১৯৭০ সালে উত্তর বিহারের একজন ভাল গৃহী আচার্যের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল৷ তিনি হলেন ডঃ বিদ্যার্থীজী (আয়ুর্বেদিক ডাক্তার)৷ উনি ‘বাবা’র (শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী) খুব ভক্ত৷ তিনি বাবার সম্পর্কে তাঁর এক বিস্ময়কর অনুভূতির কথা আমাকে বলেছিলেন৷ এই ঘটনাটা অনেক আগের৷ তখন তিনি নূতন মার্গী ছিলেন৷ তাঁর ধর্মপত্নী তখনও মার্গী হননি৷ তবে তিনি বিদ্যার্থীজীর সাধনাতে বাধা দিতেন না৷ উনি (ধর্মপত্নী) একবার এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হ’ন৷ প্রতিবেশীরা সবাই পরামর্শ দিলেন স্ত্রীকে বড় শহরে নিয়ে গিয়ে ভাল ডাক্তার দেখাতে৷ তা না হলে যে কোনো সময় তাঁর মৃত্যু হতে পারে৷ বিদ্যার্থীজীর টাকা পয়সা বেশী ছিল না৷ যাই হোক স্ত্রীর ভাল চিকিৎসার জন্যে তিনি তাঁর কিছু জমি বিক্রি করে স্ত্রীকে শহরে ভাল চিকিৎসার জন্যে নিয়ে গেলেন৷ শহরে গিয়ে একটি হোটেলে উঠলেন৷ এরপর কোন্ বড় ডাক্তারের কাছে যাওয়া যায় সে কথা ভাবতে শুরু করলেন৷ এমন সময় হঠাৎ তাঁর মনে হ’ল, গুরুদেব এখন এই শহরেই আছেন৷ সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যার্থীজী স্ত্রীকে কিছু না বলে গুরুদেবের কাছে চললেন৷ আশ্রমে যখন পৌঁছালেন, তখন গুরুদেব ‘ফিল্ড ওয়াকে’ (মার্গগুরুদেব প্রতিদিনই সকাল ও সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময়ে সমাগত ২/৪ জন ভক্তকে নিয়ে বাইরে কোথাও বেড়াতে যেতেন৷ একেই মার্গীরা বলতেন ‘‘ফিল্ড ওয়াক’’৷) বেরুচ্ছেন৷ গুরুদেবের সঙ্গে মুখোমুখি হতেই গুরুদেব তাঁকে বললেন, ‘চল আমার সঙ্গে চল৷’ ডঃ বিদ্যার্থীজী সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলেন ও বাবার গাড়ীতে গিয়ে বসলেন৷ গুরুদেবের কাছে বসে মনে মনে ভাবছেন, ‘‘কিন্তু আমার স্ত্রী তো হোটেলে অসুস্থ অবস্থাতে শুয়ে আছেন৷ আমার তো ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা’’ মনে মনে এই চিন্তা এলেও মনের কথা প্রকাশ করতে পারছেন না৷
গুরুদেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তুমি কেমন আছ, এলাকার অন্যান্য মার্গীরা কেমন আছেন?’’ বিদ্যার্থী বললেন, সবাই ভাল আছেন, তবে স্ত্রীর অসুস্থতার কথা বললেন না৷ যখন তাঁর সঙ্গে এই কথাবার্তা চলছে, গুরুদেব ড্রাইভারকে অন্য এক রাস্তা দিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন৷ ড্রাইভার তখন বলল, ‘বাবা, এই রাস্তা পাহাড়ের দিকে যাচ্ছে৷ গাড়ী এই রাস্তা ধরে বেশীদূর যেতে পারবে না৷’
গুরুদেব উত্তর দিলেন, ‘‘আমি জানি, কিন্তু যতটা যাওয়া সম্ভব, ততটা এগোও৷ তারপর গাড়ী ঘোরাবে৷’’
ড্রাইভার গুরুদেবের নির্দেশে এগিয়ে চলল, কিছুটা এগিয়ে ড্রাইভার বলল, আর যাওয়া সম্ভব নয়৷
ড্রাইভার গাড়ী থামাতে, গুরুদেব গাড়ীর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন ও বিদ্যার্থীজীও গাড়ী থেকে নামলেন৷ গুরুদেব বিদ্যার্থীজীকে সঙ্গে নিয়ে খানিকটা এগিয়ে চললেন৷ একটুখানিক যাওয়ার পর গুরুদেব তাঁর লাঠিটি দিয়ে ছোট একটি লতানো গাছের দিকে নির্দেশ করে বললেন, ‘‘তুমি এ গাছটা নিয়ে গিয়ে এই গাছের পাতার কয়েক ফোঁটা রস তোমার স্ত্রীকে খাওয়াবে৷ তাতেই তোমার স্ত্রী সুস্থ হয়ে যাবে৷’’
বিদ্যার্থীজী বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়লেন৷ তিনি তো তাঁর স্ত্রীর অসুস্থতার কথা গুরুদেবকে একবারও বলেননি বিদ্যার্থীজী ওই গাছটা তুলে নিলেন ও যত্ন সহকারে পকেটে রেখে দিলেন৷ তাঁর দু’চোখ জলে ভরে গেল৷ তাঁর প্রতি ও তাঁর স্ত্রীর প্রতি বাবার গভীর স্নেহ ভালবাসা তাঁকে অভিভূত করে’ তুলল৷
এরপর গুরুদেব ড্রাইভারকে বললেন, গাড়ী ঘুরিয়ে নিয়ে আশ্রমে ফিরে চল৷ আর বিদ্যার্থীজীকে উদ্দেশ্য করে গুরুদেব বললেন, যাও তাড়াতাড়ি তোমার স্ত্রীর কাছে ফিরে যাও ও তাঁকে এই ওষুধটা খাওয়াও৷
বিদ্যার্থীজী যখন হোটেলে ঢুকছেন তখন মনে নানান চিন্তার উদয় হচ্ছে৷ তিনি অসুস্থ স্ত্রীর জন্যে বড় ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে গিয়ে এখন তিনি কয়েকটা জংলা পাতা পকেটে নিয়ে যাচ্ছেন৷ যাইহোক, যখন তিনি হোটেলের তাঁদের ভাড়া করা রুমে ঢুকলেন, দেখলেন, তাঁর স্ত্রী বিছানার ওপর বসে আছে৷ তাঁর স্ত্রী ডঃ বিদ্যার্থীজীকে দেখেই সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে? ডাক্তার এসে তো তাকে ওষুধ দিয়েছেন৷ এখন তিনি সুস্থ বোধ করছেন৷’’
বিদ্যার্থীজী অবাক৷ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোন ডাক্তার? তাঁর স্ত্রী তখন ডাক্তারের চেহারা ও বেশভূষার বিবরণ দিলেন, বিদ্যার্থীজী বুঝে গেলেন, তাঁর গুরুদেবই ডাক্তার রূপে এসে তাঁকে ওষুধ দিয়ে গেছেন৷ গুরুদেবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভক্তিতে তিনি বিহ্বল হয়ে পড়লেন৷ বিদ্যার্থীজী বললেন, ‘হ্যাঁ উনি ডাক্তারেরও ডাক্তার৷ উনি আমার গুরুদেব৷ আমি তাঁর কাছে গেছলুম, তিনি তোমার জন্যে এই ওষুধ দিয়েছেন’ বলে পকেট থেকে সেই জংলা পাতা গুলো বের করলেন৷ তখন অবাক হয়ে তাঁর স্ত্রীও বললেন, উনি আমাকেও ওই একই পাতা দিয়েছেন৷
কিন্তু কখন দিয়ে গেলেন এতক্ষণ তো তিনি গুরুদেবের কাছেই ছিলেন৷ তারপর গুরুদেব আশ্রমে ঢুকলেন, বিদ্যার্থীজীও আশ্রম থেকে সোজা এখানে এলেন বুদ্ধি দিয়ে এর কোন পাওয়া যাবে না৷ যাইহোক বিদ্যার্থীজীর স্ত্রী ওই পাতার রস খেয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলেন৷
(লেখকের ‘‘ৰাৰার সান্নিধ্যে দিনগুলি’’ পুস্তক থেকে গৃহীত)
- Log in to post comments