‘‘নিঃস্বার্থ প্রেষণায় হৃদয়ে মিলিলে হৃদয়
ধুলার ধরনী সততঃ হয় মধুময়৷’’
সুপ্রাচীনকাল থেকে আধ্যাত্মিকতার নিগড়ে বাঁধা হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের মিলন, প্রেম-প্রীতি, ত্যাগ-তিতিক্ষার আদর্শই ভারতবর্ষের সনাতন ঐতিহ্য৷ এই ঐতিহ্যের জন্যেই সুদীর্ঘকাল ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে এসেছে এই দেশে, আপন করে নিয়েছে এই দেশের মাটি, মানুষ ও সংস্কৃতিকে আর এদেশের মানুষও অতিথিদের নারায়ণ জ্ঞানে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছে৷ এই দেয়া-নেয়ার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে সুমহান ভারতবর্ষের মৈত্রী, শান্তি ও মহামিলনের পরম্পরা৷ তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘‘ভারততীর্থ’’ কবিতায় বলেছেন---
হেথা একদিন বিরামবিহীন মহা-ওঙ্কারধবনি
হৃদয়তন্ত্রে একের মন্ত্রে উঠেছিল রণরণি৷
তপস্যাবলে একের অনলে বহুরে আহুতি দিয়া
বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিল একটি বিরাট হিয়া৷
সেই সাধনার সে আরাধনার
যজ্ঞশালার খোলা আজি-দ্বার---
হেথায় সবারে হবে মিলিবারে আনত শিরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে৷৷
ভারতবর্ষের এই শাশ্বতরূপ সর্বজনীন ও সর্বকালীন৷ যদিও বেশ কিছুদিন ধরে অশুভ শক্তির দুষ্টচক্র বিশেষতঃ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কুটিল ষড়যন্ত্রে দলীয় স্বার্থ চরিতার্থকরণের অসৎ উদ্দেশ্যে বৃহত্তর জনসমুদায়ের মধ্যে বিভিন্ন জাত-পাত-গোষ্ঠী সম্প্রদায়-দল উপদলগত বিভাজনের নিরন্তর প্রচেষ্টা চলেছে ৷ নির্র্বচনী বৈতরণী পার হবার লক্ষ্যে মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ-সৃষ্টির চক্রান্ত ক্রমশঃ বিস্তার লাভ করেছে৷ এতদ্সত্ত্বেও কিছু কিছু ঘটনা প্রমাণ করে যে ভারতের সেই প্রেমপ্রীতি মিলন, ত্যাগ-সাধনার ঐতিহ্য সমস্ত বিভাজন বিদ্বেষের সীমা অতিক্রম করে মানুষের অন্তরে আজও দেদীপ্যমান৷ মানুষের সদিচ্ছা ও সৎপ্রচেষ্টা সমস্ত প্রতিকূলতার বাধা পেরিয়ে আর্ত্তমানুষের কষ্ট লাঘব করার আন্তরিক প্রয়াসের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ ২১শে মে ২০১৮ সোমবার কলকাতায় ফর্টিস হাসপাতালে হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থাপনা৷
প্রায় চল্লিশ বছর বয়সী ঝাড়খণ্ডের শিক্ষক দিলচাঁদ সিংহ দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্ট ও বুকের ব্যাথায় ভুগছিলেন৷ তাঁর হৃদযন্ত্র পরীক্ষা নিরীক্ষায় জানা যায়, হৃৎপিন্ডের পেশী ঠিকমত কাজ না করার ফলে দেহে রক্ত সঞ্চালন সম্ভব হচ্ছে না ও হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন প্রয়োজন৷
এমতাবস্থায় এমন একজনের হৃৎপিন্ডের দরকার যার রক্তের গ্রুপ ও শরীরের ওজন দিলচাঁদের সঙ্গে মিলবে৷ চিকিৎসকগণ উপযুক্ত দাতার সন্ধানে বিভিন্ন হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন৷ এই সময়েই সংবাদ আসে, বেঙ্গালুরুর একটি বেসরকারি হাসপাতালে রবিবার ২০শে মে দুর্ঘটনায় আহত এক যুবকের মস্তিষ্ক মৃত্যু বা ব্রেন-ডেথ হয়েছে ও তাঁর রক্ত গ্রুপ ওজন দিলচাঁদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে অর্থাৎ সেই যুবকের হৃৎপিন্ডটি দিলচাঁদের দেহে প্রতিস্থাপিত করা যেতে পারে৷ ফর্টিস