মানব জীবনে বিজ্ঞান ও ধর্ম

লেখক
সৌমিত্র পাল

পূর্ব প্রকাশিতের পর

যোগাসন অভ্যাসকারীদের কিছু কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে---

১) কারো কথা শুনে কিংবা বই পড়ে নিজে নিজে আসন অভ্যাস করবেন না৷  এটা ঠিক অভিজ্ঞ  চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই শক্তিশালী ঔষধ সেবন করার মতই অনুচিত৷ ভুল আসন শরীরে কুপ্রভাব ফেলবেই৷

২) তাড়াহুড়ো করে আসন অভ্যাস একেবারেই অনুচিত৷ এতে হৃদযন্ত্রের ওপর চাপ পড়ে রক্তসঞ্চালনে বিঘ্ন ঘটে৷

৩) আসন করার পর  অঙ্গ সংবাহন (Massage of whole body) অবশ্যই করবেন৷

৪) আসন অভ্যাসের পর অভ্যাসকারীকে অবশ্যই আরাম বোধ করতে হবে, ক্লান্তি নয়৷

৫) আসন সর্বদাই খালি পেটে (empty stomach) এ অভ্যাস করবেন৷ দিনে  ২বার ‘আসন’ অভ্যাস করা উচিত৷

যোগচক্র-গ্রন্থি-ভাবাবেগ ও আসনের প্রভাব ঃ দেহ মনের মধ্যে যে সূক্ষ্ম পরস্পর নির্ভরতা তা মূলতঃ যোগচক্রগুলির Plexus) মাধ্যমেই ঘটে থাকে যোগবিজ্ঞানের সম্পূর্ণ রূপরেখাটাই নির্মিত হয়েছে মানব মস্তিষ্ক ও মেরুদন্ডকে  কেন্দ্র করেই ৷ মস্তিষ্ক পদার্থ বা Brain Matter৷ সম্প্রসারিত হয়েই বহু অস্থি সমন্বিত মেরুদন্ড গঠিত হয়েছে৷  এরই মধ্যে মানব  জীবনের দৈহিক (Physical) মানসিক (Mental or phychic) ও  আধ্যাত্মিক (Spiritual) সকল প্রকার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি, শক্তিপ্রবাহ, কর্মৈষণা প্রভৃতি লুকিয়ে আছে--- যা আমরা ক্রমবিশ্লেষণের মাধ্যমেই জানতে পারব৷

মানুষের মেরুদন্ডের ভেতর দিয়ে গেছে ৩টি প্রধান-মানস-আধ্যাত্ম নাড়ী Psycho -Spiritual nerves)--- বামদিকে ইড়ানাড়ী , মাঝে সুষুন্মা নাড়ী আর  ডানদিকে আছে পিঙ্গলা নাড়ী৷ এরা  পরস্পরকে  বিশেষ ৭টি স্থানে স্পর্শ করেছে৷ ওই স্পর্শবিন্দুগুলির প্রত্যেকটি জীববিজ্ঞানের (Biology) ভাষায় বলা হয় প্রধান স্নায়ূকেন্দ্র আর যোগবিজ্ঞানে  (Yoga -Psychology) ভাষায় বলা হয় যোগচক্র বা (plexus)৷

এই যোগ-চক্রগুলিই দেহের বিভিন্ন  গ্রন্থি-উপগ্রন্থি, অরগান, স্নায়ূতন্ত্র, কোষ প্রভৃতির মূল নিয়ন্ত্রক (main controller)৷ এই যোগচক্রগুলি অসংখ্য স্নায়ুর মাধ্যমে গ্রন্থি অরগানগুলিকে পরিচালনা করে৷ এরাই আমাদের দেহমন ও আত্মার সকল অনুভূতির ধারক ও বাহক৷ ৭টি যোগচক্র আমাদের মেরুদন্ড বরাবর ওপরে মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্রন্থি পর্যন্ত বিস্তৃত৷

মেরুদন্ডের একেবারে নীচে অবস্থান করছে ১) মূলাধার চক্র৷ শরীরের স্থূল কাজগুলি সম্পাদন করে, যথা অন্তকোষ-সংক্রান্ত ও মলত্যাগের প্রক্রিয়া৷ এর কিছু ওপরে অবস্থান করছে ২) স্বাধিষ্ঠান চক্র (যা মূলাধার অপেক্ষা সূক্ষ্মতর দেহের তরল উপাদানকে নিয়ন্ত্রণ করে৷ মুত্রত্যাগ, যৌনক্রিয়া, প্রজনন প্রক্রিয়ার সাথে স্বাধীষ্ঠান চক্র যুক্ত)৷ স্বাধিষ্ঠান চক্রের ওপরে নাভিদেশে অবস্থান করছে৷ ৩) মণিপুর চক্র (দেহের  তাপশক্তি ও পাচন বা হজম সংক্রান্ত-প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে৷ এই চক্র প্রধান্য: অ্যাড্রিনাল প্যানক্রিয়াস গ্রন্থির মূল নিয়ন্ত্রক)৷ বক্ষ  সংলগ্ণ স্থানে অবস্থান করছে ৪) অনাহত চক্র (দেহের বায়বীয় উপাদানকে  নিয়ন্ত্রণ করে ৷ শ্বাস-প্রশ্বাস  রক্তচলাচল প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত৷  এই চক্রটিকে Solar plexus ও বলা হয়৷ থাইমাস গ্রন্থি , হার্ট বা হৃদযন্ত্রের মূল নিয়ন্ত্রক এই অনাহত চক্র৷ গলার কাছে অবস্থান করছে ৫) বিশুদ্ধ চক্র:- (থাইরয়েড ও প্যারাথাইরয়েড  গ্রন্থির  মূল নিয়ন্ত্রক ও বাক্শক্তির প্রধান কারণ)  দুই ভ্রূর মাঝে ভেতরের দিকে অবস্থান করছে৷   ৬) আজ্ঞাচক্র (যা পিটুইটারী গ্রন্থি, হাইপোথালামাস ও মানসিক প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক)৷ সপ্তম তথা উচ্চতম চক্রটি হল ৭) সহস্রার চক্র (মস্তিষ্কের শীর্ষে পিনিয়াল গ্রন্থির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত৷  বিশুদ্ধ চৈতন্য বা পরমব্রহ্মের  আধারস্থল এই চক্র৷ নিম্নস্থ ৬টি চক্রও তাদের সমস্ত কার্যকলাপের  মূল নিয়ন্ত্রক এই সহস্র দলযুক্ত বা সহস্রার চক্র৷

১)মূলাধার চক্র ও ভাবাবেগ ঃ- মেরুদন্ডের একেবারে শেষপ্রান্তে যে যোগ-চক্রটি অবস্থান করছে তাকে বৈদিক ঋষিরা ‘মূলাধার চক্র’ বলেছেন৷ এই চক্রটি টেষ্টিস্ নামক Endocrine gland টির সাথে সংযুক্ত ৷ জীবনের প্রধান চারটি  মৌলিক আকাঙ্ক্ষা’র  (unique desire) আধার হল এই  মূলাধারচক্র৷ যোগীরা এই চক্রকে প্রসুপ্ত  ‘জীবভাব’ তথা ‘কুলকুন্ডলিনী’  শক্তির আধার বলে অভিহিত করেছেন ৷

অষ্টাঙ্গিক যোগ অনুশীলনের মাধ্যমে সাধক তার মূলাধারের প্রসুপ্ত জীবভাব (কুলকুন্ডলীনি শক্তি)-কে জাগ্রত করে তাকে ক্রমান্বয়ে উধর্বমূখী করে সহস্রারে চৈতন্যভাবে (ব্রহ্মভাবে) প্রতিষ্ঠিত  করে৷ এখানে পরম শান্তির স্থান৷

মূলাধারে চারটি মৌলিক  আকাঙ্ক্ষা  বা মূল ভাবাবেগগুলি হলঃ

১)‘কাম’ বা জাগতিক  আকাঙ্ক্ষা (Physical longing)ঃ এর দ্বারা  দেহগত আকাঙ্ক্ষা যথা অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা ও চিকিৎসার আকাঙ্ক্ষা মনে জাগ্রত হয়৷

২) ‘অর্থ বা মানসিক আকাঙ্ক্ষা (Psychic longing)ঃ এর দ্বারা মনোগত সুক্ষ্ম আকাঙ্ক্ষা যথা সঙ্গীত সাহিত্য সংস্কৃতি-নৃত্য প্রকৃতি নান্দনিক আকাঙ্খা জাগ্রত হয়৷

৩) ধর্ম বা মানস-আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা (Psycho spritual longing) ঃ এরদ্বারা জীবনের পায় আরাধ্য (ধ্যায়) -কে উপলদ্ধি করবার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়৷

৪) ‘মোক্ষ বা আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা (spritual longing) এর দ্বারা সর্বপ্রকার  বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ঘন অসীম ব্রহ্মে চির প্রতিষ্ঠিত হতে চায়৷

একজন সাধক যখন সর্বপ্রথম তাঁর ‘গুরুদেবের কাছ থেকে সাধনার মন্ত্র (মন্ত্র -মননাৎ তারয়েৎ বস্তু স মন্ত্র পরীকির্তিত) ও

নিজের বৈবাহরিক অনুশীলন পদ্ধতি নিয়ে তা নিজের ব্যষ্টিজীবনে করতে থাকে তখন থেকেই  তার প্রসুপ্ত জীবভাব বা কুলকুন্ডলিনী জাগ্রত হতে থাকে ও সাধনার ক্রমপর্যায়ে তা ঊধর্বমুখী আকাঙ্ক্ষার হতে হতে সাধকের সহস্রারে পরম চৈতন্যে একীভূত হয়ে যায়৷   (ক্রমশঃ)