মানব মনের বিকাশ ঃ সমাজগুরুর দায়িত্ব

লেখক
আচার্য্য ত্রিগুণাতীতানন্দ অবধূত

মনই হচ্ছে মানব জীবনের মূল সম্পদ৷ মনের সম্পূর্ণ বিকাশের  মধ্য দিয়ে একটি মানব শিশু তার মূল লক্ষ্যে অনেক উচ্চে উপনীত হ’তে পারে৷ তার সুপ্ত মনের কোণে আশা-আকাঙ্খা লুকিয়ে আছে৷ তারা চায়  নিজেকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে৷ তা কি আজও তা সম্ভব? চারিদিকে যেন আজও প্রকৃতির নির্মম রূপ, ঝড়-ঝঞ্জা ও অগ্ণুৎপাত প্রতিটি মুহূর্ত তাদের ধবংস করার জন্যে প্রস্তুত৷ কী করে প্রতিষ্ঠিত হবে সেই মানব জীবন? তাদের মনেও তো রয়েছে মহামানবের স্বপ্ণ৷ হবে কি সেই স্বপ্ণ পূরণ? কে দেবে তাদের অনুকূল পরিবেশ? যেখানে পাবে তারা নিবিড় শান্ত-স্নিগ্দ সুন্দর পরিবেশ৷ যেমন একটি গাছের নীচে শত সহস্র বীজ মাটিতে পড়ে থাকে, কিছুদিন পরে অঙ্কুরোদগম হয়, ব্যস এতটুকু৷ তারপর দেখা যায় তাদের নির্মম পরিণতি, নীরবে নিস্তদ্ধতা মাঝে সেগুলি শুকিয়ে যায় অনুকূল পরিবেশের অভাবে৷ তারাও তো চেয়েছিল এই সুন্দর পৃথিবীর শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশে বেঁচে থাকার একটু অধিকার৷ যদি সেদিন আমরা তাদের অনুকূল পরিবেশ দিতে পারতাম, তবে হয়তো আমরা আজ হাজার হাজার বনস্পতির সম্ভাবনা তাদের  মাঝে খঁুজে পেতাম৷ কিন্তু আমরা কি দিতে পেরেছি তাদের অনুকূল পরিবেশ?  কবে আসবে সেই গণচেতনা? এমনি করে কতদিন  তারা মরবে  অসহায় ভাবে৷ আমরা জানি-একটি গাছ একটি প্রাণ৷ কতবার পড়েছি তবু তো ভুলে যাই৷ 

প্রভাত সঙ্গীতে বলা হয়েছে                       ---                                     ‘‘মানুষ যেন মানুষের তরে,

          সব কিছু করে যায়,

          একথাও যেন মনে রাখে

          পশু-পাখি তার পর নয়,

          তরুও বাঁচিতে চায়৷’’

তাই আজ আমরা উচ্চৈঃস্বরে  বলতে চাই শুধু একটি গাছ একটি প্রাণ নয়, একটি গাছ বহু প্রাণ৷  এটাই হোক আমাদের জীবনের একমাত্র ব্রত৷

তেমনি একটি মানব শিশুর মনেও তো রয়েছে বৃহতের ভাবনা৷ তারাও তো চায় তাদের জীবনের মূল লক্ষ্যের পানে ছুটে যেতে৷ মানব মনের ত্রিস্তরীয়  বিকাশের ধারাকে ধরে রাখতে৷ তাদের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক এই তিনটি স্তরকে সমানভাবে সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে৷ এই গুরু দায়িত্ব কাউকে না কাউকে তো নিতেই হবে৷ কে জানে সেই গুপ্ত রহস্যের কথা৷  সুপ্ত সম্ভাবনার মাঝে লুকিয়ে আছে বৃহতের ভাবনা৷  যেমন একটি ফুল বাগানে সুন্দর সুন্দর ফুল পেতে গেলে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ মালীর প্রয়োজন আছে৷ যিনি বাগানের পরিচর্র্য সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানেন৷ তবেই হয়তো একটি ফুল-বাগানে সুন্দর সুন্দর ফুল পাওয়া  সম্ভব৷ 