হাসপাতাল কর্ত্তৃপক্ষ তাঁদের চেন্নাই শাখার সঙ্গে যোগাযোগ করে সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য স্বাস্থ্যদপ্তরের কাছে যথোচিত সাহায্যের আবেদন জানায়৷ রাজ্য সরকার ও তৎপরতার সঙ্গে বিমানবন্দর থেকে হাাতপাতাল পর্যন্ত গ্রীণ করিডরের ব্যবস্থা করে৷ পরের দিন সোমবার ভোর থেকে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ কে আর বালাকৃষ্ণণ ও কার্ডিয়াক অ্যানাস্থেসিস্ট সুভেশরা ও সোমবাার সকালে চলে আসেন৷ চেন্নাই-এর অপর একটি চিকিৎসক দল বেঙ্গালুরু গিয়ে হাসপাতাল থেকে মৃত যুবকের হৃৎপিন্ড সংগ্রহ করেন ও বিমানবন্দরে অবিলম্বে পৌঁছে যান৷ এক্ষেত্রে বিমানবন্দর কর্ত্তৃপক্ষ ও সবরকম সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন৷ বেঙ্গালুরু থেকে সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে বিমাান ছেড়ে বেলা ১১ টায় কলকাতা বিমানবন্দরে ওয়ান-বি-গেটের সামনে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত অবস্থায় অপেক্ষারত ছিল৷ বিমানটি কলকাতা বিমানবন্দরের পৌঁছানোর পরে বিমান -সেবিকাদের সহায়তায় চিকিৎসকদল হৃৎপিন্ডের বাক্সসহ সর্বপ্রথম নীচে নেমে আসেন ও বিমামকর্মীদের তৎপরতায় অ্যাম্বুলেন্সে উঠে ১১টা ৯মিনিটে গ্রীণ করিডর ধরে হাসপাতালের দিকে যাত্রা শুরু করেন৷ বিধাননগর সিটি পুলিশের তত্ত্ববধানে পাইলট কার অ্যাম্বুলেন্সকে ২০মিনিটের মধ্যে ১১টা ২৯ মিনিটে ফর্টিস হাসপাতালে পৌঁছে দেয়৷
হাসপাতালে চেন্নাইয়ের দুই বিশেষজ্ঞ ডঃ তাপস রায় চৌধুরী ডঃ কে এস মাওনা ও অন্যান্য সহযোগী চিকিৎসকগণ সর্বতোভাবে প্রস্তুত ছিলেন৷ হৃৎপিন্ড হাসপাতালে পৌঁছোবার সঙ্গে সঙ্গে বেলা ১১টা ৪০ মিনিট নাগাদ প্রতিস্থাপনের কাজ শুরু হয়ে যায় ও চলে প্রায় পাঁচ ঘন্টা৷ পূর্বভারতে এই প্রথম হৃৎপিন্ডের সফল প্রতিস্থাপন সম্ভব হল তিনটি রাজ্যের মানুষের সক্রিয় সহযোগিতায়৷
সর্বশেষ সংবাদ পাওয়া পর্যন্ত শ্রী দিলচাঁদ সিংহ সুস্থ হচ্ছেন, প্রতিস্থাপিত হৃৎপিন্ডটি স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করেছে৷ এর পরবর্ত্তী পর্র্যয়ে তাঁকে খুবই সাবধানে থাকতে হবে যাতে কোন রকম সংক্রমন না হয়৷ আশা রাখি , সকলের শুভেচ্ছায় দিলচাঁদ ক্রমশঃ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করবেন৷ কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল একজন মানুষের প্রাণ রক্ষার জন্যে তিনটি রাজ্যের বহু মানুষ, চিকিৎসকগণ, চিকিৎসাকর্মীবৃন্দ, বিমান বিভাগের সর্বস্তরের সহযোগিতা, পুলিশ-প্রশাসনের সর্বশক্তির সদুপযোগের সমবায়ের বিষয়টি৷ বেঙ্গালুরুর দুর্ঘটনায় ব্রেনডেথ হয়ে যাওয়া যুবকটির আত্মীয় পরিজনের সদিচ্ছায় দ্রুত হৃৎপিন্ডদানের সিদ্ধান্ত, তার অতিদ্রুত সংগ্রহের যুদ্ধকালীন তৎপরতা ও ঝাড়খন্ডের শিক্ষক দিলচাঁদ সিংহের দেহে প্রতিস্থাপন ---সবকিছু মিলে এক অভূতপূর্ব যোগসূত্র রচনা করেছে যা সত্যই হৃদয়ে আশা জাগায়, পারিপার্শ্বিকের ওপর ভরসা রাখতে প্রেরণা দেয়৷
