পূর্ব প্রকাশিতের পর
হিরণ্ময় কোষ Subtle- Causal Mind) ঃ এটি বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতার স্তর৷ ‘দধি মন্থন করতে করতে যেমন সারংশ ‘মাখন’ ওপরের দিকে উঠে আসে আর অসার অংশ ঘোল নীচে পড়ে থাকে, ঠিক তেমনি নিষ্ঠাসম্মত সাধনার মাধ্যমে মনের মন্থন হয় ৷ মনের অসার আস্তরনগুলি (স্থূল কোষগুলি) ক্রমন্বয়ে সরতে থাকে আর মনের সার অংশটি যাকে দর্শনের ভাষায় জীবাত্মা Soul)বলা হয় তা হীরন্ময় কোষে প্রকট হয়ে ওঠে৷ দীর্ঘ ভ্রমনপথ পেরিয়ে মানুষ যখন সমুদ্রের উপকূলে এসে উপনীত হয়, তখন তার অতিসন্নিকটেই থাকে সুবিস্তৃত সমুদ্র যার অপরূপ সৌন্দর্য তাঁকে মাঝে মেলে ধরতে চায়৷ ঠিক তেমনি যোগীঋষিদের মতে হীরন্মময় কোষও আসলে আধ্যাত্মিক সমুদ্রের উপকূল৷ মন এই উপকূলে উপনীত হলে সমুজ্জ্বল জ্যোতির্ময় চৈতন্যসত্তাকে দর্শন করতে পারে৷ তখন ওই পরম চৈতন্যের (পরমাত্মার) সুতীব্র আকর্ষণ মনের উপর কাজ করে ৷ এই আকর্ষণে ‘মন’ উন্মাদ হয়ে যায়,পরমচৈতন্যকে তথা পরমাত্মাকে পাবার জন্যে....তাঁতে মিশে একাকার (একই আশার) হবার জন্যে৷
এই ধরণের উন্মাদনাকে দর্শনের ভাষায় বাতুলতা’ বলা হয়৷ বাউল শব্দটি এসেছে ‘বাতুল’ থেকেই (বাউল> বাতুল)৷ যাঁদের হিরণ্ময় কোষ উন্নত তাদের মনে এই ধরণের বাতুলতা দেখা যায়--- যেমন রামকৃষ্ণদেব, বামাক্ষ্যাপা, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু, মীরাবাঈ প্রমুখ মহাত্মাগণ আধ্যাত্ম-বাতুল বা ব্রহ্মপ্রাপ্তির জন্যে সর্বদাই উন্মাদ হয়ে থাকতেন ৷
সাধনার অন্যতম অঙ্গ ‘ধ্যান’ অনুশীলনের মাধ্যমে সাধক ক্রমান্বয়ে বিজ্ঞানময়ের আবরণ সরিয়ে হিরণ্ময় কোষে এসে উপনীত হয়৷ হিরণ্ময় কোষে দিব্যজ্যোতিঃ দর্শন হয়৷
মনের শেষ স্তর হিরণ্ময় পরে নির্গুণ ব্রহ্মের অবস্থান৷ এই কৌষিক আস্তরণ টুকু সরিয়ে ফেলতে পারলেই জীবাত্মা পরমাত্মাতে বা নির্গুণ ব্রহ্মে মিলে যায়--- জীবাত্মা পরমাত্মাতে বিলীন হয়ে যায়৷ এই অবস্থায় মনের পরিধি অসীম হয়ে যায় ৷ একেই মনের চরম বিস্তৃতি বা বিকাশ বলা হয়৷ প্রসঙ্গত বলি---যে মুহূর্তে মানবমন অসীমত্ব প্রাপ্ত হচ্ছে সেই মুহূর্তেই মানবমন তাঁর নিজস্ব অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে৷ এখানে মন অসীমে (ব্রহ্ম) মিশে ব্রহ্ম ই হয়ে যাচ্ছে৷ ফলে যেখানে মানব মনের কোন পৃথক অস্তিত্বই থাকছে না সেখানে ‘দুঃখ’-ক্লেশ-গ্লানি-মান-শোক -তাপ ‘ব্যাধি’ ‘জরা’ প্রভৃতি তরঙ্গানুভূতি থাকার প্রশ্ণই থাকছে না৷ মন তরঙ্গহীন (বক্রতাহীন) হয়ে অসীম সরলরৈখিক অবস্থা প্রাপ্ত হচ্ছে--- এটা চির প্রশান্তির অবস্থা৷ (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments