মহান ভারতবর্ষের কয়েকটি খণ্ডচিত্র

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

‘‘নিঃস্বার্থ প্রেষণায় হৃদয়ে মিলিলে হৃদয়

ধুলার ধরনী সততঃ হয় মধুময়৷’’

সুপ্রাচীনকাল থেকে আধ্যাত্মিকতার  নিগড়ে বাঁধা হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের মিলন, প্রেম-প্রীতি,  ত্যাগ-তিতিক্ষার আদর্শই ভারতবর্ষের  সনাতন    ঐতিহ্য৷ এই ঐতিহ্যের জন্যেই সুদীর্ঘকাল ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে  মানুষ ছুটে  এসেছে এই দেশে, আপন  করে নিয়েছে এই দেশের  মাটি, মানুষ ও সংস্কৃতিকে আর  এদেশের মানুষও অতিথিদের  নারায়ণ জ্ঞানে  সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছে৷ এই  দেয়া-নেয়ার মধ্য দিয়েই গড়ে  উঠেছে সুমহান ভারতবর্ষের  মৈত্রী, শান্তি ও মহামিলনের পরম্পরা৷ তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘‘ভারততীর্থ’’   কবিতায় বলেছেন---

হেথা একদিন বিরামবিহীন মহা-ওঙ্কারধবনি

হৃদয়তন্ত্রে একের মন্ত্রে উঠেছিল রণরণি৷

তপস্যাবলে একের অনলে  বহুরে আহুতি দিয়া

বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিল একটি বিরাট হিয়া৷

সেই সাধনার সে আরাধনার

যজ্ঞশালার খোলা আজি-দ্বার---

হেথায় সবারে হবে মিলিবারে আনত শিরে

এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে৷৷

ভারতবর্ষের এই শাশ্বতরূপ সর্বজনীন ও সর্বকালীন৷ যদিও বেশ কিছুদিন ধরে  অশুভ  শক্তির দুষ্টচক্র বিশেষতঃ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের  কুটিল ষড়যন্ত্রে দলীয় স্বার্থ চরিতার্থকরণের  অসৎ উদ্দেশ্যে বৃহত্তর জনসমুদায়ের  মধ্যে বিভিন্ন জাত-পাত-গোষ্ঠী সম্প্রদায়-দল উপদলগত বিভাজনের  নিরন্তর প্রচেষ্টা চলেছে ৷ নির্র্বচনী বৈতরণী পার হবার লক্ষ্যে     মানুষে মানুষে  দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ-সৃষ্টির চক্রান্ত ক্রমশঃ বিস্তার লাভ করেছে৷ এতদ্সত্ত্বেও কিছু কিছু ঘটনা প্রমাণ করে যে ভারতের সেই প্রেমপ্রীতি মিলন, ত্যাগ-সাধনার ঐতিহ্য সমস্ত বিভাজন বিদ্বেষের সীমা অতিক্রম করে  মানুষের অন্তরে  আজও দেদীপ্যমান৷ মানুষের সদিচ্ছা ও সৎপ্রচেষ্টা সমস্ত  প্রতিকূলতার  বাধা পেরিয়ে  আর্ত্তমানুষের  কষ্ট লাঘব করার আন্তরিক  প্রয়াসের  একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ ২১শে মে ২০১৮ সোমবার  কলকাতায় ফর্টিস হাসপাতালে হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থাপনা৷

প্রায় চল্লিশ বছর  বয়সী ঝাড়খণ্ডের শিক্ষক দিলচাঁদ  সিংহ  দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্ট ও বুকের ব্যাথায় ভুগছিলেন৷ তাঁর হৃদযন্ত্র পরীক্ষা নিরীক্ষায় জানা যায়, হৃৎপিন্ডের  পেশী ঠিকমত কাজ না করার ফলে দেহে  রক্ত সঞ্চালন  সম্ভব হচ্ছে না ও হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন প্রয়োজন৷

