গোরক্ষা, গণপ্রহার ও নব্যমানবতাবাদ

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

বেশ কিছুদিন যাবৎ  সংবাদ মাধ্যমগুলিতে  প্রকাশিত সংবাদের বৃহদংশই জুড়ে থাকে গোরক্ষার নামে  স্বঘোষিত গোরক্ষক বাহিনীর  তাণ্ডবে গণপিটুনির সংবাদ৷  গোমাংস রাখার  বা বহন করার অপরাধে, গবাদি পশু পাচারের ভুয়ো অভিযোগে একসঙ্গে অনেক লোক জড়ো হয়ে গণপিটুনির দ্বারা হত্যার ঘটনা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ লক্ষ্যনীয় যে, ২০১৫ সাল থেকে  এই ধরণের পৈশাচিক কাণ্ড লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে৷  ২০১৫ সালেই উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে  বাড়ির ফ্রিজে গোমাংস রাখার অপরাধে (যদিও এর কোন প্রমাণ  পাওয়া যায় নি) মহম্মদ আখলাখকে পিটিয়ে মারা হয়৷  ট্রেনে ভ্রমণকারী এক কিশোরের ব্যাগে গোমাংস আছে, এই অজুহাতে তার উপর গণপিটুনি চলে৷  গত বছর এপ্রিলে রাজস্থানের অলওয়াড়ে গো-পাচারের অভিযোগে  পহেলু খানকে পিটিয়ে হত্যা করে স্বঘোষিত গো-রক্ষকের দল৷  সেই অলওয়ারেই  অতি সম্প্রতি  গত ২০শে জুলাই  ২০১৮, শুক্রবার রাতে আকবর খান ও আসলাম খান নামে দুই যুবক গোরু পাচারকারী সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়৷ প্রকৃতপক্ষে আকবর ও আসলাম (হরিয়াণার কোলগাঁও গ্রামের বাসিন্দা)  দুটি গোরু কিনে ফিরছিলেন৷ রাত ১২টা নাগাদ অলওয়ারের রামগড়ের লালাওয়ান্ডি গ্রামে  তারা কয়েকজন দুষৃকতীর দ্বারা আক্রান্ত হন৷  কিল, চর, লাঠি, বাঁশের আঘাতে প্রায় মুমুর্ষূ আকবর খান মৃত্যুকালীন জবানবন্দীতে  এই ঘটনার কথা পুলিশকে জানান৷  এইভাবে বিভিন্ন অজুহাতে  ভুয়ো সংবাদের কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গণপিটুনিতে নিরীহ নিরপরাধ মানুষজনকে  আক্রান্ত হতে হচ্ছে৷ কখনো গোমাংস রাখা বা বহন, কখনো গোরু পাচার, কখনো ছেলেধরা গুজবে বা  নারী পাচারের অভিযোগে গণপ্রহারের ঘটনা ঘটেই চলেছে৷ গণরোষ, গণপ্রহার ইত্যাদির দোহাই দিয়ে  মানুষ হত্যার মতন মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত হলেও প্রকৃত দোষীকে চিহ্ণিত বা শাস্তি দান সম্ভব হচ্ছে না৷  জনগণের চোখে ধূলো দেওয়ার জন্যে দু একটি ক্ষেত্রে  ১/২ জনের গ্রেফতারী দেখালেও  উত্তেজনা কমে যেতেই তাঁরা জামিনে খালাস হয়ে যাচ্ছে৷ পরে আর সেই কেসের বিশেষ নাড়া চাড়া হচ্ছে না৷

এই গোরক্ষার নামে গণপিটুনির ঘটনার বিষয় সংসদেও উত্থাপিত হয়েছে৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই ঘটনাক্রম নিয়ন্ত্রণের দায়  রাজ্যগুলির উপরেই চাপিয়েছেন৷ যদিও ১৭ই জুলাই ২০১৮ তারিখে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপকমিশ্রের বেঞ্চের রায় অনুযায়ী--- গণপ্রহারকে পৃথক আইনী অপরাধের  তকমা দিয়ে  তারজন্য শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে ও  এই মর্মে সংসদে বিশেষ আইন আনতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে৷ এই বিশেষ আইন  এইধরণের কাজে জড়িয়ে পড়া মানুষের  মনে ভয় ঢোকাবে৷ এছাড়া  রাজ্যগুলিতে  প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপারকে  নোডাল অফিসার  নিয়োগ করে --- স্পেশ্যাল টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে৷  পুলিশ সুপার ও ডি.জি. পর্যায়ের নিয়মিত বৈঠক করে  পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে হবে৷ সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যারা  বিদ্বেষপূর্ণ প্রচার চালাচ্ছে,  তাদের চিহ্ণিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে৷  দায়িত্ব পালনে  ব্যর্থ পুলিশদের বিরুদ্ধে  বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে৷  গণপিটুনির ঘটনায়  দ্রুত অভিযোগ দায়ের ও অভিযোগকারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে৷  গণপিটুনির ঘটনায় ধৃতদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করতে হবে৷ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের  অভিমত---‘‘এই ভয়ঙ্কর ভিড়তন্ত্রকে  কোনোভাবেই ছাড়পত্র দেওয়া যায় না৷ গণপ্রহার, গণহিংসা ক্রমশঃ টায়ফনের মত গ্রীক দৈত্যে পরিণত হতে পারে৷ কখনও  ভূয়ো খবর, কখনও অসহিষ্ণুতায় প্ররোচিত  উন্মত্ত জনতার হিংসার ঢেউ থেকে তা স্পষ্ট হয়ে যায়৷’’

দেশের বিভিন্ন স্থানে এই ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে  আমরা দেখতে পাই,---কোথাও গোরক্ষা-গোমাংসের কারণে, কোথাও ছেলেধরার গুজব, কোথাও কোন পৌরাণিক দেবদেবীর নামে  সিনেমার চরিত্র চিত্রায়ণকে কেন্দ্র করে, কোন সিনেমার চরিত্রের সঙ্গে  তথাকথিত কোনো নারী-পুরুষের জাতিগত সম্মান-অসম্মান আবার কোথাও পারিবারিক মান মর্যাদা রক্ষার খাতিরে  দাঙ্গা হাঙ্গামা বাধানোর সুপরিকল্পিত  প্রয়াস চলছে৷ এইসব হিংসা, অশান্তি ,সন্ত্রাসের বলি হচ্ছে বিশেষ কিছু সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠী৷ ঘটনাগুলির আরো গভীরে প্রবেশ করলে জানা যায়--- এসবের পিছনে রয়েছে  ধর্মীয় মেরুকরণে  রাজনৈতিক দলাদলির ইন্ধন ও প্ররোচনা আবার কখনও দলীয় স্বার্থসিদ্ধি, কখনও উপদলীয় বা নিছক ব্যষ্টিস্বার্থ চরিতার্থ করার হীন চক্রান্ত৷ যত গণ্ডগোল হাঙ্গামার মূলে থাকে ব্যষ্টিসংঘাত, বিদ্বেষ, গোষ্ঠী-সম্প্রদায়গত ভেদভাবনা অসহিষ্ণুতা৷ আর এগুলোকেই গুজব ছড়ানোর রসদ হিসাবে ব্যবহার করা হয়৷ আগেকার দিনে লোকের মুখে মুখে গুজব ছড়াতো, কিন্তু  বর্তমানে ফেসবুক , হোয়াটসএ্যাপ, ইন্টারনেটের মাধ্যমে মোবাইলে মোবাইলে অতি অল্পসময়ে বহু মানুষের কাছে যে কোনো গুজবের বার্র্ত দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া হয়৷ সাম্প্রতিক কালে বিভিন্নগোষ্ঠীদ্বন্দ ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাার বহু ঘটনা এইভাবেই সংঘটিত হয়েছে৷ কোনো এলাকায় কোন কাজে কর্মে আসা অপরিচিত মানুষের (নারী অথবা পুরুষ) বিরুদ্ধে ভূয়ো অভিযোগ তুলে  গণপ্রহার চলছে৷ বৈধ কাগজপত্রাদি সহ  গবাদি পশু নিয়ে যাওয়ার সময়ে বা মৃত পশুর সৎকারের সময়ে অযাচিত সন্ত্রাসের শিকার হতে হয়৷ আক্রান্ত ব্যষ্টিদের আগমনের কারণ, প্রমাণপত্র বা পরিচিতি জানার চেষ্টা না করে স্বঘোষিত আইনরক্ষক  বা গোরক্ষকেরা যূথবদ্ধ আক্রমণ ঘটিয়ে ফেলে৷ অনেক সময়  ব্যষ্টিগত বা পারিবারিক আক্রোশের কারণেও চুরি বা ছেলেধরা বা ডাইনির ভূয়ো সংবাদ রটিয়ে আক্রমণ চালানো হয়৷ যদি সত্য সত্যই কেউ কোনো অপরাধ জনিত কর্মে লিপ্ত থাকে--- সেক্ষেত্রে আইন নিজেদের হাতে তুলে না নিয়ে প্রশাসনকে জানালে,  তারা সত্যমিথ্যা যাচাই করে যথাযোগ্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে৷ এরফলে নিরপরাধ মানুষের আক্রান্ত বা নিহত হওয়ার মতো ঘটনা অনেকটাই কমবে৷ কিন্তু চোরা না শুণে ধর্ম কাহিনী, কারণ তাঁদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে রাজনৈতিক, দলীয় উপদলীয় বা ব্যষ্টিগত প্রচার ও হীণস্বার্থসিদ্ধি৷  এই ঘটনাক্রম বর্তমানে চলছে, অতীতেও চলেছে, আর যতদিন না শুভশক্তির জাগরণ ঘটছে  ততদিন ভবিষ্যতেও চলবে৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৮২ সালের ৩০শে এপ্রিল  এরকমই একটি নারকীয় ঘটনা ঘটেছিল খাস কলকাতার কসবা-বন্ডেলগেট-বিজনসেতু অঞ্চলে৷ আধ্যাত্মিক সংঘটন আনন্দমার্গের প্রচার প্রসারে শঙ্কিত হয়ে জড়বাদী কম্যুনিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরে আনন্দমার্গের সর্বত্যাগী জনকল্যাণকামী সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীদের নামে ছেলেধরার গুজব রটিয়ে  পরিকল্পনা মাফিক কয়েকশত মাতাল নৃশংস নরঘাতককে সংঘবদ্ধ করে  সেইদিন কল্লোলিনী কলকাতাকে চির কলঙ্কিত করে ১৭জন সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীকে বাঁশ, রড , ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে, চোখ খুবলে, পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছিল---যাঁদের অনেকেই জীবন্ত দগ্দ হয়েছিলেন৷  মানব কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ সর্বত্যাগীদের উপর  এইধরণের পৈশাচিক হত্যালীলা মানব ইতিহাসে বিরল৷ পরবর্তীকালে তদন্তে জানা গিয়েছিল, সেই অঞ্চলে  সেই সময়কালে কোন শিশুচুরির ঘটনা ঘটেনি--- সবই ছিল উর্বর মস্তিষ্কের রটনা৷ 

বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিশেষতঃ গোরক্ষার নাম যে গণপ্রহারজনিত সন্ত্রাস চলছে, তার কারণে  সাধারণ নাগরিকবর্গ ব্যথিত ও ক্ষুদ্ধ৷  এই ক্ষোভের আঁচ সংসদেও লেগেছে৷ বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি সংসদে এই বিষয়ে দুশ্চিন্তা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহদোয়কে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানিয়েছেন৷ বিভিন্ন মামলার শুনানির সময়ে এই মর্মে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিগণও কেন্দ্র তথা  রাজ্যসরকারগুলিকে সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দিয়েছেন যাতে এই ধরণের অনাকাঙ্খিত          দুঃখজনক ঘটনা না ঘটে৷ এতকিছুর পরেও এই দেশের কতিপয় রাজনীতিক নেতা-নেত্রী ঘোষণা করেছেন--- গোমাংস