কয়েকদিন আগে দ্বারভাঙ্গার একটি নার্সিংহোমে এস.এস.বি জওয়ান রমেশকুমার সিংহের স্ত্রী আরতি দেবী সন্তানের জন্ম দেন৷ কিন্তু সেই নবজাতকের জন্মের পরপরই অবস্থার অবনতি হতে থাকে৷ সেই শিশুকে বাঁচাতে গেল ‘ও’ নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন হয়ে পড়ে৷ পরিবারের সদস্যদের জানাশোনার মধ্যে কারও সেই গ্রুপের রক্ত না পাওয়ার ফলে শিশুটির জীবন সংকটপন্ন হয়ে ওঠে৷ নিরুপায় হয়ে তাঁরা ফেসবুক ও হোয়াটস্যাপে আবেদন জানান৷ সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দ্বারভাঙ্গারই বাসিন্দা মহম্মদ আসফাক সেই সংবাদ জানতে পারেন৷ ঘটনাক্রমে তার রক্তের গ্রুপও নেগেটিভ৷ তিনি সঙ্গে সঙ্গে নার্সিংহোমে পৌঁছে রক্তদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন৷ কিন্তু রমজান মাস চলায় তিনি উপবাসী ছিলেন--- সে কারণে চিকিৎসক রক্ত নিতে পারবেন না বলে জানান৷ অনন্যোপায় হয়ে আসফাক রোজা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেন ও নার্সিংহোমে খাবার গ্রহণ করে উপযুক্ত সময়ে রক্তদান করেন৷ শিশুটিও এর ফলে বেঁচে যায়৷ আসফাক জানান, ‘‘রোজা অন্য সময়ে ফের রাখা যেতে পারে৷ আসলে আল্লাই আমাকে দিয়ে এই কাজ করিয়ে নিয়েছেন৷’’ শিশুর প্রাণরক্ষায় মহম্মদ আসফাকের এই সিদ্ধান্ত ধর্মমতের সীমারেখা ছাড়িয়ে প্রকৃত মানবধর্মে পালনে আমাদের উৎসাহ প্রদান করে৷ কয়েকমাস আগে আসানসোল-রাণীগঞ্জ অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের উত্তপ্ত পরিবেশে একটি আবাসনের অধিবাসীরা ধর্মমত নির্বিশেষে একসঙ্গে বসবাস করছিলেন ও সেই উত্তেজনার ছিটেফোঁটাও তাঁদের স্পর্শ করেনি৷ তাঁরা নিজেদের মধ্যেকার সম্প্রীতি নষ্ট হতে দেননি৷ উপরিউক্ত টুকরো ঘটনাগুলি বর্ত্তমান ভারতের হিংসা, সন্ত্রাস, অসহিষ্ণুতার পরিবেশে জ্বলন্ত মরুপ্রদেশে মরূদ্যানসম৷ ভোটসর্বস্ব রাজনীতির যাঁতাকলে পড়ে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর চক্রান্তে, সমাজ আজ জাত-পাত-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ে বিভাজিত ও বিদ্বেষ বিষে জর্জরিত ৷ সাম্প্রদায়িক হানাহানির শিকার হয়ে বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন , সন্ত্রাসের বলি হয়েছেন৷ মেকী সম্মান প্রদর্শনের অছিলায় সাংসৃকতিক জগৎ, সিনেমা-প্রদর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও অশান্তি ও সন্ত্রাসের জাল বিস্তার করা হয়েছে৷ দেশের বহু রাজনৈতিক নেতা এই ঘটনাগুলিতে সক্রিয় ইন্ধনও জুগিয়েছেন ৷ দেশের মানুষের সার্বিক মঙ্গল অপেক্ষা তাঁরা দলীয় স্বার্থরক্ষার নিরতিশয় তৎপর৷ এইসব নেতানেত্রীর আচরণ দেখে মনে পড়ে মানবদরদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’’ কবিতার দু’টি পঙক্তি---‘‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র৷’’
ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্র্যভরা এই বিশাল দেশ ভারতবর্ষের বহিরঙ্গে কিছু পরিবর্তন হলেও রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, চৈতন্য, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, অরবিন্দের মাতৃভূমির গভীরে প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা-ত্যাগ,বৈরাগ্যের-ফল্গুধারা সততঃ প্রবাহিত৷ তাই বহু কলঙ্কময় চিত্রপটের মধ্যেও মানবতার মহান নির্দশন, মৈত্রী-সম্প্রীতি ও মিলনের অটুুট ঐতিহ্য অন্তঃসলিলা স্রোতস্বিনীর মত ভারতবাসীর অন্তরে শক্তি যোগায়, সমস্ত অশুভশক্তি পরাভূত করে হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের মিলন ঘটায়, সত্য ও সুন্দরের আলোকে হৃদয়-মন উদ্ভাসিত করে রাখে৷
- Log in to post comments