনার  প্রকাশ ঘটবে না --- জগতের  প্রতি নিঃস্বার্থ প্রেমের  ভাবই  জাগবে না, পরিবর্তে ‘আত্মসুখতত্ত্বে’র   ভাবই  প্রবল  হয়ে উঠবে৷ এই অবস্থায়  নৈতিক  অধোগতির  সম্ভাবনা  প্রবলভাবে  থেকে  যায়৷  তাই  প্রভাত সঙ্গীতে  বলা হচ্ছে  ‘শুভ  চেতনায় প্রীতি  দ্যোতনায় এসেছিলে  তুমি  প্রিয়  আমার  ঘরে’৷ বলা হয়েছে৷ ‘সুমুখের পানে চলে যাব আমি তোমার নামটি সাথে নিয়ে৷ চরণ  টলিবে নাগো  আমার হিয়া  কাঁপিবে না কারো ভয়ে’’৷

প্রভাত সঙ্গীতে  মানুষকে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানানো  হয়েছে---

‘‘মানুষ মানুষ হারায়ে  হুঁশ কোথাও চলেছ তুমি---

আকাশ  বাতাস বিষিয়ে দিয়ে  নরক  করে মর্ত্ত্যভূমি৷৷’

বলা হয়েছে, সমাজকে কুসংস্কার , অন্ধবিশ্বাস  ও ডগ্মার বন্ধন  থেকে মুক্ত  করে তাকে  বিশ্বৈকতাবাদে  প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷

‘‘মানব সমাজ অবিভাজ্য জয়গান গাই তার আজিকে৷

এগিয়ে চলো ভাই-বোনেরা  তুচ্ছ করে সব কাঁটাকে৷

সকল মানুষ আমার ভাই সবাই আমার প্রাণ

সবাই  যদি সঙ্গে থাকে  থাকেন ভগবান

খাঁটি  সোনায়  মুড়তে পারি-মাটির এ ধরাকে৷   (প্রঃসঃ ৮৮০)

প্রভাত সঙ্গীত শিক্ষা দিচ্ছে, সমস্ত  মানুষকে  সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে, ক্ষুধার  অন্ন-জল মিলে মিশে  ভাগ করে খেতে হবে,  সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে  নেচে গেয়ে জীবনের পরমলক্ষ্যের  পানে এগিয়ে চলতে হবে৷ ১০৯০ সংখ্যক প্রভাত সঙ্গীতে তো  এই কথাটাই  বলা হচ্ছে---

‘‘মানুষ  সবাই  আপন

একই মর্মে গাঁথা

সবাকার হিয়া

সবাকার একই আয়োজন৷৷’’

আর এই যে  সবাইকে  সঙ্গে  নিয়ে  হাতে হাতে  ধরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে  এগিয়ে  চলার  আদর্শ একটাই  ‘প্রাউট’ দর্শনের  প্রবক্তা মহান্  দার্শনিক তথা  প্রভাত সঙ্গীতের রচয়িতার পরম শ্রদ্ধেয়  শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের  আদর্শ৷ এই আদর্শই যথার্থ ‘মানব সমাজ’ রচনার আদর্শ৷ এই  আদর্শ প্রতিষ্ঠার  জন্যে  বিশ্বের  সকল  মানুষের  জন্যেই তাঁর  উদাত্ত আহ্বান---

‘‘আমি ডাক দিয়ে যাই যাহ,.......

আলোকের পথ ধরে যারা যেতে চায়

তাহাদের চিনে নিতে চাই৷’’