এমতাবস্থায় এমন একজনের  হৃৎপিন্ডের  দরকার  যার রক্তের গ্রুপ ও শরীরের ওজন  দিলচাঁদের  সঙ্গে  মিলবে৷  চিকিৎসকগণ উপযুক্ত দাতার  সন্ধানে  বিভিন্ন  হাসপাতালের  সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন৷  এই সময়েই  সংবাদ আসে, বেঙ্গালুরুর একটি বেসরকারি  হাসপাতালে রবিবার  ২০শে মে দুর্ঘটনায় আহত  এক যুবকের  মস্তিষ্ক মৃত্যু বা ব্রেন-ডেথ হয়েছে ও তাঁর  রক্ত গ্রুপ  ওজন  দিলচাঁদের  সঙ্গে  মিলে যাচ্ছে অর্থাৎ  সেই যুবকের  হৃৎপিন্ডটি  দিলচাঁদের  দেহে  প্রতিস্থাপিত করা যেতে পারে৷  ফর্টিস হাসপাতাল কর্ত্তৃপক্ষ তাঁদের  চেন্নাই  শাখার  সঙ্গে যোগাযোগ করে সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য স্বাস্থ্যদপ্তরের কাছে  যথোচিত সাহায্যের  আবেদন  জানায়৷ রাজ্য সরকার  ও তৎপরতার সঙ্গে বিমানবন্দর  থেকে হাাতপাতাল  পর্যন্ত  গ্রীণ করিডরের ব্যবস্থা করে৷ পরের দিন  সোমবার  ভোর থেকে  হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ কে আর বালাকৃষ্ণণ  ও কার্ডিয়াক অ্যানাস্থেসিস্ট সুভেশরা ও সোমবাার  সকালে চলে  আসেন৷  চেন্নাই-এর অপর একটি  চিকিৎসক দল  বেঙ্গালুরু গিয়ে  হাসপাতাল  থেকে মৃত যুবকের  হৃৎপিন্ড সংগ্রহ করেন ও বিমানবন্দরে অবিলম্বে পৌঁছে যান৷ এক্ষেত্রে বিমানবন্দর কর্ত্তৃপক্ষ ও সবরকম সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন৷ বেঙ্গালুরু থেকে  সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে  বিমাান ছেড়ে  বেলা ১১ টায় কলকাতা বিমানবন্দরে  ওয়ান-বি-গেটের সামনে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত  অবস্থায় অপেক্ষারত ছিল৷ বিমানটি কলকাতা বিমানবন্দরের পৌঁছানোর পরে বিমান -সেবিকাদের সহায়তায়  চিকিৎসকদল  হৃৎপিন্ডের বাক্সসহ সর্বপ্রথম নীচে নেমে আসেন ও বিমামকর্মীদের  তৎপরতায় অ্যাম্বুলেন্সে উঠে ১১টা ৯মিনিটে  গ্রীণ করিডর  ধরে হাসপাতালের দিকে  যাত্রা শুরু করেন৷  বিধাননগর  সিটি পুলিশের তত্ত্ববধানে  পাইলট  কার অ্যাম্বুলেন্সকে ২০মিনিটের মধ্যে ১১টা ২৯ মিনিটে ফর্টিস  হাসপাতালে পৌঁছে দেয়৷

হাসপাতালে  চেন্নাইয়ের  দুই বিশেষজ্ঞ ডঃ তাপস রায় চৌধুরী ডঃ  কে এস  মাওনা   ও অন্যান্য সহযোগী চিকিৎসকগণ  সর্বতোভাবে  প্রস্তুত  ছিলেন৷  হৃৎপিন্ড হাসপাতালে পৌঁছোবার  সঙ্গে সঙ্গে  বেলা  ১১টা ৪০ মিনিট নাগাদ  প্রতিস্থাপনের  কাজ  শুরু  হয়ে যায় ও চলে প্রায়  পাঁচ ঘন্টা৷ পূর্বভারতে এই প্রথম হৃৎপিন্ডের  সফল  প্রতিস্থাপন সম্ভব হল তিনটি রাজ্যের  মানুষের   সক্রিয় সহযোগিতায়৷

সর্বশেষ সংবাদ পাওয়া পর্যন্ত শ্রী দিলচাঁদ  সিংহ  সুস্থ হচ্ছেন, প্রতিস্থাপিত হৃৎপিন্ডটি  স্বাভাবিক কাজকর্ম  শুরু  করেছে৷ এর পরবর্ত্তী পর্র্যয়ে  তাঁকে খুবই  সাবধানে  থাকতে হবে  যাতে কোন রকম  সংক্রমন  না হয়৷  আশা রাখি , সকলের শুভেচ্ছায় দিলচাঁদ ক্রমশঃ সম্পূর্ণ সুস্থ  হয়ে উঠবেন ও স্বাভাবিক  জীবনযাপন  করবেন৷  কিন্তু  সবচেয়ে  বড় কথা  হল  একজন মানুষের প্রাণ রক্ষার  জন্যে তিনটি  রাজ্যের  বহু মানুষ,  চিকিৎসকগণ, চিকিৎসাকর্মীবৃন্দ, বিমান বিভাগের  সর্বস্তরের সহযোগিতা, পুলিশ-প্রশাসনের  সর্বশক্তির সদুপযোগের  সমবায়ের  বিষয়টি৷  বেঙ্গালুরুর দুর্ঘটনায় ব্রেনডেথ হয়ে যাওয়া যুবকটির  আত্মীয় পরিজনের  সদিচ্ছায় দ্রুত হৃৎপিন্ডদানের  সিদ্ধান্ত, তার অতিদ্রুত সংগ্রহের যুদ্ধকালীন তৎপরতা ও ঝাড়খন্ডের  শিক্ষক দিলচাঁদ সিংহের  দেহে প্রতিস্থাপন ---সবকিছু মিলে এক অভূতপূর্ব যোগসূত্র রচনা করেছে যা সত্যই হৃদয়ে আশা জাগায়, পারিপার্শ্বিকের ওপর ভরসা  রাখতে  প্রেরণা দেয়৷

