মানবতার মুক্তি-মন্ত্র---‘প্রাউট’

লেখক
আচার্য প্রসূনানন্দ অবধূত

প্রাউটের ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা

মানব সভ্যতা আজ এক চরম সংকট মুহূর্ত্তে এসে উপনীত হয়েছে৷ মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়সামাজিক অবিচার, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত  অমনোবৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা, সংস্কৃতির নামে বেলেল্লাপনা, ধর্মীয় মৌলবাদ, অর্থনৈতিক বৈষম্যঅসহ্য দারিদ্র্যলাগাতার অনাহার,--- এককথায সার্বিক অবক্ষয় মানব সমাজের গতিকে রুদ্ধ করেছে ৷ অজগরের মতো সমগ্র মানব সমাজকে  আষ্টে -পিষ্টে জড়িয়ে ফেলেছে৷ হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীসারা বিশ্বজুড়ে তাই যুদ্ধের এত রণহুঙ্কার, স্বার্থের  এত সংঘাত, মানবরূপী দানবদের  এত আস্ফালন ! একদিকে সীমাহীন ভোগের প্রাচুর্য্য, অন্যদিকে কোটি কোটি বুভুক্ষু মানুষের হাহাকার ও আর্ত্তনাদে মানবতা আজ ধূলি-লুন্ঠিত৷  কমিউনিজমের অকাল মৃত্যুর পর  পুঁজিবাদী দানব আজ গ্রাস করে নিচ্ছে বিশ্বের অধিকাংশ সম্পদ৷  সম্প্রতি আন্তর্জাতিক  সমীক্ষক সংস্থা অক্সফ্যাম’-এর  রিপোর্টে প্রকাশ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আটজন ধন কুবেরের  কাছে যে সম্পদ আছে তা  গোটা পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যার  কাছে থাকা সম্পদের সমান৷ ভারতের  ক্ষেত্রে  এদেশের ৫৮ শতাংশ সম্পদ  আছে মাত্র ১ শতাংশ মানুষের কাছে৷ মাত্র ৫৭ জন কোটিপতির কাছে যে সম্পদ আছে তা  এদেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ মানুষের কাছে থাকা সম্পদের সমান৷  মুষ্টিমেয়  মানুষের  কাছে থাকা সম্পদের  প্রাচুর্য্যই অধিকাংশ মানুষের  অভাবের কারণ৷  তাই বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ আজ চরম দারিদ্র্যের শিকারবিভিন্ন দেশে  অনাহারে  অপুষ্টিতে  মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই  বেড়ে চলেছে৷ ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কোটি কোটি মানুষ যখন ক্ষুধার জ্বালায় কাতর আর কমিউনিষ্ট দেশগুলোতে  মানসিক ও কোথাও কোথাও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অভাবে  লক্ষ কোটি মানুষের কান্নার  ফোঁপানি ও বুকচাপা দীর্ঘশ্বাসে যখন পৃথিবীর আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল, হতাশাগ্রস্ত ও দিশাহারা মানুষ  যখন সমাজের এই অন্ধকার থেকে উত্তরনের পথ খঁুজছিল, এমতাবস্থায় সভ্যতার সেই যুগ সন্ধিক্ষণে যুগ পুরুষ ও মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাত রঞ্জন  সরকার  মানব সমাজকে উপহার দিলেন তাঁর অভিনব সামাজিক-অর্থনৈতিক দর্শন, নিপীড়িত মানবতার মুক্তিরমন্ত্র প্রাউট৷  মানবমুক্তির নোতুন পথ প্রাউট’ (প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব)৷  শোষিত, বঞ্চিত ও দিশাহারা মানব সমাজকে তিনি শোণালেন নব্যমানবতার পাঞ্চজন্য৷