খাওয়া বন্ধ হলেই গণপিটুনির ঘটনা কমে যাবে৷ এখন প্রশ্ণ হচ্ছে গোমাংস খাওয়া ঠিক কি ভুল তা ভিন্ন বিষয়---কিন্তু মানুষের খাদ্যাভ্যাস  তাঁদের জীবন জীবিকা, অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থা, ধর্মাচারণ ইত্যাদির উপর নির্ভর করে৷  কেউ জোর করে মানুষের খাদ্যাভাস চাপিয়ে দিতে পারে না৷ মানুষ নিজের প্রয়োজনে দীর্ঘদিনের অভ্যাস ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে খাদ্যবস্তু নির্বাচন করে৷ যদি  সত্যিই কেউ মনে করে যে গোমাংস খাওয়া  উচিত নয়, তখন সে নিজেই তা পরিত্যাগ করবে৷ পৃথিবীতে বহু মানুষ একদা বৃহৎ পশুর মাংস ও অন্যান্য আমিষ খাদ্য গ্রহণ করতেন, কিন্তু পরবর্তীকালে সেই অভ্যাস ত্যাগ করে পুরোপুরি নিরমিষাশী ও সাত্ত্বিক খাদ্যে অভ্যস্ত হয়েছেন৷ স্বঘোষিত গোরক্ষকদের বক্তব্য অনুযায়ী তারা যেহেতু গোরু বা গাভীকে  গোমাতা হিসাবে শ্রদ্ধা ভক্তি ও পূজো করেন তাই গোমাংস ভক্ষক বা গোহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে তারা কঠোর ও হিংস্র মনোভাব পোষণ করেন৷ অথচ এই মানুষেরাই পাঁঠা খাসী,ভেড়া, মুরগি, হাঁস, পায়রা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাণীর মাংস বা মাছ কচ্ছপ প্রভৃতি জলজপ্রাণী অবলীলায় হত্যা করে ভক্ষণ করে৷ শুধু তাই নয়, সমাজে যারা মাতৃসমা নারী জাতি তাদের অসম্মান  করতেও তারা কুণ্ঠিত হয় না৷  নারীর সম্মান আজ ভূলুণ্ঠিত, বয়স নির্বিশেষে শিশু থেকে প্রৌঢ়া বা বৃদ্ধা পর্যন্ত সকলেই  পারিবারিক হিংসা, যৌনতা ও লালসার শিকার৷ ঘরে বাইরে রাস্তাঘাটে, ট্রেনে-বাসে, অফিস-কার্যালয়ে, স্কুল-কলেজে, সর্বত্রই নারীরা অরক্ষিত, অজানা বিপদের আশঙ্কায় আতঙ্কিত৷ তাই শুধুমাত্র গোরক্ষার নামে  সন্ত্রাস বিশেষতঃ কিছু গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতি অসহিষ্ণুতা, বিদ্বেষ ও ভেদভাবনার ফসল৷  ক্ষমতাবানেরা ভোগসর্বস্ব জীবনযাত্রা ও ভৌতিক সম্পদ কুক্ষিগত করার সীমাহীন লোভের তাড়ণায় মানব সমাজকে  বিভিন্ন  গোষ্ঠী সম্প্রদায়, ধর্ম, বর্ণ, জাতের ভেদাভেদে খণ্ড-বিখণ্ড করে শোষণযন্ত্র কায়েম রাখার ব্যবস্থা করেছে৷  এই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ হিসেবে মানুষে মানুষে বিরোধ বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতার বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ৷ বৈশ্যতান্ত্রিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিচালিত সামাজিক পরিবেশে নৈতিকতার মান ক্রমশঃ তলানিতে এসে ঠেকেছে৷ আচারসর্বস্ব মেকি ধর্মান্ধতা , লোকদেখানো ধর্মীয় উন্মাদনা ও উন্মার্গগামিতা, পরধর্ম অসহিষ্ণুতা, সর্বক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংকীর্ণতার অনুপ্রবেশ প্রতি নিয়ত সামাজিক পরিমণ্ডলকে  কলুষিত করে চলেছে৷ মানুষের মনে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রেম, প্রীতি ভালভাসা ইত্যাদি শুভ গুণাবলীর পরিবর্তে হিংসাদ্বেষ, অশ্রদ্ধা, অহংকার,  ঘৃণা, লোভ লালসা, যৌনতা প্রভৃতি কু-প্রবৃত্তিগুলি বাসা বেঁধেছে৷ বিত্তশালীদের অর্থ, সম্পদ ও ক্ষমতা প্রদর্শনের দম্ভই নীতিবান, ধার্মিক,সত্যনিষ্ট মানুষজনকে শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট করে চলেছে৷ এই শোষকের দল  নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ও  সম্পদ বৃদ্ধির জন্যে যে কোনো হিংস্রতম ও অনৈতিক কাজ করতে কুণ্ঠা বোধ করে না৷  

