এই কি স্বাধীনতা

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

ভারতের স্বাধীনতার পর ৭০ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল৷ কিন্তু আজও ভারতের অধিকাংশ মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি৷ স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে মুষ্টিমেয় মানুষ৷ সম্প্রতি রাষ্ট্রসংঘের ‘ফুড ইনসিকিউরিটি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’–এ প্রকাশ, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুধার্ত দেশ এই ভারত৷ এখানে ১৯.৪ কোটি মানুষ পেট ভরে খেতে পায় না৷ অর্ধাহার, অনাহারে তাদের জীবন কাটাতে হয়৷

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারেরই এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে দেশের অন্ততঃ ১৭ লক্ষ ৭৩ হাজার মানুষের শীতে–গ্রীষ্মে মাথা গুঁজবার একটা ঘর নেই৷ এদের থাকতে হয় ফুটপাতে, ব্রীজের তলায়, রেল ষ্টেশনে৷

ব্রিটিশের শাসন ও শোষণ থেকে দেশবাসী মুক্ত হয়েছে বটে কিন্তু তাদের স্থান দখল করেছে এদেশের একশ্রেণীর মানুষ৷ কি রাজনৈতিক ভাবে, কি অর্থনৈতিক ভাবে, কি সাংসৃক্তিক ভাবে দেশবাসী আজও পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করেনি৷

আর পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করেনি বলেই আজও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার গ্যারাণ্ঢী নেই৷ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদমন ও শোষণ অব্যাহত৷ কোথাও এই অবদমন ও শোষণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, কোথাও ভাষার ক্ষেত্রে, কোথাও বা অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রেও৷

যেমন ভারতের স্বাধীনতার জন্যে যে বাঙালী জাতি সবচেয়ে বেশী ত্যাগ করেছে, সবচেয়ে বেশী রক্ত দিয়েছে, সেই বাঙালী জাতিই সবচেয়ে বেশী বঞ্চিত, নির্যাতীত৷

হাজার হাজার বাঙালী আজ স্বাধীনতার বলি হয়ে তাদের পুরুষানুক্রমিক ভিটেবাড়ী, জমিজায়গা ছেড়ে ছিন্নমূল, উদ্বাস্তু হয়ে অতি কষ্টে বাঁচার জন্যে লড়াই করে চলেছে৷ অসমে সম্প্রতি লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে ‘ডি ভোটার’ বানিয়ে ওখানকার সরকার তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে৷ লক্ষ লক্ষ বাঙালী যারা নিজভূমে পরবাসী হয়ে – বাঙালীর নিজস্ব বাসভূমি রূপে পরিচিত এলাকায় বাসিন্দা হয়েও শোষকশ্রেণীর চক্রান্তে বাঙলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝাড়খণ্ড, অসম, ওড়িশা, বিহার, ত্রিপুরাতে রয়েছে, তারা বাঙালী হওয়ার সুবাদেই  নানাভাবে বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে৷ যে মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমান–সেই মাতৃভাষা শিক্ষা থেকেও তারা বঞ্চিত৷ তাদের মনে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ণ জাগে–তারা এ কী ধরণের স্বাধীনতা লাভ করল? কেন তাঁরা নিজভূমে পরবাসী?

তাছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শুধু বাঙালীরা বলব কেন, ভারতের সব রাজ্যের অধিকাংশ জনসাধারণ আজ চরম শোষণ ও বঞ্চনার শিকার৷ ভারতের নাকি অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, অন্ততঃ কেন্দ্রীয় সরকারের তো তাই প্রচার৷ তবে কেন কোটি কোটি মানুষের পেটে অন্ন নেই, মাথা গুঁজবার ঘরটুকু পায়না ১৭ লক্ষের বেশী মানুষ, কোটি কোটি মানুষ তাদের রোগের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত৷ শিক্ষার আলো থেকেও বঞ্চিত, তাই তো মনে প্রশ্ণ জাগে এ স্বাধীনতা কাদের জন্যে স্বাধীনতা? কেন এত দারিদ্র্য, কেন এত সমস্যা? সরকার দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের জন্যে, বেকার সমস্যার সমাধানের জন্যে বিদেশী পুঁজির জন্যে দরজা খুলে দিয়েছে৷ বিদেশী পুঁজিপতিদের এদেশে এসে পুঁজি বিনিয়োগের জন্যে ক্রমাগত অনুরোধ করে যাচ্ছেন৷ প্রধানমন্ত্রী থেকে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন দেশে দেশে ভ্রমণ করে ওই সমস্ত দেশের পুঁজিপতিদের এদেশে ব্যবসা–বাণিজ্য করার জন্যে–এদেশে শিল্প গড়ার জন্যে আবেদন জানাচ্ছেন৷

আমরা ভুলে গেছি ব্রিটিশ ইষ্ট–ইণ্ডিয়া কোম্পানী প্রথমে এদেশে কেবল ব্যবসা করার সুযোগ পেয়েছিল৷ পরবর্তীকালে ‘বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে৷’ তারাই এদেশকে দু’শ বছর শাসন ও শোষণ করে দেশকে ছিবড়ে বানিয়ে ছেড়েছে৷ তাদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্যে কত দধীচি (শহীদ) হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছেন৷ আবার আমরা তাদেরই আমন্ত্রণ জানিয়ে কি ‘খাল কেটে কুমীর ডেকে আনছি না?’

নেতারা হয়তো বলবেন, এছাড়া উপায় নেই৷ ভুল কথা৷ পুঁজিবাদের মোহে আমরা অন্ধ হয়ে গেছি৷

মহান দার্শনিক প্রাউট–প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার নিজেদের শক্তিতে দেশের এক একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে স্বয়ম্ভর করে তুলতে, প্রতিটি মানুষের জীবনের নূ্যনতম চাহিদা পূরণ করে ধাপে ধাপে তার অর্থনৈতিক মানোন্নয়নের জন্যে অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের আদর্শ তুলে ধরছেন৷ ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনা, সুসন্তুলিত অর্থনীতি, স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার বাস্তব পথেরও নির্দেশনা দিয়েছেন৷ তিনি সমস্ত অর্থনৈতিক উদ্যোগকে (কৃষি শিল্প, বাণিজ্য) তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন৷ তিনি বলেছেন, মূল শিল্পগুলিকে –যার ওপর অন্যান্য সমস্ত শিল্প নির্ভরশীল সেগুলিকে স্থানীয় সরকারের দ্বারা পরিচালনা করতে হবে৷ ক্ষুদ্র–ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক উদ্যোগ বা কুটির শিল্পগুলিকে ব্যষ্টিগত মালিকানায় রেখে বাকি সমস্ত শিল্পকে সমবায়ের (যৌথ মালিাকানা) মাধ্যমে পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছেন৷

তিনি দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংসৃক্তিক ও মানসাধ্যাত্মিক বিকাশের এক সুচিন্তিত ও পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা তাঁর ‘প্রাউট’ দর্শনের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন৷

দেশের যথার্থ সর্বাত্মক স্বাধীনতার সূর্যোদয় ঘটানোর জন্যে এই প্রাউটই একমাত্র পথ৷ তাই দেশের প্রকৃত স্বাধীনতাকামী মানুষদের বলব, প্রাউটকে জানুন৷ প্রাউটকে বাস্তবায়িত করার মহান কর্মযজ্ঞে সামিল হোন৷