কেন্দ্রীয় সরকার ১৯১৮-১৯ এর জন্যে দেশের আয়-ব্যয় মাত্রিকা (বাজেট) পেশ করেছেন৷ এই বাজেটে গ্রাম ও কৃষির উন্নতির অনেক প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবে গরীব ও খেটে খাওয়া মানুষ, দরিদ্র কর্ষকদের জীবনের মান যে বৃদ্ধি পাবে তার কোনও নিশ্চিততা নেই৷ এমনি লম্বা চওড়া প্রতিশ্রুতি প্রতিটি সরকারই বাজেট প্রকাশের সময় করে থাকে৷ কিন্তু কার্যতঃ দেখা যায়, ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, গরীবরা রাশি রাশি বঞ্চনার শিকার হচ্ছে৷ বিশাল বিশাল অঙ্কের পরিসংখ্যান তুলে ধরে তাদের বোঝানোর প্রাণপণ চেষ্টা চলে যে দেশ এগিয়ে চলেছে, গরীব মানুষের গরীবী দূর হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি৷ কিন্তু প্রকৃতই যারা গরীব মানুষ, তারা দেখছে তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাচ্ছে৷ গরীব চাষী ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করছে৷ কেউবা খাদ্যাভাবে অনশনে বা অর্ধাশনে শুকিয়ে যাচ্ছে তারপর মৃত্যুবরণ করছে৷ খাদ্যাভাবে মৃত্যু না রোগভোগে মৃত্যু এ নিয়ে রাজনীতিকরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন৷ গরীবরা অভাবের তাড়নায় তাদের নিজেদের ছেলে মেয়েদের বিক্রি করে দিচ্ছে৷ তাদের দুঃখকষ্টের সীমা-পরিসীমা নেই৷ অন্যদিকে প্রতি বছরই ধনীদের সম্পত্তির পরিমান হু হু করে বেড়ে চলেছে৷
সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করছেন, আমাদের জাতীয় আয় (জিডিপি) নাকি উধর্বমুখী৷ আমেরিকার মত পুঁজিপতি দেশের প্রধান ও ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রশংসা করেছে! আমরা তাই সন্তুষ্ট!
কিন্তু বাস্তবের চিত্র যে অন্যরূপ ! সরকার যে জিডিপি বৃদ্ধি নিয়ে ঢাক পেটাচ্ছেন, সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম (ডব্লিউ-ই-এফ) জানাচ্ছে জিডিপির হিসেবটা প্রকৃতপক্ষে দেশের সার্বিক মনোনয়নের মাপকাঠি নয়৷ জিডিপি-তে যে দেশের আয়বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে, এই লাভের গুড়টা তো দেশের পুঁজিপতি শ্রেণীই খেয়ে নিচ্ছে৷ জিডিপি বৃদ্ধি পেলেও অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে পারে, সরকারী দেনা বাড়তে পারে, পরিবেশ সুরক্ষার বিপরীত পথে দেশ চলতে পারে৷ তাই তাঁরা জিডিপির পরিবর্তে সার্বিক উন্নয়নের সূচক (ইনক্লুসিভ ডেবেলপ্মেন্ট ইনডেক্স)-এর পক্ষপাতী৷ এই সার্বিক উন্নয়নের বিচারে ভারতের স্থান কিন্তু তলানীর দিকে৷ ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম ৭৪টি দেশ নিয়ে এক সমীক্ষা করেছিল৷ এতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের অবস্থান শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশ ও নেপালেরও পেছনে৷ ভারতের স্থান এই তালিকাতে ৬২ নম্বরে৷
প্রকৃতপক্ষে এই বাজেট ধনীদের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে৷ এত যে ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলা হচ্ছে কৃষি ও গ্রামের উন্নয়নের দিকে তাকিয়ে বাজেট করা হচ্ছে, তাহলে তো অবশ্যই আগে দৃষ্টি দেওয়া উচিত ছিল, গ্রামাঞ্চলে যে বছর বছর বন্যা-খরায় ব্যাপকভাবে ফসল নষ্ট হয়, গরীব গ্রামের মানুষেরা সর্বস্ব খুইয়ে বসে, এই বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সারা বছর ধরে সুষ্ঠু জলসেচের কোনো সুনিশ্চিত পরিকল্পনা করা৷ সে ধরনের অন্ততঃ ব্যাপক কোনো পরিকল্পনার কথা তো শোনানো হল না৷ গ্রাম ভারতের অজস্র নদী নালা এমনকি জলাধারও পলি জমে প্রায় বুজে গেছে, সেগুলি সংস্কার না করলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা সারা বছর জল সেচের ব্যবস্থা কোনোভাবেই করা যাবে না৷ আর গ্রামের মানুষের দুঃখও দূর করা যাবে না৷ তারপর ফসল বৃদ্ধির জন্যে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে কয়েক বছর পর জমির উৎপাদিকা শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ স্বাস্থ্যের পক্ষে এই অতিরিক্ত রাসায়নিক কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ক্ষতিকারক৷ তাই ব্যাপকভাবে জৈব কীটনাশক ও জৈব সার উৎপাদন ও কর্ষকদের সরবরাহ করারও ব্যাপক প্রকল্প নেওয়া উচিত ছিল৷ এ ব্যাপারে কর্ষকদের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত ৷ কিন্তু এ ধরনের কোনো প্রকল্প সরকার তুলে ধরেনি৷
দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সমস্যা হল দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা৷ আজকে দেশের ব্যাপক বেকার সমস্যা দেশের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ কর্মসংস্থানের চরম অনিশ্চিততার জন্যে আজকের যুবসমাজ এত বেশি চিন্তিত যে তারা তাদের নৈতিক তথা মানসিক বিকাশের কথা চিন্তা করারই অবসর পাচ্ছে না৷ কীভাবে এই বেকার সমস্যার সমাধান করা যাবে--- সে ব্যাপারে সরকারের--- কি কেন্দ্র--- কি রাজ্য সরকার কারুর কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই৷ কেবল এই সমস্যা সমাধানের জন্যে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের অর্থলগ্ণীর জন্যে অনুরোধ করা ছাড়া তাদের কাছে অন্য কোনও সমাধানের রাস্তা বাস্তবিক পক্ষে নেই৷ আসলে দেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে উদ্বৃত্ত শ্রমের (সারপ্লাস লেবার)-এর সমস্যায় চরমভাবে ভুগছে, তখন তার সমাধান হল, এমন শিল্প বা কলকারখানা গড়ে তোলা যাতে অল্প-পুঁজিতে বেশি শ্রমশক্তিকে কাজে লাগানো যায়৷ এ ধরনের শিল্পকে বলে লেবার ইনটেনসিভ্ ইনডাষ্ট্রি বা শ্রমনিবিড় শিল্প৷ পুঁজিপতি গোষ্ঠীর লক্ষ্য অধিক মুনাফা অর্জন৷
তাই তারা কম লোক নিয়োগ করে বেশী মুনাফা অর্জন করতে চায়৷ তাই পুঁজিপতি শ্রেণীর সাহয্যে কখনও এধরনের বেকার সমস্যা জর্জরিত দেশের বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়৷ তারজন্যে ইয়ূরোপ ও আমেরিকার পুঁজিপতি দেশগুলিতেও উচ্চহারে বেকার সমস্যা৷
এদেশের বেকার সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় পুঁজিপতিদের দ্বারা বৃহৎ শিল্প নয়, বরং ব্যাপকভাবে কৃষি-ভিত্তিক, কৃষিসহায়ক ও স্থানীয় কাঁচামাল ভিত্তিক অকৃষি শিল্প৷ এজন্যে ব্যাপকভাবে কুটির শিল্পকে উৎসাহিত করা ও সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য করা, আর প্রয়োজন ব্যাপক সমবায় ভিত্তিক এইসব শিল্প গড়ে তোলার মাষ্টার প্ল্যান গড়ে তোলা৷ তার সঙ্গে সমবায়কে সার্থক ও সফল করে তোলারও প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা করা উচিত৷
কেবল সমবায় ব্যাঙ্ক করলেই চলবে না, কৃষি,শিল্পে ও বাণিজ্যে ব্যাপকভাবে উৎপাদক ও উপভোক্তা গড়ে তুলতে না পারলেও পুঁজিপতিদের গ্রাস থেকে গ্রামবাসীদের ও দরিদ্র মানুষদের রক্ষা করা যাবে না৷
পুঁজিপতি ব্যবসায়ীদের পরামর্শে, পুঁজিবাদী ব্যবসায়ী মানসিকতা নিয়ে দেশের গরীব মানুষদের শোষণমুক্তি সম্ভব হবে না, তাদের দুঃখ দূর করা যাবে না৷ সমবায়ী-দৃষ্টিভঙ্গি ও সমবায়কে প্রতিষ্ঠিত করবার দৃঢ় মানসিকতাই দেশেন্নয়নের চাবিকাঠি৷
পশ্চিমবঙ্গের জনমোহিনী আয়-ব্যয় মাত্রিকা
সংসার পরিচালনার জন্যে যেমন পরিবারের কর্র্তকে আয় ও ব্যয়ের হিসেবের সুবিধার্থে আয় কোথা থেকে হবে আর কী কী খাতে ব্যয় হবে তার হিসেব কষে রাখতে হয়, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রেও সরকারকে তার আয়-ব্যয় হিসেবের নথিটি লোকসভা বা বিধানসভায় প্রতিটি আর্থিক বছরের জন্যে পেশ করে আইনানুসারে আলোচনা করে’ পাশ করিয়ে নিতে হয়৷ আমাদের রাজ্য সরকারের পক্ষে মাননীয় অর্থমন্ত্রী শ্রী অমিত মিত্র আগামী ২০১৮-১৯-এ আর্থিক বছরের আয়-ব্যয় মাত্রিকা (বাজেট) বিধানসভায় আলোচনার জন্য পেশ করেন৷ এই বাজেট তিনি মাত্র ১৩ মিনিটে পড়ে শেষ করেন৷ তিনি অসুস্থ ছিলেন বলেই তাঁর বাজেট পাঠে কিছুটা তাড়া ছিল৷ রাজ্য বাজেটে বিশেষ ছাড় আছে স্ট্যাম্প ডিউটিতে৷ এছাড়াও কৃষি আয়কর ছাড়, কর্ষকদের কৃষিজমি কেনার ক্ষেত্রে মিউটেশন ফি ছাড়, চায়ের সেস ছাড়, বিদ্যুৎ শুল্কে ছাড়ের প্রস্তাব আছে ৷ বিবাহ সহায়তা প্রকল্প ‘রূপশ্রী’তে বিবাহের সময় ২৫ হাজার টাকা দেওয়ারও প্রস্তাব রয়েছে৷
বাজেটে ব্যয়ের প্রস্তাব আছে কিন্তু আয়ের উৎসের উল্লেখ নেই৷
বাজেটে কৃষির উপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে ,কর্ষকদের কিছু কিছু সুবিধাদানের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তাদেরসমস্যা সমাধানের মূলে যাওয়া হয়নি৷ কৃষি উৎপাদক সমবায়, উপভোক্তা সমবায়, সমবায়ের ভিত্তিতে কৃষিভিত্তিক শিল্প, কৃষিসহায়ক শিল্প প্রভৃতি ব্যাপকভাবে গড়ে তুলে গ্রামের প্রকৃত বেকার সমস্যার সমাধান ও যথার্থ গ্রামোন্নয়নের কোনো প্রকল্পের কথা এ বাজেটে নেই৷
সে কারণে সরকারের বাৎসরিকআয় ব্যয়মাত্রিকা পেশ করাটা একটা মামুলি ব্যাপারের মতোই হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আয়-ব্যয় মাত্রিকার সার্থকতা নির্ভর করে এতে রাজ্যের দুঃস্থ নরনারীর কতটুকু কল্যাণ সাধিত হচ্ছে৷ সরকার যথারীতি যতটা পারা যায় নিজেদের কাজের ব্যাপারে সাফল্যের ঢাক পেটাচ্ছেন৷ কারণ জনগণ এতে সন্তুষ্ট হলে সরকার পক্ষকে সমর্থন করবে৷ অন্যদিকে বিরোধীরা সরকারের বাজেটের সমালোচনা করছে যাতে জনগণ বিরক্ত হয়ে বিরোধীদের পক্ষ নিয়ে সরকারের বিরোধিতা করে৷
এ রাজ্যে বর্তমানে বিরোধীরা একেবারেই কোন ঠাসা৷ তাদের মতে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অসুস্থ বলে ১৩-১৪ মিনিট বাজেট পড়েছেন, কিন্তু তিনি আধঘন্টার অধিক প্রেস কনফারেন্স করেছেন৷ এই বাজেটে তাদের মতে রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের ডি এ নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই৷ বিরোধী দলনেতা মান্নান বলেন, রাজ্যে প্রায় ৭৭ হাজার বুথ আছে৷ প্রতি বুথে ৮০০ থেকে ৯০০ জনের বসবাস৷ সেক্ষেত্রে সরকারের হিসাব মতে প্রতি বুথে ১৩৫০ জনের কর্মসংস্থান হবে৷ বাস্তবের সঙ্গে বাজেটের কোন মিল খঁুজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ মান্নান সাহেবের মতে রাজ্য সরকার বলেন যে গত ৬ বছরে রাজ্য সরকার ৮১ লক্ষ বেকারের চাকুরী দিয়েছে৷ সেটার সত্যতা প্রমান করতে সরকার শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক৷ বাম দলের পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন যে রাজ্যবাজেটকে জনমুখী না বলে জন বিরোধী বাজেট বলাই শ্রেয়৷
- Log in to post comments