কয়েকদিন আগে দ্বারভাঙ্গার একটি নার্সিংহোমে এস.এস.বি জওয়ান রমেশকুমার  সিংহের  স্ত্রী আরতি দেবী সন্তানের জন্ম দেন৷ কিন্তু সেই নবজাতকের জন্মের পরপরই  অবস্থার অবনতি হতে থাকে৷ সেই শিশুকে  বাঁচাতে  গেল ‘ও’ নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন হয়ে পড়ে৷ পরিবারের সদস্যদের  জানাশোনার  মধ্যে কারও সেই গ্রুপের  রক্ত না পাওয়ার  ফলে শিশুটির  জীবন সংকটপন্ন হয়ে ওঠে৷ নিরুপায় হয়ে তাঁরা  ফেসবুক ও হোয়াটস্যাপে আবেদন জানান৷ সোস্যাল মিডিয়ার  মাধ্যমে  দ্বারভাঙ্গারই বাসিন্দা মহম্মদ আসফাক সেই সংবাদ জানতে পারেন৷ ঘটনাক্রমে  তার রক্তের গ্রুপও নেগেটিভ৷  তিনি সঙ্গে সঙ্গে  নার্সিংহোমে পৌঁছে  রক্তদানের  ইচ্ছা  প্রকাশ করেন৷  কিন্তু রমজান মাস চলায় তিনি উপবাসী ছিলেন--- সে কারণে  চিকিৎসক রক্ত নিতে পারবেন  না বলে  জানান৷ অনন্যোপায়  হয়ে আসফাক রোজা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেন ও নার্সিংহোমে  খাবার  গ্রহণ করে উপযুক্ত সময়ে  রক্তদান করেন৷ শিশুটিও এর ফলে বেঁচে যায়৷ আসফাক জানান, ‘‘রোজা অন্য সময়ে ফের রাখা যেতে পারে৷  আসলে আল্লাই আমাকে  দিয়ে এই কাজ করিয়ে নিয়েছেন৷’’ শিশুর প্রাণরক্ষায় মহম্মদ আসফাকের  এই সিদ্ধান্ত ধর্মমতের  সীমারেখা ছাড়িয়ে প্রকৃত মানবধর্মে পালনে  আমাদের উৎসাহ প্রদান করে৷ কয়েকমাস আগে আসানসোল-রাণীগঞ্জ অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের উত্তপ্ত পরিবেশে  একটি  আবাসনের  অধিবাসীরা ধর্মমত নির্বিশেষে  একসঙ্গে  বসবাস  করছিলেন ও  সেই উত্তেজনার  ছিটেফোঁটাও তাঁদের  স্পর্শ করেনি৷  তাঁরা  নিজেদের  মধ্যেকার সম্প্রীতি নষ্ট হতে দেননি৷ উপরিউক্ত টুকরো  ঘটনাগুলি বর্ত্তমান ভারতের হিংসা, সন্ত্রাস, অসহিষ্ণুতার  পরিবেশে  জ্বলন্ত মরুপ্রদেশে  মরূদ্যানসম৷ ভোটসর্বস্ব রাজনীতির  যাঁতাকলে  পড়ে রাজনৈতিক  নেতা-নেত্রীর চক্রান্তে, সমাজ আজ জাত-পাত-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ে বিভাজিত ও বিদ্বেষ বিষে জর্জরিত ৷ সাম্প্রদায়িক হানাহানির শিকার  হয়ে বহু মানুষ  মৃত্যুবরণ করেছেন , সন্ত্রাসের বলি হয়েছেন৷  মেকী সম্মান প্রদর্শনের অছিলায়  সাংসৃকতিক জগৎ, সিনেমা-প্রদর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও অশান্তি ও সন্ত্রাসের  জাল বিস্তার  করা হয়েছে৷  দেশের  বহু রাজনৈতিক নেতা এই ঘটনাগুলিতে  সক্রিয় ইন্ধনও জুগিয়েছেন ৷ দেশের  মানুষের  সার্বিক মঙ্গল অপেক্ষা  তাঁরা  দলীয়  স্বার্থরক্ষার নিরতিশয় তৎপর৷  এইসব নেতানেত্রীর  আচরণ দেখে  মনে পড়ে মানবদরদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের  ‘‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’’ কবিতার দু’টি পঙক্তি---‘‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে  কোন জন?  কাণ্ডারী! বল ডুবিছে  মানুষ, সন্তান মোর মা’র৷’’

ভাষা-সংস্কৃতির  বৈচিত্র্যভরা এই বিশাল দেশ ভারতবর্ষের  বহিরঙ্গে কিছু পরিবর্তন হলেও রবীন্দ্রনাথ,  নজরুল, চৈতন্য, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, অরবিন্দের  মাতৃভূমির গভীরে প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা-ত্যাগ,বৈরাগ্যের-ফল্গুধারা  সততঃ  প্রবাহিত৷ তাই বহু কলঙ্কময় চিত্রপটের মধ্যেও মানবতার  মহান নির্দশন, মৈত্রী-সম্প্রীতি ও মিলনের  অটুুট ঐতিহ্য অন্তঃসলিলা স্রোতস্বিনীর  মত ভারতবাসীর  অন্তরে শক্তি যোগায়, সমস্ত অশুভশক্তি পরাভূত করে হৃদয়ের  সাথে  হৃদয়ের  মিলন ঘটায়, সত্য ও সুন্দরের আলোকে হৃদয়-মন উদ্ভাসিত করে রাখে৷