২২ অগাষ্ট ঃ কেরালায় দীর্ঘদিন ধরে একটানা প্রবল বর্ষণে অভূতপূর্ব বন্যা দেখা দেয়৷ প্রবল জনস্রোতে ভেসে যায় অগণিত ঘরবাড়ী৷ এ যেন প্রকৃতির ভয়ঙ্কর ধবংসলীলা৷ এখন পর্যন্ত সরকারীভাবে ৩৭৩ জনের মৃত্যুর কথা ঘোষণা করা হয়েছে৷ ৩২ জনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ ১২ লক্ষ ৪৭ হাজার সাড়ে পাঁচ শ’তের বেশি মানুষ ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন৷ ইতোমধ্যে ক্ষতির পরিমান ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে৷ কেরলের এই অভূতপূর্ব বন্যা সমস্ত দেশবাসীকে দারুণভাবে বিচলিত করেছে৷ বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে৷ কিন্তু গোটা রাজ্য এখন যেন ধবংসস্তুপে পরিণত৷ এ থেকে উদ্ধার পেতে দীর্ঘ সময় লাগবে, লাগবে বহু অর্থ৷
ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও বিভিন্ন রাজ্য থেকে সাহায্য পাঠানো হচ্ছে৷ উদ্ধার কাজে জল, স্থল ও বায়ুসেনা একযোগে নিযুক্ত হয়েছে৷
এখন জল কমছে ও মহামারীর আশংকা দেখা দিয়েছে৷ রাজ্যের প্রায়, ১০ হাজার কিলোমিটার রাস্তা জলের নীচে না হয় জলের তোড়ে নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেছে৷
এর কারণ কী?
এই অভূতপূর্ব বন্যার কারণ কি কেবল আকাশভাঙ্গা একটানা বৃষ্টি? এ প্রশ্ণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষের মনে উঠছে ৷ কিন্তু এই ঘটনাটিকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখলে আমরা দেখব, এটার জন্যে প্রধানতঃ দায়ী অবিবেচক মানুষ৷ এটাকে তাই ‘ম্যানমেড্’ বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না৷ পরিবেশবিদরা এ ব্যাপারে বহু আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের সুচিন্তিত পরামর্শ না সরকার না জনসাধারণ --- কেউই কর্ণপাত করেননি৷
মহারাষ্ট্র থেকে কেরালা আরব সাগরের গা ঘেঁসে থাকা এই রাজ্যগুলিতে রয়েছে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা৷ সাগরের জলীয় বাষ্প এসে ধাক্কা মারে পাহাড়ে৷ তাই এই অঞ্চলে এমনিতেই বৃষ্টি বেশী৷ এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম৷ সেই কারণে এই অঞ্চলে পাহাড়ি এলাকায় নিয়ম মেনে ঘরবাড়ী বানানো উচিত৷ খনন করা হলেও এব্যাপারে কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন৷ কিন্তু কেরালায় এব্যাপারে কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না৷ নির্বিচারে ধবংস করা হয়েছে পশ্চিমঘাটের একের পর এক পাহাড়৷ নিয়ম না মেনে যত্রতত্র তৈরী হয়েছে পাথরখাদান৷ পাহাড়ে ঢালে নিয়ম না মেনে তৈরী করা হয়েছে বাড়ী, রিসর্ট৷ জঙ্গল কেটে প্রায় সাফ করে দেওয়া হয়েছে৷
ইতোপূর্বে পরিবেশ ও বনমন্ত্রক মিলে তৈরী করেছিল ‘ওয়েষ্টার্ন ইকলজি এক্সপোর্ট প্যানেল’৷ যার নেতৃত্বে ছিলেন পরিবেশবিদ্ মাধব গ্যাডগিল ৷ ২০১১ সালে এঁদের দেওয়া রিপোর্টে এই এলাকায় ঘরবাড়ী রাস্তাঘাট করার ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল৷ সরকার এই রিপোর্টকে কার্যকর করতে অস্বীকার করে৷ পরিবেশ বিজ্ঞানীদের পরামর্শ অমান্য করে বেআইনীভাবে খনি, খাদান, হোটেল ব্যবসার নামে পাহাড়ের ওপর দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচার হয়েছে৷ বর্তমান প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রকৃতপক্ষে তারই প্রতিফল৷
গ্যাডগিল কমিটি বলেছে, একই নিয়তি হতে পারে গোয়ারও৷ কেন্দ্রীয় সরকারের নিযুক্ত বিচারপতি এম বি শাহ কমিশন হিসেব করে বলেছিলেন, বেআইনী খনি থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা লাভ হয় শুধু গোয়াতেই৷ এই একই লোভের কারণে কেরালাতে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, গোয়াতেও এখনও কার্যকরী ব্যবস্থা না নিলে এখানেও এই ধরনের বিপর্যয় আসন্ন৷
শুধু কেরালা, গোয়া নয়, সারা দেশেরই এই অবস্থা৷ উত্তরাখণ্ডের বিগত বিপর্যয়ের কারণও ওই একই ছিল৷ সারা দেশ জুড়েই বেপরোয়াভাবে অরণ্যনিধন যজ্ঞ চলছে, নানান্ভাবে পরিবেশকে ধবংস করা হচ্ছে৷ প্রকৃতিও তার প্রতিশোধ নিচ্ছে৷
মানুষকে তাদের বেপরোয়া লোভ সংযত করতে হবে৷ প্রকৃতিকে---পরিবেশকে রক্ষা করার ব্যাপারে মানুষকে যত্নশীল হতে হবে৷ পাহাড় ও অরণ্যকে রক্ষা করতে হবে৷ পাহাড়-অরণ্যের উদ্ভিদ ও পশুকুলের প্রতি মমতা রাখতে হবে---তাদের ভালবাসতে হবে৷ এরই নাম নব্যমানবতাবাদ৷ এই নব্যমানবতাবাদই একমাত্র আজকের মানবসভ্যতাকে রক্ষা করতে পারে৷