হৃদরোগের চিকিৎসায় মধু
দুর্বল হৃৎপিণ্ডের পক্ষে মধু এক বল দানকারী উৎকৃষ্ট পানীয়৷ মধু প্রয়োগের ফলে শরীর বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশী অধিক সবল ও সাবলীল ভাবে কাজ করতে পারে৷ মধু খেলে রক্ত বাড়ে ও নাড়ীগুলির প্রসারণ ঘটে, তাতে রক্ত সঞ্চালন সহজতর হওয়ায় হৃৎপিণ্ডের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে না৷ হৃদ্রোগীরা স্বস্তি অনুভব করেন৷ এছাড়া সহজে পাচ্য গ্লুকোজ যথেষ্ট পরিমাণে মধুতে রয়েছে যা দ্রুত রক্তের সঙ্গে মিশে যেতে পারে আর সর্বক্ষণ কর্মব্যস্ত হৃদযন্ত্রের ক্লান্ত মাংস পেশীকে সবল করে তুলতে পারে৷
পরিপাকক্রিয়া বৃদ্ধির সহায়ক
মধু শরীরের পরিপাক যন্ত্রগুলির কার্যশক্তি বাড়িয়ে তোলে৷ ইউরোপে মধ্যযুগে গ্রাম্য ডাক্তাররা বলতেন ‘হানি ইজ দ্য বেষ্ট ফুড অফ্ দ্য ষ্টমাক্’৷ ইউরোপে ও আমেরিকায় মধুর প্রশংসা গেয়ে কবিতা রচিত হয়েছে৷
আয়ূর্বেদ শাস্ত্রেও প্রশস্তি গেয়ে অসংখ্য শ্লোক রচনা করা হয়েছে৷ হজমের শক্তি বাড়াতে, চোখের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে আনতে, শরীরের ক্ষত নিরাময় করতে–মধুর ক্ষমতা রয়েছে৷ মধু পাকস্থলিতে হাইপার এ্যাসিডিটি দূর করে আর পাচন ক্রিয়ার সহায়ক গ্ল্যাণ্ডগুলিকে উজ্জীবিত করে প্রয়োজনীয় গ্রন্থীরস ক্ষরণে (হরমোনস) সাহায্য করে তা ছাড়া ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদন্ত্র–এর অনেক ব্যাধি দূর করতে মধু সহায়তা করে৷ গ্যাসট্রিক আলসার রোগে মধুর উপকাবরিতা খুবই৷ হাইপার এ্যাসিডিটি থেকে এক ধরণের ব্যাধির উদ্ভব হয়৷ মধু নিয়মিত খেলে পাকস্থলির এই ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়া রোধ হয়ে যায়৷ ডঃ গ্রিগোরির ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৪ সালের মধ্যে প্রায় ৬০০ রোগীর চিকিৎসা করেন৷ এই সব রোগীদের মধ্যে ৭৬ জনের ছিল হাই পার এ্যাসিডিটি, ৬৭ জনের ছিল স্বাভাবিক,৫৪ জনের এ্যাসিডিটি ছিল সাবনর্মাল আর ২৪ জনের কোন এ্যাসিডিটি ঘটিত ব্যাধি ছিল না৷ মধু সেবনের পূর্বে সাধারণ চিকিৎসার পর দেখা গেল যে শতকরা ৬০ ভাগ ভাল হ’ল কিন্তু চিকিৎসা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও পেটে ব্যথা অনুভব করছে৷ কিন্তু তাদের যখন সাধারণ চিকিৎসার সাথে সাথে মধুও প্রয়োগ করা হ’ল তখন দেখা গেল ৯৫ পারসেণ্ঢ রোগী যন্ত্রণা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পেল৷ এ ছাড়া সাধারণভাবে চিকিৎসা করে যে রোগী ব্যাধি মুক্ত হতে দুই মাস সময় নিচ্ছে মধু প্রয়োগের দ্বারা, দেখা গেছে যে আরোগ্য লাভের সময়সীমা তার সিকি ভাগেরও বেশী হ্রাস হয়েছে৷ আর নিয়মিত মধু সেবনের পর এই ধরণের রোগীদের শারীরিক অবস্থার যে পরিবর্তন ডাক্তাররা লক্ষ্য করেছেন সেগুলি নিম্নরূপ ঃ–
