কৃষি ও কর্ষকদের কয়েকটি মৌলিক সমস্যা প্রসঙ্গে

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

প্রাউট প্রবক্তা মহান্ দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর প্রাউটের কৃষিনীতিতে বর্ষার জলকে ধরে রেখে ও সারা বছর সেই জলে চাষ করার পরামর্শ দিয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে তিনি জৈবসার ও জৈব কীটনাশক ব্যবহার করতেও বলেছেন৷ তিনি এই উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানীদের গবেষণার জন্যে আহ্বান জানিয়েছেন৷

আনন্দের কথা, সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, একটি বেসরকারী সংস্থা ‘সবুজ বাংলা রুরাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ বিশেষ উদ্যোগী হয়ে ইদানিং বর্ষার জলকে ধরে রেখে সারা বছর ধরে চাষ করার ও জৈবসার আর জৈব কীটনাশক ব্যবহারের জন্যে কর্ষকদের (চাষীদের) প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন৷

এ ব্যাপারে বিধানচন্দ্র কৃষি বিদ্যালয়ের কৃষিবিজ্ঞানী ডঃ রঞ্জন বসাক, ডঃ এস.সি পাই, ডঃ এম.সি কবির, ডঃ এস সি ঘটক প্রমুখ ওই সংস্থার ডাকে সাড়া দিয়ে সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত প্রশিক্ষণ শিবিরে চাষীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন৷

ইতোমধ্যে কলকাতার পার্কসার্র্কসে প্রথমপর্বের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে৷ আগামী ৬মাসে এ রাজ্যের ১৮ কোটি জেলার ১লক্ষ চাষীকে এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে৷

উল্লিখিত বেসরকারী সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এতে চাষীরা স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারবেন৷ তাঁরা জানিয়েছেন, জৈবসারের ক্ষেত্রে তাঁরা ফল ও সব্জির খোসা, গোবর, গোমুত্র প্রভৃতি ব্যবহারের ওপর গুরত্ব দিয়েছেন৷ তারা বলেছেন,এর ফলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে৷ এতে উৎপাদন ব্যয়ও কমবে৷ উৎপাদিত ফসলের মানও উন্নত হবে৷ আর তা ছাড়া এর দ্বারা উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্য স্বাস্থ্যের পক্ষেও ভাল৷

বর্তমানে পার্ক সার্কাসে প্রশিক্ষণ চলছে৷ অগাষ্টে বারুইপুরে দ্বিতীয়পর্বের প্রশিক্ষণ শুরু হবে৷ এতে অংশ নেবেন ১৬,০০০ জন৷ এইভাবে ধাপে ধাপে বিভিন্ন জেলায় ১ লক্ষ চাষীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে৷

বেসরকারীভাবে ‘‘সবুজ বাংলা রুরাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’’ যে এই উদ্যোগ নিয়েছেন এজন্যে এই সংস্থার উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ৷ প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে কৃষি ও কর্ষককুলের মূল সমস্যার দিকে সরকার ঠিকভাবে গুরুত্ব দিয়ে নজর দিচ্ছেন না৷ তাঁদের সমস্যা ও সমাধান নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও বৈজ্ঞানিকদের ঠিকভাবে কাজে লাগানোও হচ্ছে না৷ কৃষিতে সেচের জল অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ সেচের জল ছাড়া কৃষি অচল৷ কিন্তু রাজ্যের অধিকাংশ জমিতে এক বর্ষকাল ছাড়া পর্যাপ্ত জল পাওয়া যায় না৷ তাও যদি ঠিক সময়ে বর্ষা না হয়, চাষ মার খায়,বেশি বর্ষা হলেও বন্যা হয়৷ আবার বন্যার জল নেমে যাবার পর দেখা দেয় জলাভাব৷

ইদানিং সরকার গ্রীষ্মকালীন চাষে ব্যাপকভাবে শ্যালোর সাহায্যে মাটির নীচের জল তুলে চাষের ব্যবস্থা করেছেন৷ এতে চাষীরা অনেকটা খুশী৷ অন্ততঃ কিছু চাষী---যারা এই শ্যালোর জল ব্যবহার করে পর্যাপ্ত ফসল ফলাতে পারছেন৷ কিন্তু তারফলে যে কী ভয়ঙ্কর বিপদ ঘনিয়ে আসছে, সে কথা কেউ গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন না৷ কারণ, এর ফলে সবচেয়ে বড় বিপদ হল জলের স্তর নেমে যাচ্ছে৷ বৈজ্ঞানিকরা বার বার এব্যাপারে সতর্ক করছেন, যেভাবে ভূগর্ভের জলের স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ পানীয় জলের সংকট দেখা দেবে৷ তাছাড়া এরফলে জলে আর্সেনিকের মাত্রাও বাড়ছে৷ যা অত্যন্ত ক্ষতিকর৷ জলস্তর বেশি নেমে গেলে বনাঞ্চলও ধবংস হয়ে যাবে৷

তাই বর্ষাকালে প্রকৃতির দেওয়া অঢেল জলধারাকে জমিয়ে রেখে ওই জল দিয়ে সারা বছর চাষের কাজে ব্যবহার করা ও তা থেকেই পানীয় জলের প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা করাটা অত্যন্ত জরুরী৷

তাছাড়া ব্যাপকভাবে নদী সংস্কার করে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি করা, বিভিন্নস্থানে ছোট ছোট জলাধার নির্র্মাণ করে জল সঞ্চয় করা৷ ব্যাপকভাবে গ্রামে গ্রামে পুকুর (সায়র), বাঁধ (রাঢ়ের ঢালু এলাকায় একদিকে বাঁধ দিয়ে জল সঞ্চয় করা) প্রভৃতি তৈরী করে বর্র্ষর জলকে ধরে রাখার ব্যবস্থা করাকে অত্যন্ত বেশী গুরুত্ব দিতে হবে৷ তা না হলে যে জলাভাবেই মানব সভ্যতার সব কিছু শেষ হয়ে যাবে৷

কিন্তু, এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা আজকের গণতন্ত্রের বোটের রাজনীতিতে দেশের নেতা-নেত্রীরা ভুলেই থাকছেন৷

আজকের নেতা-নেত্রীরা সবসময় চিন্তিত ক্ষমতা দখল ও অর্জিত ক্ষমতা কীভাবে আঁকড়ে রাখা যায় তা নিয়ে৷ এজন্যে সাধারণ মানুষকে নানান জনমোহিনী প্রোগাম দিয়ে জনসাধারণের মন ভোলাতে সবাই সদা-সচেষ্ট৷ তাই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের তত বেশী চিন্তিত হতে দেখা যায় না৷ তাঁরা এমন কিছু করে দেখাতে চান--- যাতে চট করে রেজাল্ট দেবে ও মানুষ তাঁদের কৃতিত্ব সঙ্গে সঙ্গে বুঝে তাঁদের সমর্থন করবে৷ দূরদৃষ্টির দারুণ অভাব৷

অথচ আজকের সমাজকে বাঁচাতে গেলে চাই প্রধানতঃ দূরদৃষ্টি৷ চাই নির্ভুল নীতি---যা ভবিষ্যৎ সমাজকে সুরক্ষিত করবে৷

সবক্ষেত্রেই এটা দরকার৷ কেবল চটজলদি কিছু একটা করে’ সকলের মন জয় করার দিকে নজর দিলে চলবে না৷ এমন কিছু নির্ভুল নীতি নিয়ে সুদূরপ্রসারী প্রকল্পে হাত দিতে হবে, যার সুদূরপ্রসারী ফল ভাল হবে৷