প্রাউটের লক্ষ্য

আধ্যাত্মিকতার  ওপর  আধারিত প্রাউটের লক্ষ্য  সর্বপ্রকার  শোষন  ও দুর্নীতিমুক্ত এক নোতুন পৃথিবী তথা এক অবিভাজ্য মানব সমাজ গড়ে তোলা৷  প্রাউট প্রবক্তার ভাষায় ‘‘প্রাউট ছাড়া এই ক্লেশ  দূর করে মানবতাকে রক্ষা করার অন্য  কোন উপায় নেই৷  অন্নহীনকে পরমার্থের  কথা শুনিয়ে লাভ নেই৷  বাস্তব জগতে বাঁচতে হলে অর্থের দরকার৷  অস্তিত্ব রক্ষার মাধ্যম হলো অর্থ, সেই সঙ্গে দরকার পরমার্থ৷  অন্ন চাই , বস্ত্র চাই, বাঁচার মতো বাঁচতে চাইচিকিৎসা চাই, নিবাস চাই, আর এই প্রয়োজন মেটাবার জন্যেই  একদিন আমি অবস্থার চাপে পড়ে প্রাউটদর্শন তৈরী করতে বাধ্য হয়েছি’’৷ প্রাউটের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সমাজের  প্রতিটি মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চিততা (গ্যারান্টি) প্রদান করা৷ আর তা করতে গেলে আজকের সমাজের ভয়াবহ দারিদ্র্য ও বেকার সম্যসার সমাধান করতে হবে৷ এজন্যে প্রাউটের অর্থনৈতিক গণতন্ত্রপ্রতিষ্ঠাই অর্থনৈতিক সম্যসার একমাত্র সমাধান৷  এ প্রসঙ্গে প্রাউট প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন ‘‘স্থানীয় জনসাধারণের হাতেই সমস্ত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকবে’’l অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে উপর থেকে চাপিয়ে না দিয়ে ব্লক স্তর থেকে শুরু করে ক্রমশঃ উপরে নিয়ে যেতে হবে৷ l অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বয়ম্ভর হয়ে উঠতে পারে  এমন একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ  সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল ঠিক করে নিয়ে অঞ্চলটিকে শোষণমুক্ত করতে হবে৷l স্থানীয় অর্থনীতিতে বহিরাগতদের নাক গলাতে দেওয়া চলবে না৷l স্থানীয় অর্থনীতিতে যাতে বহিরাগতরা নাক গলাতে না পারে সে উদ্দেশ্যে সমস্ত কর্মসংস্থানেই স্থানীয় মানুষকে অগ্রাধিকার দিতে হবে৷ সেজন্যে সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা ও অফিসগুলিতে স্থানীয় ভাষাকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে হবে৷স্থানীয় জনসাধারণের  ১০০ ভাগ কর্ম সংস্থান সুনিশ্চিত করতে প্রযুক্তি-নির্ভর শিল্পকে প্রাথমিক অবস্থায় উৎসাহ না দিয়ে শ্রমনিবিড় (অর্থাৎ যে শিল্পে বেশী লোক নিয়োজিত হতে পারবে) শিল্প স্থাপন করতে হবে৷শুধু ভারী শিল্পের (যেমন গাড়ী শিল্পের) উপর জোর না দিয়ে প্রতিটি ব্লকে কাঁচামাল ভিত্তিক কৃষি-নির্ভর শিল্প ও প্রতিটি জেলায় কৃষি-সহায়ক শিল্প গড়ে তুলতে হবে৷l কৃষিকে শিল্পের মর্র্যদা দিতে হবে৷l জনগণ যাতে বিদেশী পণ্য না কিনে স্থানীয় শিল্পে উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে, তা সুনিশ্চিত করতে  স্থানীয় বাজারে বহির্পণ্যের প্রবেশ রুখে দিতে হবে৷l কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য সমস্ত ক্ষেত্র থেকে  ধীরে ধীরে  ব্যষ্টিগত মালিকানার অবলুপ্তি ঘটিয়ে সমবায়ের মাধ্যমে সমস্ত কিছুর পরিচালনা করতে হবে৷  প্রাউটসেই পথই দেখিয়েছে, যা দেখাতে আজকের সমাজের প্রচলিত  ধনতন্ত্র  ও মার্কসবাদ দুইই শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ৷ প্রাউট প্রবক্তা ব্যষ্টি স্বাধীনতা ও সমষ্টি স্বার্থের  মধ্যে  এক অপূর্ব সমম্বয় সাধন করেছেন৷