–রক্তের রাসায়নিক উপাদানের পরিবর্ত্তন ঘটেছে
–শরীরের ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে,
–গ্যাসট্রিক এ্যাসিডিটি স্বাভাবিক হয়ে গেছে,
–স্নায়ুপুঞ্জে সতেজতা ফিরে এসেছে৷
স্নায়বিক রোগ ও মধু
যারা অতিরিক্ত মস্তিষ্কের কাজ করেন, অথবা স্নায়বিক দৌর্বল্যে ভুগছেন তাদের পক্ষে মধু যথেষ্ট উপকারী৷ ১৯৭৯ সালে অধ্যাপক এন কে বাগলেপর দুই জন স্নায়বিক আক্রান্ত রোগীকে দুই সপ্তাহ মধু সেবন করিয়ে যথেষ্ট উপকার পান৷ ১৫ দিন মধু খাওয়ার পর দেখা গেল রোগী দু’জনের মাথার যন্ত্রণা দূর হয়ে গেছে৷ শরীরে যথেষ্ট শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে রাত্রে তারা ভালভাবে ঘুমতেও পারছেন, মেজাজ অনেকটা স্বাভাবিক ও ঢাণ্ডা হয়েছে আর দুজনে দিনে অধিকাংশ সময় বেশ হাসিখুশীতে কাটাচ্ছে৷ যারা স্নায়বিক দৌর্বল্যে ভুগছে বা অতিরিক্ত কাজের চাপে সন্ধ্যা ও রাত্রির দিকে যাদের স্নায়ু ঝিমিয়ে পড়ে, কর্ম শক্তির অভাব অনুভব করে তারা রাত্রে শুতে যাবার আগে এক গ্লাস জলের মধ্যে অর্ধেক করে কাটা নেবুর রস আর দুই চামচ মধু মিশিয়ে খেলে যথেষ্ট উপকার পাবেন৷ হাসপাতালের ডাক্তাররা পরীক্ষা চালিয়ে এর সুফল পেয়েছেন৷ গমের রাইয়ের খোলা ভিজিয়ে মধুর সাথে মিশিয়ে খেলে স্নায়ু সতেজ ও সবল হয়ে ওঠে৷ ইউরোপের বড় বড় হাসপাতালে রেডিয়াম চিকিৎসার সময় ডাক্তারেরা রোগীদের মধু খেতে দেন৷ মধু থেকে প্রোটিনের ভাগ নিষ্কাশন করে বাকি মধু তাদেরকে খাইয়ে দিয়ে দেখা গেছে যে রেডিয়াম প্রয়োগের সময় শরীরের বিষ ক্রিয়া হচ্ছে না৷
চক্ষুরোগে মধু
ইউক্যালিপটাস গাছের পাতার রসের মিশ্রণে মউমাছিরা যে মধু তৈরী করে সেই মধু চক্ষু রোগের পক্ষে ভাল ঔষধ৷ চোখ ফুলে গেলে কর্ণিয়া বা কনজাইটিবাইটিস প্রভৃতি রোগে মধুর মলম প্রয়োগ করে ডাক্তাররা যথেষ্ট উপকার পেয়েছেন৷
যৌগিক চিকিৎসা পুস্তকে মধুর ব্যবহার
পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের যৌগিক চিকিৎসা পুস্তকে মধুর ব্যবহার অনেক রোগের চিকিৎসায় দেখতে পাওয়া যায়৷ যারা হৃদরোগে ভুগছে তাদের রোগ বৃদ্ধি পেলে দুধের সাথে অথবা জলের সাথে মধু মিশিয়ে খেতে বলা হয়েছে (১১৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)৷ দারুচিনী চূর্ণ ও মধুর মিশ্রণে হৃদ্রোগের ঔষধ প্রস্তুত করা হয়৷
স্থূলতা রোগ ঃ – (১১২ পৃষ্ঠা) চিনি বা গুড়ের ব্যবহার কমিয়ে দিনে তিন চামচ মধু পানের বিধান দেওয়া হয়েছে৷
