পশ্চিমবঙ্গের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ দাজির্লিং পার্বত্য অঞ্চল৷ উত্তর সীমান্তে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র নেপাল৷ সীমান্ত পেরিয়ে কাজের ধান্দায় দলে দলে বিদেশী নেপালীরা পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-এ অনুপ্রবেশ করছে৷ পলাশীর যুদ্ধের ৩০ বছর (১৭৮৭) পর থেকে নেপালীদের দার্জিলিং এ আসা শুরু৷ ১৯৫০ সালের ভারত-নেপাল চুক্তি অনুয়ায়ী নেপালীরা ভারতে কাজ করতে পারবে ,থাকতে পারবে কিন্তু স্বাভাবিক নাগরিকত্ব পাবে না৷ স্মরণীয় অন্য দেশের নাগরিক হতে গেলে সংশ্লিষ্ট দেশের সংবিধান ও আইন-কানুনের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যে অঙ্গীকার বদ্ধ হতে হয় ও পদ্ধতিগত কিছু বিষয় অনুসরণ করতে হয়৷ কিন্তু নেপালীরা কমিউনিষ্টদের প্ররোচনায় এসব কিছুরই ধার ধারেনি৷ ওই মৈত্রী চুক্তির পর থেকে দার্জিলিং অঞ্চলের নেপালীদের অনুপ্রবেশের হার কমিউনিষ্টদের জামাই আদরে উদ্বেগ জনক ভাবে বেড়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিষ্টরা ক্ষমতায় আসার পর অনুপ্রবেশের বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিন গুণ৷ দার্জিলিং অঞ্চল তো হাজার বছর ধরে জাত-বাঙালী ‘কোচ’ বংশীয় লেপচা ভুটিয়াদের জায়গা৷ অথচ ওই বিদেশী নেপালীরা কমিউনিষ্টদের পাইয়ে দেওয়া নাগরিকত্বের জোরে ভূমিপুত্র বাঙালীদের তাড়িয়ে এখন সংখ্যা গরিষ্ঠ৷ বাঙলাতেই বাঙালী উদ্বাস্তু৷ নেপালীরা বলছে বাঙালীরা দার্জিলিং ছেড়ে চলে যাক, দার্জিলিং নেপালীদের, দার্জিলিং এ গোর্খাল্যান্ড চাই৷ তারা একটানা জঙ্গী আন্দোলন শুরু করেছে ৷ বিদেশী নেপালীদের এই দাবী কেবল অযৌক্তিক হাস্যকরই নয়, এ দাবী অসাংবিধানিক৷ এ আন্দোলন ভারতের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে জেহাদ৷ এ হল বিছিন্নতাবাদী আন্দোলন, নোতুন করে বাঙলা ভাগের চক্রান্ত৷এই পরিস্থিতিতে জাতি-বর্ণ-ধর্মমত-মতাদর্শ নির্বিশেষে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দরকার, সরকার প্রশাসনের হাতশক্ত করা দরকার৷ কিন্তু বাস্তবটা কী? কমিউনিষ্ট-কংগ্রেস-বিজেপি গোর্খাদের পক্ষ নিয়ে তাদের মদত দিয়ে যাচ্ছে৷ পিছনে ভিনরাজ্য, বিদেশী ও উত্তরপূর্র্বঞ্চলের জঙ্গী সংঘঠনগুলোর কালো হাত তো আছেই৷
কথায় আছে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়৷ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ১৯৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধকে৷ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দোল্লা তথা বাংলার দুভার্গ্যকে ৷ নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ষড়যন্ত্র করল ধূর্ত সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ৷ আর সিংহাসন, অর্থ, সুযোগ সুবিধার লোভে সিরাজের দোষ ত্রুটির অজুহাতে সেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল সেনাপতি মিরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, সঙ্গে জগৎশেঠ, উমিচাঁদ প্রমুখ দরবারের বিশিষ্টরা৷ নবাব সিরাজ ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে সকলের কাছে কাতর আবেদন করলেন মিরজাফরকে বরখাস্ত করেও পুনর্বহাল করলেন৷ তারপর পলাশীর প্রান্তরের ইতিহাস তো সকলেরই জানা৷ অবাক কান্ড! অতীত বর্তমানের ক্ষেত্রপট তো সেই একই৷ কমিউনিষ্ট-কংগ্রেস-বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দোষ ধরতে ব্যস্ত, তাঁকে অপরাধীর কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়ে বাংলা ও বাঙালীর স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে বাঙালার অখন্ডতাকে নস্যাৎ করে গোর্খাদের উস্কানী দিয়ে তাদের স্বার্থে ইন্ধন যোগাচ্ছে৷ ইতিহাসের এই মঞ্চে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে পার্থক্য এই যে ব্রিটিশের জায়গায় সম্প্রসারণবাদী দখলদারী গোর্খারা, আর মিরজাফর রায়দুর্লভ-ইয়ার লতিফ-জগৎশেঠদের ভূমিকায় কমিউনিষ্ট-কংগ্রেস-বিজেপি৷ ‘‘হিষ্ট্রি রিপিট্স্ ইটশেল্ফ্’’৷
পলাশীর যুদ্ধের ক্ষেত্রপটে আরো একটি চিত্রপটের পুনরাবৃত্তি৷ জনৈক গবেষক বলেছেন--- বিজয়ী ইংরেজ সৈন্য পদব্রজে পলাশী থেকে মুর্শিদাবাদ চলেছে সিংহাসনের দখল নিতে৷ আর গোরা সৈন্যদের দর্শন করতে রাস্তার দুধারে, গাছের ডালে, চালের মাথায় কাতারে কাতারে বাঙলার উৎসুক দর্শনার্থী৷ তারা বুঝল না, জানলও না, তাদের অর্থাৎ বাঙলা-বাঙালীর জীবনে কী ভয়ঙ্কর দুর্র্ভেগ-অভিশাপ নেমে এল৷ গবেষক বলেছেন-গোরা সৈন্যরা ভয় পেয়েছিল ---, এই বুঝি জনতা তাদের আক্রমণ করে৷ ওই জনসমুদ্র ক্ষুদ্ধ হলে তাদের কিছুই করার ছিল না৷ অস্ত্র নয়, যদি জনতা একটা ইট বা ঢিলও ছুড়ে মারত --- তাহলে সেদিনই ব্রিটিশ সূর্য উদয়েই অস্তমিত হোত৷ তেমনই আপাময় বাঙালীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ প্রতিরোধের ঢেউ যদি দার্জিলিং এ আছড়ে পড়ত তাহলে গোর্খাদের গোর্র্খ্যল্যান্ডের দাবী তোলার স্পর্র্ধ কর্পূরের মতো উবে যেত৷ কাকস্য পরিবেদনা৷ সেই একই চিত্র৷ গৃহস্থ, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-যুব, ধার্মিক, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ---সমগ্র বাঙালীর চেতনা-মননই ওই গোরা দর্শনার্থীদের মতোই গোর্খাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী অন্দোলনে বিস্ময়কর ভাবে নীরব৷ গোর্খাদের দাবী অন্যায়, অযৌক্তিক ৷ সবচেয়ে বড় কথা---নেপালীরা বাঙলার বুকে ছুরি বসাচ্ছে , খোদ বাঙলাতেই বাঙালীকে গৃহহারা করেছে৷ হায় সিরাজ ! বাঙালীর কোনো বিকার নেই৷ ওই বিকারহীন সম্বিতহীন বাঙালীর এতে কিছুই এসে যায় আসে না৷ ১৯৫৭ সালের গোরাদের দর্শনার্থী বাঙালীদের পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ে, মৃত্যুতে কিছু যায় আসেনি৷ গড্ডালিকা স্রোতে ভেসে যায় ধন-মান-জন৷ ইতিহাসের কী নিষ্ঠুর পরিহাস পর্র্যবৃত্তি!!!
- Log in to post comments