যখন একটি মানব শিশু তার মাতৃ জঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রথম যখন সে সুন্দর পৃথিবীর আলো,হাওয়ার বিরাট রূপটা দেখে, তখন সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে কেঁদে ওঠে৷ কে জানে তাঁর সুপ্ত মনের কথা? তাই সেদিন পিতা মাতা ছিল তার   হাসি-কান্নার সাথী ও প্রথম পথপ্রদর্শক৷ কখন কি  প্রয়োজন, কেউ না জানলেও পিতা-মাতা তা জানতেন৷

এইভাবে এগিয়ে যেতে লাগল সেই মানব শিশু৷ কিন্তু সে তো নিরাপদ নয়, প্রকৃতির প্রতিকূল পরিবেশে প্রতিটি মূহুর্তে তাকে যেন ধবংস করতে চায়৷ কিন্তু তাঁকে তো বাঁচাতে  হবে,  দিতে হবে অনুকূল পরিবেশ৷ তাই সেদিন পিতা-মাতা অনুভব করেছিলেন শিক্ষকের৷ তাদের অসমাপ্ত কাজের গুরু দায়িত্ব সঁপে দিয়েছিলেন  শিক্ষক মহাশয়ের হাতে৷ তাঁরা যাতে  তাদের শারিরীক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক ভাবধারায় ভাবিত হয়ে সম্পূর্ণ বিকাশের পথে  এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন৷ তাই শিক্ষকদের শুধু পঁুথিগত বিদ্যার মধ্যে আবদ্ধ থাকলে চলবে না৷ ‘‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে৷’’ সমস্ত রকম বন্ধন ও উঁচু-নিচু ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে  বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের পথে এগিয়ে চলতে হবে৷ শিক্ষককে ‘‘সমাজ গুরু’’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে তাঁদের মধ্যে থাকবে ন্যায়-নিষ্ঠা ও আদর্শ পরায়ণতা৷ তাঁদের অক্লান্ত  শ্রম ও আদর্শ-নিষ্ঠার মাধ্যমে  একদিন সমাজের সর্বস্তরে আসবে আমূল পরিবর্তন৷ শিক্ষায় আনে চেতনা, চেতনা  আনে বিপ্লব৷

 একটি মানবশিশু ধাপে ধাপে  এগিয়ে চলে যেমন বাল্যকাল বা কৈশোর জীবন পেরিয়ে যৌবনে  পা দেওয়ার  সঙ্গে সঙ্গে তাকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়৷ তখন থেকেই সে কোনো না কোনো সে একটি কাজে নিযুক্ত হয়ে পরিবার প্রতিপালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ শুধু কর্ম করা, অর্থ উপার্জন  করা  ও পরিবার প্রতিপালন করা৷ এটাই হয়ে যায় তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য৷

তখন তারা  ভুলে যায় সমাজটা  কী? সমাজের প্রতি তাঁদের দায়িত্ব, কর্তব্য৷ কিন্তু তাদের তো আমরা দোষ দিতে পারি না৷ মূল কারণ লুকিয়ে আছে শিক্ষা ব্যবস্থায় ৷ যেমন শিক্ষা পাবে তেমনই মানুষ তৈরী হবে৷ পুঁথিগত শিক্ষা মানুষকে শুধু যন্ত্রে পরিণত করতে পারে মাত্র৷ কারণ এতে রয়েছে শুধু শারীরিক, মানসিক জ্ঞান৷ তাই এটা সম্পূর্ণ শিক্ষা নয়৷ মানুষকে চলতে হবে পূর্ণত্বের পথে, যেখানে  পাবে তারা তাদের  শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান৷ জড়বাদী সমাজ ব্যবস্থা যতদিন চলতে থাকবে, ততদিন তারা মানুষকে যন্ত্রের মত ব্যবহার করবে৷ এমনি করে মানুষকে যন্ত্রের মত ব্যবহার করবে৷ মানুষের মনের  উন্নত বৃত্তি, মূল্যবোধ জাগরণে তারা তৎপর হবেন৷ এমনি করে তারা মানুষের মন থেকে ধর্মকে আলাদা করে দিয়েছে৷  ধর্ম নাকি আফিং৷ আসলে ধর্মটা তাই তারা বোঝে না৷ আগুন থেকে তার ধর্মকে  বাদ দিলে তা আগুন থাকে না, মানুষের থেকে তার ধর্মকে বাদ দিলে সেও  প্রকৃত মানুষ থাকে না৷ মনুষত্ব বোধহীন একটা প্রাণ হয়ে যায়৷

 প্রতিটি মানব শিশুকে যদি আমরা  তার প্রকৃত বিকাশের অনূকূল  পরিবেশ  দিতে পারতাম, উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে তাদের সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারতাম, তবে হয়ত সেই মানব শিশুর মাঝে মহামানবের বিকাশ দেখতে পেতাম৷ তার জন্যে  দরকার উপযুক্ত শিক্ষা ও উপযুক্ত শিক্ষক ৷ প্রতিটি মানবশিশুর  মাঝে লুকিয়ে আছে মহামানবের সম্ভাবনা৷ তাই তাদের পরিবেশ দিতে হবে৷ আর যেসব বখে যাওয়া শিশুরা রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে অভাবের তাড়নায়, তাদের চোখে নেই ঘুম, পেটে নেই অন্ন ঘুমোবার মত নেই কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা৷ তারা প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার সুযোগ ও শিক্ষা পায়না৷

এমনি করে  যুগ যুগ ধরে শত সহস্র মানবশিশু নীরবে বিদায় নিয়েছে এই সুন্দর ধূলির ধরণী থেকে৷ যদি আজ আমরা তাদের বাঁচার মত উপযুক্ত পরিবেশ ও উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিতে পারতাম, তবে হয়ত তাদের মাঝে  থেকে হাজার হাজার বিপ্লবী নেতাজী, বিবেকানন্দ, ক্ষুদিরাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত মহামানবের আবির্ভাব দেখতে পেতাম৷

তাই বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় আজ যারা শিক্ষকের ভূমিকায় রয়েছেন-তারাই হচ্ছেন সমাজ গড়ার আসল কারিগর৷ তাদের  উপর নির্ভর করছে সমাজ ব্যবস্থাটা কেমন হবে৷ আদর্শ শিক্ষক বা শিক্ষাগুরু হতে গেলে অবশ্যই তাদের মধ্যে ত্রি-স্তরীয় বিকাশের ধারা বজায় রাখতেই  হবে৷  ত্রি-স্তরীয়  বিকাশ মানে শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশ ৷ তাই সেদিন একজন আদর্শ শিক্ষাগুরু হিসাবে বলতে পারবেন যে ‘‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে’’৷

বিদ্যা কী? যে শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষকে জাগতিক সমস্ত রকম বন্ধন মুক্ত হয়ে অর্র্থৎ জাগতিক সমস্যার সমাধান ঘটিয়ে পরম আনন্দঘন সত্তার পানে ছুটে চলে, পরম লক্ষ্যের পানে ছুটে যেতে পারে  তাই হল বিদ্যা৷  একদিন আদর্শ সমাজগুরুদের অক্লান্ত শ্রমের ফলে একটি আদর্শ মানব সমাজ  প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে৷ এই সমাজগুরুরা যেমন শিক্ষা দেবেন,তেমনি গড়ে উঠবে সমাজ ব্যবস্থা, তেমনই গড়ে উঠবে  রাষ্ট্র ব্যবস্থা৷ এই আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার  মাধ্যমে আমরা একদিন একটি অখন্ড শোষণমুক্ত নব্যমানবতাবাদী  সদ্বিপ্র সমাজ প্রতিষ্ঠা দেখতে পারব৷