ভারতের স্বাধীনতা বিপ্লবের এক জ্বলন্ত নিদর্শন মাষ্টারদা সূর্য সেন৷ মাষ্টারদা সূর্য সেনের অকল্পনীয় আত্মত্যাগ, বীরত্ব ও দেশপ্রেম যে কোনো আদর্শবাদী মানুষের কাছে প্রেরণার প্রজ্জ্বলন্ত অগ্ণিশিখা ৷
১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল, তিনি চট্টগ্রামে ৬৫জন সঙ্গী নিয়ে ব্রিটিশদের দুটি অস্ত্রাগার, পুলিশ লাইন, ডাক ও তার অফিসের সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে ব্রিটিশদের পরাস্ত করেন৷ ওই সব অফিসে ব্রিটিশ পতাকা ইয়ূনিয়ন জ্যাক নামিয়ে ভারতের পতাকা উড়িয়ে দেন ও নিজেকে স্বাধীন ভারতের চট্টগ্রাম শাখার প্রধান রূপে ঘোষণা করেন৷
লজ্জায় ব্রিটিশ শাসকের মাথা হেঁট হয়ে যায়৷ মাষ্টারদার বুঝতে অসুবিধা হয়নি ব্রিটিশ শাসক সমস্ত শক্তি নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে তাই মাষ্টারদা তাঁর ৬০ জন অনুগামী নিয়ে জালালাবাদ পাহাড়ে ঘাঁটি গাড়লেন তাঁর সঙ্গে ছিলেন লোকনাথ বল, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ বিপ্লবীরা৷ বিরাট ব্রিটিশ বাহিনী তাঁদের ঘাঁটির সন্ধান পেয়ে ২২শে এপ্রিল মাষ্টারদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে৷ প্রথম দফায় ব্রিটিশ সেনাকে পিছু হটতে হয় কিন্তু পরের দিন তারা আরও বিশাল বাহিনী নিয়ে বিপ্লবীদের ঘিরে ফেলে৷ জালালাবাদের সেই লড়াই অগ্ণির অক্ষরে লেখা স্বাধীনতা বিপ্লবের এক জাজ্বল্যমান ইতিহাস৷ এই যুদ্ধে ১১ জন বিপ্লবী শহীদ হন মাষ্টারদা সহ বাকীরা আত্মগোপন করেন৷
চট্টগ্রামের ধলঘাট থেকে কয়েক মাইলের মধ্যে গৈরালা নামক স্থানে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে আত্মগোপন করে থাকার সময় ওই পরিবারেরই পরিচিত এক মহিলা ওই বাড়ীতে এসে মাষ্টারদা ও তাঁর সহকর্মীদের দেখতে পান৷ ওই মহিলা বাড়ী গিয়ে তাঁর স্বামীকে ঘটনাটি বলেন তাঁর স্বামী এদের মধ্যে একজনকে মাষ্টারদা বলে সন্দেহ করেন৷ ওই ব্যষ্টি স্থানীয় এক নেশাগ্রস্ত জমিদারকে বিষয়টি জানান৷ ওই জমিদার ছিলেন পুলিশের চর৷ তখন মাষ্টারদার মাথার দাম ধরা হয়েছিল দশ হাজার টাকা ওই লোভী জমিদার বিনাশ্রমে টাকা রোজগারের আশায় পুলিশকে মাষ্টারদার গোপন ডেরার কথা জানিয়ে দেন৷ ১৯৩৩ সালে ১৭ই ফেব্রুয়ারী গৈরালায় সন্ধ্যা নামার আগে ক্যাপ্ঢেন ওয়ামসলীর নেতৃত্বে এক বিশাল পুলিশ বাহিনী ওই বাড়ীটিকে ঘিরে ফেলেন৷ মাষ্টারদার নির্দেশে তাঁর সহকর্মীরা নিজেদের অস্ত্র নিয়ে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়িয়ে পড়েন কেউ কেউ পুলিশ বেরা টপকে, ডোবা পেরিয়ে, পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও মাষ্টারদা ও ব্রজেন সেন গ্রেপ্তার হন তাঁদের দুজনের হাত পা সব শক্ত করে বেঁধে ফেলা হয় সারারাত তাঁদের রাইফেলের বাট ও লাঠি দিয়ে মারা হয়৷ পরদিন ভোরে সেনা ও পুলিশ বাহিনী মাষ্টারদা ও ব্রজেন সেনকে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে শিকল বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে পটিয়া পুলিশ ক্যাম্পে উপস্থিত হয়৷ ওই ক্যাম্পে মাষ্টারদা ও ব্রজেন সেনকে উঁচু কাঁটা তারের ঘেরার মধ্যে রাখা হয়৷ এরপর পটিয়া থেকে চট্টগ্রাম আসার পথে মাষ্টারদা একদল পুলিশের দ্বারা চরমভাবে নির্যাতিত হন৷ পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার মাষ্টারদার গ্রেপ্তারের জন্য মূলতঃ দায়ী বলে খবর রটে গেলে তিনি তার বাড়ীর নিকটে দুই বিপ্লবীর গুলিতে নিহন হন৷
মাষ্টারদার ফাঁসির আদেশ ঘোষিত হয় ১৯৩৩ সালের ১৪ই আগষ্ট৷ ৩১শে আগষ্ট মাষ্টারদার আশ্রয়দাতা ক্ষীরদপ্রভা বিশ্বাস ও তাঁর সহকর্মী ব্রজেন সেনের চার বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়৷
মাষ্টারদার অনুগামী চারজন বিপ্লবী ১৯৩৪ সালের ৭ই জানুয়ারী চট্টগ্রামের পল্টন মাঠে ক্রিকেট খেলায় নিযুক্ত সাহেবদের ওপর গুলি চালান৷ চার জন বিপ্লবীদের মধ্যে দুই জন নিহত ও দুই জন আহত হন৷
পুরস্কারের আশায় যে জমিদার মাষ্টারদার গোপন ডেরার সংবাদ পুলিশকে জানিয়ে দেয় তার আর পুরস্কার নেওয়া হল না৷ ৮ই জানুয়ারী ১৯৩৪ সাল রাতে বাড়ীতে যখন সে আহারে বসে সেই সময় দুই বিপ্লবী যুবক তার বাড়ীতে প্রবেশ করে তাকে শাণিত অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে চলে যান৷ তার স্ত্রী এসে দেখে তার স্বামীর মাথাটা পড়ে আছে থালার ওপর আর দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে মাষ্টারদার অনুগামীরা বিপ্লবের আগুনকে ক্রমশঃ ছড়িয়ে দিতে থাকে৷ সারা দেশে ১৯৩৪ সালে ১২ই জানুয়ারী রাতে মাষ্টারদার ফাঁসী হয়৷
মাষ্টারদার এই সংগ্রাম পরবর্তীকালে স্বাধীনতা যুদ্ধে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে৷ প্রতি বছর ২২শে এপ্রিল বিশাল বাহিনীর সঙ্গে মাষ্টারদা ও তাঁর অনুগামীদের অভূতপূর্ব লড়ইয়ের দিনটিকে জালালাবাদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়৷ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মাষ্টারদা ও তাঁর অনুগামীদের সংগ্রামের কাহিনী ও তাঁদের আত্মত্যাগ চিরকাল দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের নিরন্তন প্রেরণা হয়ে থাকবে |
- Log in to post comments