স্ত্রী ব্যাধিতে বিশেষ করে ঋতু রোগে মধুর ব্যবহার ফলপ্রদ৷ কাঁটা নটের মূলের সাথে মধু মিশিয়ে খেলে ঋতুরোগ হ্রাস পায় (৯৮ পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য)
হাঁপানি রোগের চিকিৎসাতে মধুর ব্যবহার রয়েছে৷ যৌগিক চিকিৎসা পুস্তকে (৮৫ পৃষ্ঠা)৷ বলা হয়েছে – ‘ময়ূর পুচ্ছ ভষ্ম এক আনা পরিমাণ মধু সহ ধীরে ধীরে লেহন করে খেলে শ্বাস কষ্ট অত্যল্প কালের মধ্যে দূরীভূত হয়৷
রক্ত চাপ বৃদ্ধি রোগেও মধু ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া রয়েছে৷ সর্পগন্ধা পাতার রস মধুর সাথে মিশিয়ে অথবা ত্রিফলার সাথে মধু মিশিয়ে খেলে রক্ত চাপ রোগ প্রশমিত হয় (৮০ পৃষ্ঠা)৷
যক্ষ্মা রোগেও যৌগিক চিকিৎসা পুস্তকে (৭২ পৃষ্ঠায়) মধুর ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ যক্ষ্মা রোগীর পক্ষে মধুর ব্যবহার খুবই উপকারী৷ পুস্তকটিতে বলা হয়েছে–
খোসা সহ বড় এলাচ চূর্ণ ও দারুচিনি চূর্ণ সমানভাবে মিশিয়ে মধু সহ এক চামচ পরিমাণ সন্ধ্যায় সেব্য৷
বাত রোগে অনন্ত মূলের ক্বাথ ও মধু ওষুধরূপে ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ (৬১ পৃঃ)
বহু মূত্র রোগেও মধু ব্যবহারের নির্দেশ রয়েছে৷
(৫৬ পৃঃ)
ক) যজ্ঞ ডম্বুরের রস এক তোলা মধু সহ
অথবা
খ) তেলাকুচা পাতার রস এক তোলা মধু সহ প্রতূ্যষে লেহন করে খেলে বহুমূত্র রোগ প্রশমিত হয়৷
গ) জাম আঁটি শাঁস এক আনা মধু সহ গ্রহণ করলে,
অথবা
ঘ) শুষ্ক্ শিমূল মূল চূর্ণ এক আনা মধু সহ লেহন করলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়৷
পাকস্থলীর ক্ষত বা আন্ত্রিক ক্ষতরোগেও মধুর ব্যবহার বিধেয় বলে যৌগিক চিকিৎসায় লেখা রয়েছে
(৪৪২ পৃঃ)৷ এতে বলা হয়েছে, এই রোগীর পক্ষে জল বা দুধের সাথে দিনে সবশুদ্ধ ২/৩ চামচ মধু খাওয়া দরকার৷ রোগির বাড়াবাড়ি অবস্থায় পাতলা দুধের সাথে মধু মিশিয়ে খাবার নির্দেশ দেওয়া আছে৷
এমনকি সিফিলিস রোগীর চিকিৎসাতেও যৌগিক চিকিৎসা পুস্তকে মধুর ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ২০ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে প্রদাহ স্থানে চূর্ন লেপণ করে তারপর তার ওপরে গুড় বা মধু লাগালে অতি অল্প কালের মধ্যে সিফিলিসের বাগী বসে যায়৷
একটি বিষয় পাঠকরা অবশ্যই লক্ষ্য করে থাকবেন নিশ্চয়ই যক্ষ্মা, বহুমূত্র, সিফিলিস, আলসার, হাঁপানি, হৃদরোগ আর রক্ত চাপ প্রভৃতি মারাত্মক ও প্রাণ নাশক জটিল ব্যাধির চিকিৎসায় বাবা মধু ব্যবহরের নিদান দিয়েছেন৷ সুতরাং এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে মানব শরীরের পক্ষে মধুর উপযোগিতা ও রোগ প্রতিষেধক কতটা প্রবল (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments