ইসলামপুরের দারিভিট হাইস্কুলের শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে তুমুল গণ্ডোগোল হ’ল৷ এর জেরে দুই জন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেল৷ স্কুলের সমস্ত আসবাবপত্র ভাঙ্গচূর যেন দক্ষযজ্ঞ হয়ে গেল৷
এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করছে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই হিংসাত্মক কার্যের পেছনে বিজেপি ও আরএসএস-এর হাত আছে বলে দাবী করছেন৷ স্থানীয় মানুষ সহ বিজেপি বলছে পুলিশই গুলি চালিয়ে দু’জন ছাত্রের মৃত্যু ঘটিয়েছে৷ কংগ্রেস ও বামফ্রণ্টও পুলিশের দিকেই অঙ্গুলী নির্দেশ করছে৷ শাসক পক্ষ ঘটনার উচ্চপর্যায়ের পুলিশী তদন্ত করা হবে জানিয়েছে৷ বিরোধীদের বক্তব্য, অভিযোগের তীর যেখানে পুলিশের বিরুদ্ধে, আর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যেখানে পুলিশকে ক্লিনচিট দিয়েছেন, সেখানে পুলিশী তদন্ত অর্থহীন৷ বিজেপি সিবিআইয়ের তদন্ত চায়৷ কেউবা বিচার বিভাগীয় তদন্ত চায়৷ বিশেষ করে কে বা কারা গুলি চালিয়ে দু’জন ছাত্রকে হত্যা করল---এই গণ্ডোগোলের প্রকৃত কারণ কি---সবাই এই সত্য উদ্ঘাটন করার কথাই বলছেন৷
রাজনীতিতে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ করাটাই স্বাভাবিক৷ প্রকৃত দোষীরাও নিজেদের দোষ স্বীকার না করে অপরপক্ষের ঘাড়ে সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিতে চায়৷
কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্রহত্যা নিঃসন্দেহে এটা একটা জঘন্য অপরাধ৷ নিরপেক্ষ তদন্তেরমাধ্যমে এই সত্য উদ্ঘাটন হোক, প্রতিক্ষেত্রে দোষীরা দৃষ্টান্তমূলক শান্তি পাক৷ এ দাবী সকলের সঙ্গে মিলিতভাবে আমাদেরও৷
কিন্তু একটা জিনিস যেটা সর্ববাদীসম্মত, যে সত্যকে তদন্ত করে উদ্ঘাটন করার প্রয়োজন নেই, যে সত্য স্বতই উদ্ঘাটিত তা হ’ল---এই জঘন্য ছাত্র হত্যার মূল কারণ কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতি৷
শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি যে এই চরম দুঃখজনক ঘটনা---এই কথাটা কেউ জোর গলায় বলছেন না কেন? ইদানিং কালে শিক্ষাক্ষেত্রে যে ব্যাপক হিংসা, মারামারি, অভব্যতা---এসবের মূল কারণই তো শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির অনুপ্রবেশ---এটা তো অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই৷ এর ফলে শিক্ষাক্ষেত্রের পবিত্রতাই নষ্ট হচ্ছে৷ বিদ্যাশিক্ষার নামে চরম নোংরামী চলছে৷
এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে পড়াশোণার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে৷ জ্ঞানার্জন এক ধরণের তপস্যা৷ তাই শিক্ষাক্ষেত্রগুলিতে তপোবনের মত শান্ত পরিবেশ থাকাই বাঞ্ছনীয়৷
কলেজের ইয়ূনিয়ন নিয়ে যে কী নোংরা দলীয় রাজনীতিকদের কুস্তির আখড়া হয় তা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়৷ তাছাড়া সুকল কলেজের সিলেবাস ঠিক করা, শিক্ষক নিয়োগ, পরীক্ষা ইত্যাদি যাবতীয় শিক্ষা ও ছাত্র সম্পর্কিত কাজকর্মের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলির সংযোগ থাকা তো একেবারেই উচিত নয়৷ এ ব্যাপারটা শিক্ষাবিদদের দ্বারা তৈরী বোর্ডই দেখবে৷ সরকারের এ ব্যাপারে নাক গলানো একেবারেই অনুচিত৷ বাজেট অনুসারে শিক্ষাক্ষেত্রের বরাদ্দ টাকা মঞ্জুর করাটুকুই সরকারের কাজ৷ শিক্ষার নীতি নির্ধারণ পদ্ধতিগত বিষয়গুলির মধ্যে রাজনীতিকরা কেন নাক গলাবেন? কিন্তু না, রাজনৈতিক নেতারা সুকল-কলেজের ওপর তাঁদের দখল কায়েম রাখতে চান৷ নিজ নিজ সঙ্কীর্ণ স্বার্থ রক্ষার জন্যেই তাঁরা এটা করতে চান৷ এটা বন্ধ করতেই হবে৷ বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক লড়াইকে কেন্দ্র করেই যত গণ্ডগোল হচ্ছে৷
তাই আজ দলমত নির্বিশেষে সমস্ত শিক্ষিত ও সমাজহিতৈষী মানুষের উচিত শিক্ষাক্ষেত্রকে দলীয় রাজনীতির কুপ্রভাব থেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হওয়া৷ সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে কেবল অর্থবরাদ্দ করা ছাড়া শিক্ষার নীতি নির্ধারণ, পাঠ্যবিষয় নিরূপণ, পঠন-পাঠন, পরীক্ষা, শিক্ষক নিয়োগ---এ সম্পর্কীয় যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ প্রকৃত নিরপেক্ষ শিক্ষাবিদদের দ্বারা তৈরী বোর্ডের হাতেই ছেড়ে দিতে বাধ্য থাকবেন৷
তাহলেই দেশের শিক্ষার মান দ্রুত বৃদ্ধি পাবে৷ এটা ভুললে চলবে না৷ শিক্ষাই মানব সমাজের মেরুদণ্ড৷ মনুষ্যেতর জীবজন্তুর কোন শিক্ষার প্রয়োজন হয় না৷ তারা প্রকৃতিদত্ত স্বাভাবের দ্বারাই পরিচালিত হয়৷ কিন্তু মানব শিশুর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন৷ শিশুটি যেমন শিক্ষা পাবে তার জীবনধারা তেমনই হবে৷ তাই উন্নত শিক্ষা ছাড়া ভাল মানুষ তৈরী হবে না৷ আর ভাল মানুষ তৈরী না হলে সমাজটাই নষ্ট হয়ে যাবে৷ সমাজের চরম অধঃপতন ঘটবে৷ বর্তমান সমাজে যে নৈতিক তথা মূল্যবোধের অধঃপতন দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটিটাই এর মূল কারণ৷ তাই সমাজকে যদি সুন্দর করতে হয়, মানব সভ্যতাকে যদি বাঁচাতে হয়---তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থাটা যাতে নিষ্কলুষ ও উন্নত হয় সর্বতোভাবে তার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে৷ আর সে কারণে দলীয় রাজনীতির হানাহানি থেকে শিক্ষাক্ষেত্রগুলোকে মুক্ত রাখতে সকলকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে৷ এই সদিচ্ছাটুকু সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে সমাজ আশা করলে এটা কি খুব ভুল হবে?
- Log in to post comments