মানব সমাজকে এই অসহনীয় যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্ত করতে  নীতিবাদী, সৎ, ধার্মিক, আধ্যাত্মিকতার পথে এগিয়ে চলা মানুষজনকেই এগিয়ে আসতে হবে৷ আধ্যাত্মিকতার পথ অনুসরণ না করলে নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়৷  বলিষ্ঠ নৈতিক চরিত্র বিশিষ্ট মানুষ  যতবেশি সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে সমাজ থেকে দুর্নীতি ও শোষণ ততই অপসৃত হতে থাকবে৷ তাই আজকের মানব সমাজের অন্ধকার ময় অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে আধ্যাত্মিকতার আলোকে  সমুজ্জ্বল নীতিনিষ্ঠ  মানুষের  সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির প্রয়োজন৷ এই উদ্দেশ্যে মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার ,যিনি  ধর্মগুরু হিসেবে শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী নামে  সর্বজনবিদিত, মানব সমাজের সর্বাত্মক কল্যাণে  ও শোষণমুক্ত মানব সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে একদিকে আধ্যাত্মিক দর্শন আনন্দমার্গ, অপরদিকে সামাজিক - অর্থনৈতিক দর্শন  ‘‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’’ Progressive  Utilisation Theory) বা সংক্ষেপে PROUT  ও নব্যমানবতাবাদ প্রবর্তন করেছেন৷ আনন্দমার্গের সাধনা পদ্ধতিতে অষ্টাঙ্গিক যোগসাধনার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষকে ব্রহ্মভাবে নিষিক্ত করে সত্যিকারের মানুষে পরিণত করার প্রক্রিয়া সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে৷  এগুলি হলো---  যোগ, আসন, প্রাণায়াম, যম, নিয়ম, ধ্যান, ধারণা ও সমাধি৷ এই সাধনা পদ্ধতিতে মানুষের মনকে ক্রমশঃ জাগতিক কামনা, বাসনা, লোভ, লালসা থেকে প্রত্যাহার করে  বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরমপুরুষের পানে এগিয়ে চলার দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে৷  আমরা জানি, পৃথিবীর জাগতিক সম্পদ সীমিত কিন্তু  মানুষের চাহিদা অনন্ত৷ কালের প্রবাহে মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্দ্ধমান আর বর্ধিত সংখ্যার মানুষের অনন্ত  চাহিদা বা তৃষ্ণাকে তৃপ্ত করার ক্ষমতা  পার্থিব  সম্পদের নেই৷ তাই প্রতিটি  মানুষকে  জীবন ধারণের জন্যে  ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু মেটানোর মতো পার্থিব সম্পদ গ্রহণ করে বাকী অতৃপ্ত তৃষ্ণাকে অনন্ত মানসিক  ও আধ্যাত্মিক জগতের প্রতি পরিচালিত করলে  তাঁর মনে আসবে প্রশান্তি ও ঈশ্বর - সান্নিধ্যের আনন্দ৷ এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, মানুষ সর্বদাই সুখ পেতে চায় অর্থাৎ যা পেলে মানুষের মনে খুশির উদ্রেক হয় তা-ই পেতে চায়৷ এই খুশির  বা সুখের পরিমাণ বাড়াতে হলে অনন্ত সত্তার দিকে এগিয়ে চলতে হবে৷  পৃথিবীর যে কোনা সম্পদ বা মানুষ বা বস্তু থেকে এই অনন্ত সুখ পাওয়া সম্ভব নয়, কারণ এইসবই একসময়ে হারিয়ে যাবে নতুবা ফুড়িয়ে যাবে৷  তাই একমাত্র অনন্ত সত্তা পরমব্রহ্মই সর্বত্র ও সদা সর্বদা বিরাজমান৷  তাই অনন্ত সুখ পেতে হলে  সেই অনন্ত অসীম অক্ষর পরমব্রহ্মকে পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে৷  আনন্দমার্গের সাধনা পদ্ধতিতে  প্রতিটি মানুষকে এই প্রক্রিয়ায়  আনন্দ (অনন্ত সুখ) পাওয়ার  মার্গের (পথের) সন্ধান দেওয়া হয়েছে৷

মানুষকে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে  ন্যূনতম প্রয়োজন খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা শিক্ষা পেতেই হবে৷ কিন্তু পার্থিব সম্পদ অনন্ত অসীম নয়৷ সীমিত পার্থিব সম্পদকে একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ভাগবন্টনের মাধ্যমে সকলে মিলে ভোগ করতে হবে যাতে সকলেরই প্রয়োজন মেটে৷ তাই এই সীমিত ভৌতিক সম্পদের সুষমবন্টনের জন্যে সত্যদ্রষ্টা মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার প্রবর্তন করেছেন প্রাউট দর্শন৷ এই দর্শন অনুসারে  পৃথিবীর  কেউই কোন পার্থিব সম্পদের মালিকানা দাবী করতে পারে না৷  কারণ ব্যষ্টিগত মালিকানা স্বীকৃত হলে  কতিপয় মানুষ সমগ্র সম্পদ নিজেদের কুক্ষিগত করে  বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে  বঞ্চিত নিপীড়িত ও শোষণ  করতে থাকবে যা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় চলছে--- আর এই ব্যবস্থা কিছুতেই কাম্য নয়৷ নচেৎ এই শোষণ অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে৷  প্রাউট দর্শন অনুসারে, একমাত্র পরমব্রহ্ম পরমপুরুষই  এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা ও বিশ্বের সমগ্র সম্পদের মালিক৷ বিশ্বের সমস্ত  সৃষ্ট জীব, জড়, উদ্ভিদ , মানুষ সকলেই  পরমপুরুষেরই সন্তান আর একই পিতার সন্তান হিসেবে  এই সম্পদ  সকলেরই মিলে মিশে ভোগ করার অধিকার রয়েছে৷  এই সম্পদের দ্বারা প্রত্যেকের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে৷ কেউ বেশি গ্রহণ করলে  অন্যেরা বঞ্চিত হবে ও শোষণের সুযোগ সৃষ্টি হবে৷  বরং ন্যূনতম প্রয়োজনকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করার জন্যে  মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশের দ্বারা  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ক্রমাগত উন্নত করতে হবে৷  এই সর্বাত্মক উন্নতির ফল সবাইকে  সুষম বন্টনের মাধ্যমে ভাগ করে দিতে হবে৷

পরমপিতার সৃষ্ট এই অনবদ্য বিশ্বসংরচনার  বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমতাভাব অর্থাৎ বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্ট সত্তাই পরমপুরুষের স্নেহের সন্তান-সন্ততি৷  জীবজন্তু, উদ্ভিদ, জড়, মানুষ সকলেই তাঁর আদরের সন্তান৷ বৌদ্ধিক ও মানসিক বিকাশের  ক্রমবিন্যাসে আজ যে জড়, কালাদিক্রমে সে ক্রমশঃ জড়ষ্ফোটের মাধ্যমে জীবে রূপান্তরিত হবে, অবিকশিত জীব উচ্চতর বিকশিত জীবে ও পরবর্তী পর্র্যয়ে মনুষ্যরূপে উন্নীত হবে৷ এইভাবে বিশ্বস্রষ্টার সৃষ্টি লীলা চলেছে অনন্তকাল ধরে৷  তাই আজকের বুদ্ধিদীপ্ত মানুষকে শুধুমাত্র মানুষের কথা ভাবলেই চলবে না , তার চারপাশে যে অনন্ত সৃষ্টি রয়েছে (ধূলিকণা থেকে অন্যান্য জীবজন্তু পর্যন্ত) সকলেই  পরমপিতার সন্তান ও সকলের প্রতিই তার সমান দায়িত্ব৷ এই ভাবনা থেকেই উদ্ভব ‘‘নব্যমানবতাবাদ’’-এর ৷ মাটি, হাওয়া, জল, উদ্ভিদ, জীবজন্তু সকলের কাছ থেকেই মানুষ ও অন্যেরা পারস্পরিক সহায়তা ও জীবনের রসদ পায়৷ তাই প্রত্যেকের কাছে প্রত্যেকের প্রয়োজন অপরিহার্য৷ সেকারণেই সকলের জন্যে আমাদের ভালবাসা প্রেমপ্রীতির ভাবনাকে সদা জাগ্রত রাখতে হবে৷ প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার পথে চললে ও ব্রহ্মভাবনায় ভাবিত হলে সমগ্র সৃষ্টির মধ্যেই পরমব্রহ্মে র উপস্থিতি অনূভূত হয় ও সকলের জন্যে আত্মীয়তার ভাবনা ও কল্যাণকামনার উদ্রেক হয়৷ এই পর্যায়ে সমগ্র মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্যরূপে আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়৷ তখন কারুর সম্পর্কে বিদ্বেষ বা বিভেদ ভাব মনে স্থান পায় না, অন্যকে বঞ্চিত করার চিন্তাও  মনে আসে না--- এখানেই নব্যমানবতাবাদের সার্থকতা৷  তাই আনন্দমার্গের সাধনা পদ্ধতিতে মানব মণীষাকে দেবত্বের মহিমায় উন্নত করে বিশ্বের প্রতিটি ধূলিকণা থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সুবিকশিত মানুষ পর্যন্ত  সকলকে ভালবাসা প্রেমপ্রীতি, মায়া-মমতার নিগড়ে বাঁধতে পারলেই নব্যমানবতাবাদের প্রতিষ্ঠা সম্ভব৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে  মানুষ মূলতঃ শাকাহারী জীব ও জীবনধারণের জন্যে অন্য কোনো পশুপাখী জীবজন্তু হত্যা করার প্রয়োজন নেই৷ প্রকৃতপক্ষে শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যে  মানুষের সাত্বিক আহার গ্রহণ করাই বিধেয়৷ এছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানও শারীরিক সুস্থতার জন্য লাল মাংস বা জন্তু জানোয়ারের মাংস ভক্ষণে নিরুৎসাহ প্রদান করে৷  তাই নব্যমানবতাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী মানুষজন প্রাণীহত্যার  সমর্থক নন৷ সুতরাং নব্যমানবতাবাদের আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে মানব সমাজকে একটি শোষণহীন হিংসা, দ্বেষ, দুর্নীতিমুক্ত মানব সমাজে পরিণত করতে হবে৷ আর তখনই বর্তমানের অন্ধকার পূতিগন্ধময় সমাজের কু-ব্যবস্থাগুলি দূরীভূত হবে৷ সেজন্যেই অতিদ্রুততার সঙ্গে পৃথিবীর সকল মানুষকে নব্যমানবতার আদর্শে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সুন্দর নোতুন পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে  এগিয়ে আসতেই হবে৷