প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চতুর্দিকে আধুনিক ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্বপ্ণ ফেরী করছেন৷ মোবাইল কম্প্যুটরের নেশায় সবাইকে বঁুদ করছেন৷ বলছেন, সেকেলে মুদ্রার যুগ চলে গেছে , এবার ভারতে আসছে ক্যাশলেস অর্থনীতি--- সবার হাতে থাকবে স্মার্টফোন, ফোন ঘষেই বাজারের কেনাবেচা চলবে৷ সাইনিং ইন্ডিয়ার বার্র্ত পৌঁছে দিচ্ছেন দেশ-দেশান্তরে৷
অথচ খবরে প্রকাশ, কেবল বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশেই গত দুসপ্তাহে ১২ জন চাষী আত্মহত্যা করেছেন৷ তাঁরা ফসলের ন্যায্য মূল্য পাননি৷ তাই ঋণ করে তাঁরা যে চাষ করেছেন, সেই ঋণের টাকা কীভাবে মেটাবেন, তার কূল-কিনারা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হতাশায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন৷
এই পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যপ্রদেশে কর্ষক আন্দোলন চলছে ১লা জুন থেকে ৷ গত ৬ই জুন মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপাল থেকে ৩০০ কি.মি. দূরে মন্দসৌরে আন্দোলনকারী কর্ষকদের ওপর পুলিশের গুলিচালনায় ৫ জন কর্ষকের মৃত্যু হয়েছে৷ পরে আর একজনের মৃত্যু হয়৷ পুলিশ হেফাজতে যাঁর মৃত্যু হয়েছে তাঁর নাম ঘনশ্যাম ধাকড়ে৷ অভিযোগ উঠেছে পুলিশের মারেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে৷
এরপর কর্ষকদের আন্দোলনের ঢেউ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে৷ দেশের ৪০টিরও বেশি কর্ষক সংঘটন দিল্লিতে ৫ ঘন্টা মিটিং করে তাঁদের দাবী-দাওয়া নিয়ে সারা দেশ জুড়ে এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়ার কর্মসূচী নিয়েছেন৷
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কিন্তু এ বিষয়ে চুপ৷ উত্তর প্রদেশের সরকার কৃষি ঋণ মকুব করার কথা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে সবরাজ্যেই কৃষিঋণ মকুবের দাবী উঠেছে৷ তার সঙ্গে দাবী উঠেছে তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য৷
তাঁদের দাবী, ফসলের উৎপাদনের খরচের ওপর ৫০ শতাংশ যোগ করে ফসলের নূন্যতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করতে হবে৷ প্রায়ই খরা, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি প্রভৃতির ফলে অনেক সময়ই ব্যাপকভাবে ফসল নষ্ট হয়ে চাষীরা নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন৷ এ অবস্থায় সর্বক্ষেত্রে ফসলবীমার ব্যবস্থা করতে হবে৷
মোট কথা চাষীরা সমস্ত দেশবাসীকে অন্ন যোগাচ্ছেন,প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল কাঁচামালও চাষীরাই উৎপাদন করেন৷ অথচ সেই চাষীরা অনাহারে, অর্ধাহারে, জীবন কাটাচ্ছেন৷ তাঁদের দু:খের অন্ত নেই৷ চরম দ্রারিদ্র্য ও বেকার সমস্যায় ভুগছেন গ্রামাঞ্চলে এই চাষী পরিবারগুলি৷
এদিকে মোদী সরকারের দৃষ্টি আছে কি? দু-চারটে মন-ভুলানো প্রকল্প ঘোষণা করে তা-ই সারা দেশে সারা বছরে উচ্চৈস্বরে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হচ্ছে৷ কিন্তুু কার্যত: চাষীদের দু:খ দূর করার কোনো কার্যকর পরিকল্পনা স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি৷ তাই শহরাঞ্চলে বিলাসিতার রমরমা কিন্তু গ্রামাঞ্চলে চরম দারিদ্র্য গ্রামবাসীকে কুরে কুরে খাচ্ছে৷
শিল্পোৎপাদিত দ্রব্যের ক্ষেত্রে সমস্ত খরচ হিসেব করে’ ও তার সঙ্গে লাভ ধরে পণ্যের মূল্য নির্র্ধরণ করা হয়৷ কিন্তু কৃষির ক্ষেত্রে তা করা হয় না৷ তার ওপর নানান্ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে চাষীদের লড়াই করতে হয়৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বার বার ফসল নষ্ট হয়ে যায়৷ ফলে তাদের প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়৷ এইভাবে প্রতি বছর লড়াই করে চাষীদের দেশবাসীর জন্যে অন্ন জোগাতে হয় বা নানান্ ফসল ফলাতে হয়৷
ফলে শিল্পপতিদের ধনৈশ্বর্য বছর বছর বৃদ্ধি পেতে থাকলেও, চাষীদের দারিদ্র্য ঘুচছে না৷ বরং ক্রমশঃ অর্থনৈতিক অনিশ্চিততা তাদের গ্রাস করছে৷ এই কারণেই চাষীরা একে একে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন৷
সারা দেশের কর্ষকদের আত্মহত্যার ছবির দিকে দৃষ্টি দিলেই আরও ভালভাবে বোঝা যাবে, এই সমস্যা কত গভীর৷ ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্ট ২০০৯ সালে ভারতে ১৭,৩৬৮ জন কর্ষক আত্মহত্যা করেছেন৷ ২০০৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৬১৯৬৷ ১৯৯৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত এদেশে কর্ষক আত্মহত্যার সংখ্যা ২,৩২,৪৬৪৷ হ্যাঁ, চমকে যাওয়ার মত খবর! কিন্তু এটা সরকারেরই ন্যাশান্যাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর খবর৷ তাই একে অস্বীকার করার উপায় নেই৷
সরকার মুখে বড় বড় কথা বলেন, কিন্তু যথার্থ কর্ষকভাইবোনদের ভুলে ধনীদের তোষণেই ব্যস্ত৷ পঁুজিবাদী দুনিয়ার হাতের খেলনা হয়ে তিনি মানুষকে কেবল বিভ্রান্ত করছেন আর দেশের এই ভয়ঙ্কর সমস্যাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখছেন৷
কর্ষকদের যথার্থ উন্নতি ঘটাতে যা চাই তা হ’ল, কৃষিতে ব্যাপকভাবে উৎপাদক সমবায়, উপভোক্তা সমবায়, কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দেওয়া, কৃষিজাত দ্রব্যের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করা, সর্বক্ষেত্রে কৃষিবীমার ব্যবস্থা করা, প্রতি ইঞ্চি কৃষিজমিতে বারো মাস সেচের জলের ব্যবস্থা করা, সর্বত্র চাষের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তিতে চাষীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রভৃতি৷ অবিলম্বে এসবের সুব্যবস্থা করতে হবে৷
- Log in to post comments