এসো হে বৈশাখ

লেখক
রীণা চট্টোপাধ্যায়

কালের পরিক্রমায় আসছে নববর্ষ, আসছে পয়লা বৈশাখ৷ শুভ নববর্ষ ১৪২২৷ বিদায়ী বছরের বিষাদঘন অনুভূতি থাক, ‘মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক’, প্রাণের পয়লা বৈশাখ৷ নববর্ষের প্রথম প্রভাতে সূর্যের অনাবিল রশ্মি ছড়িয়ে পড়বে শ্যামল বাংলার স্নিগ্ধ বুকে, পাখির কলকাকলিতে উদ্ভাসিত হব নতুন সকাল, আনন্দে উদ্বেলিত হবে পশ্চিম বাংলা, ঝাড়খন্ড, ত্রিপুরা, অসম সহ দেশের বিভিন্ন অংশের বাংলাভাষী৷

বাংলা নববর্ষ বাঙালীর আবহমান সংসৃক্তির উত্তরাধিকার৷ নববর্ষের সূচনা দিবস পয়লা বৈশাখের প্রাণের আবেগ৷ পয়লা বৈশাখে ধর্মমত, বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সর্বস্তরের মানুষ মেতে উঠে আবহমান লোকসংসৃক্তির ঐতিহ্যময় বর্ষবরণ উৎসবে৷ ভোরের ঘুমভাঙা চোখে সজীব প্রাণে নববর্ষকে বরণের জন্যে চারদিকে কী মনোজ্ঞ, কী আন্তরিক আয়োজন হয়৷ পয়লা বৈশাখের নির্মল ভোরে মৃদুমন্দ দক্ষিণা হাওয়ায় সূর্যের কোমল আলোকছটায় রমনা বটমূলে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ আবহনীসুরের মূর্ছনা বসন্ত বাতাসে ভাসতে ভাসতে ঝংকার তোলে সমগ্র দেশময় – ‘হে নতুন এলো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি/পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে...৷’

পয়লা বৈশাখে পুরনো হিসাব চুকিয়ে খোলা হয় নতুন বছরের হালখাতা৷ জীবনের সজীব বৃক্ষ থেকে খসে পড়া হলুদ পাতার মতো একটি বছরের বিদায়ে যত না ভারাক্রান্ত হয় হূদয়, তার চেয়ে ঢের স্বপ্ণে বিমোহিত হয় মানব জীবন পাওয়া না পাওয়া, সাফল্য– ব্যর্থতা, স্বপ্ণভঙ্গের দুঃখ ভূলে নববর্ষের আগমনে আবার নতুন স্বপ্ণ দেখা৷ নতুন সম্ভাবনায়, নতুন প্রত্যাশায় নতুন বছরের পথচলা শুরু হয় আমাদের৷

পয়লা বৈশাখ শুধু নববর্ষে শুভ সূচনার দিন নয়, আমাদের জাতিসত্তা, আমাদের স্বাতন্ত্র্য, আমাদের ভাষা, সংসৃক্তি ও ঐতিহ্যের স্মারক পয়লা বৈশাখ৷ তাই পয়লা বৈশাখে বাংলাভাষী মানুষ আপন শেকড়ের সন্ধানে উদ্বেলিত হয়, উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে৷ নতুন প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে উঠি আমরা৷ পয়লা বৈশাখের হালখাতা বা বৈশাখী মেলা শুধু নয়, পয়লা ফাল্গুনে বসন্ত উৎসব, ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী, ১১ জ্যৈষ্ঠ নজরুল জয়ন্তী, পৌষ মেলা, অগ্রহায়ণের নবান্ন, চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবকে ঘিরে আজও বাংলা সাল আপন মহিমায় মহিমান্বিত৷

বাংলা ভাষী মানুষের গতানুগতিক জীবন যাপনের মধ্যে নোতুন সুর–ছন্দের নাম পহেলা বৈশাখ৷ তাই নববর্ষ, পয়লা বৈশাখ ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে ব্যর্থ প্রাণের আার্বজনা পুড়িয়ে ফেলে নতুন সংকল্পে উজ্জীবিত হওয়ার দিন৷ তাই তো নববর্ষের প্রথম প্রভাতে কোটি মানুষের বীণায় গীত হয়, ‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক’৷ নতুন বছর সততই আনন্দের৷ সর্বজনীন উৎসবের এই দিনটির জন্যে আমাদের বছর ভর অপেক্ষা৷ ঘরে ঘরে আয়োজন৷ আমাদের অর্থনৈতিক ও ব্যবহারিক আচার – অনুষ্ঠান, কর্মক্রিয়া প্রভৃতি বিষয়ে ইংরেজি মাস তারিখ অনুসৃত হলেও,  বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাভাষীরা ইংরেজী নববর্ষ ঘটা করে উদযাপন করে না৷ বাংলা সন বঙ্গাব্দ, সারা বছর শহরে জীবনে অবহেলিত থাকলেও গণ জীবনে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি একটু আলাদা৷ গৎবাঁধা জীবনের অন্য দিনের চেয়ে ভিন্ন একদিন, অন্যরকম অনুভূতিতে উদ্বেলিত৷

 বাঙালির জীবনে পয়লা বৈশাখ আসে সাড়ম্বরে৷ কিন্তু নিঃশব্দ পরিক্রমার মধ্যে বিদায় নিতে হয় বঙ্গাব্দকে৷ শহুরে দৈনন্দিন জীবন – জীবিকায় সারা বছর বাংলা মাস ও তারিখের খুব একটা খোঁজ না পড়লেও গ্রামবাংলায় বিশেষ করে কৃষিকাজে বঙ্গাব্দের গুরুত্ব  এখনও অপরিসীম৷ চাষাবাদের পাশাপাশি গ্রামীণ সমাজ জীবনে এখনও আপন মহিমায় বিরাজ করছে বঙ্গবর্ষ৷ মোগল সম্রাট আকবরের আমলে আমাদের দেশে ফসলি সাল হিসেবে পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হয়েছিল বঙ্গাব্দ গণনা৷ সেই ফসলি সালের পয়লা বৈশাখ এখন বাঙালির জাতীয় জীবনে আনন্দঘন একটি দিন হিসেবে পালিত হচ্ছে৷

পয়লা বৈশাখে মাঠের কর্ষক, কারখানার শ্রমিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কলমজীবী সাংবাদিক, কবি – সাহিত্যিক আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আমলা সবাই, মাস বেতনের কেরানি থেকে রাজনীতিক, শ্রমজীবী নারী থেকে গৃহবধূ সবার একটাই প্রত্যাশা থাকে .... নববর্ষ শুভ হোক, নিজের জন্যে, নিজ পরিবারের জন্যে হোক মঙ্গলময়৷ দেশ ও দশের জন্যে কল্যাণকর হোক ১৪২৫   বঙ্গাব্দ৷ সেই প্রত্যাশায় পয়লা বৈশাখে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সুন্দর ও কল্যাণের জয়গানে আমরা স্বাগত জানাই ১৪২৫ বঙ্গাব্দকে৷

‘ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখির ঝড়, তোরা জয়ধ্বনি কর’– নতুনের কেতন উড়িয়ে আসে নববর্ষ, আসে সৃষ্টি সুখের উল্লাস নিয়ে৷

তাই তো নববর্ষের ভোর, ভোরের আলো এত স্নিগ্ধ, এত জ্যোতির্ময়৷ নববর্ষের প্রভাতে ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে গেয়ে ওঠে প্রাণ – ‘সব তর্ক হোক শেষ/ সব রাগ, সব দ্বেষ. সকল বালাই’৷