নারীনির্যাতন ও কিছু কথা

লেখক
শ্রীপার্থ

দিকে দিকে নারী নির্যাতন, নারীর শ্লীলতাহানি, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ও খুনের বিরুদ্ধে সর্বত্রই প্রতিবাদ আন্দোলন সংঘটিত হচ্ছে৷ সাধারণ মানুষ থেকে বুদ্ধিজীবী সকলেই এসব ঘটনার বিরুদ্ধে সরব৷ মৌন মিছিল, মোমবাতি মিছিল থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে দরবার সবই হচ্ছে৷ এসব পাশবিক ঘটনার প্রতিবাদে পাশবিকতার বিরুদ্ধে জনসাধারণের এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ নিঃসন্দেহে একটা ভালো দিক৷ মানূুষের এই শুভ উদ্যোগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি কেউই কিন্তু এই ধরণের জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে যে মূল কারণগুলি নিহিত আছে সেগুলির ব্যাপারে বিশেষ আলোকপাত করতে চাইছেন না বা করছেন না৷ আর এখানেই রয়ে যাচ্ছে ত্রুটি৷ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর অপরাধীর যাবজ্জীবন বা ফাঁসির দাবী যেমন যথার্থ তেমনই এ ধরণের অপরাধ করার মানসিকতা যাতে তৈরী না হয় সে ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়ার দরকার সর্বাগ্রে৷

মন প্রধান জীব মানুষ৷ মনের উপর তার নিয়ন্ত্রণ  হারিয়ে ফেলছে বলেই এ ধরণের জঘন্য অপরাধমূলক করে ফেলছে৷ মনের মধ্যে আছে নানান বৃত্তি ও রিপুর প্রাবল্য৷ কিছু বৃত্তি যেমন দয়া, সদিচ্ছা, বিবেক ইত্যাদি মানুষের মনকে শুভের দিকে পরিচালিত করে, আবার কিছু বৃত্তি নীচের দিকে নামিয়ে নিয়ে যায়৷ এগুলোকে সাধারণত আমরা কু–বৃত্তি বলে থাকি৷ মন যেমন চায় মানুষের কাজকর্ম তেমনই হয়৷ তাই মন যাতে সবসময় শুভভাবনা নিতে পারে সেই চেষ্টা মানুষকে করতে হবে৷ কারণ শুভ ভাবনাই জন্ম দেবে শুভ কর্মের৷ আর শুভকর্মের ফল কখনও সমাজের বুকে অশুভ প্রভাব ফেলবে না৷ মনের কু–বৃত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ  ও শুভ বৃত্তিগুলিকে শক্তিশালী করে তুলতে হলে অল্প বয়স থেকেই মানুষকে যোগাভ্যাস করতে হবে৷ যোগাসন করার পাশাপাশি ধ্যানের অনুশীলনও করতে হবে৷ এছাড়াও  শিক্ষা–প্রতিষ্ঠানগুলি নীতিশিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে৷ শারীরিক–মানসিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য যোগাসন, ক্যারাটে, জুডো শিক্ষা (বিশেষতঃ ছাত্রাদের জন্য) শিক্ষা–প্রতিষ্ঠানগুলি বাধ্যতামূলক করতে হবে, এর সুফল পেতে একটু সময় লাগলেও আগামী দিনে সুস্থ ও সুন্দর নাগরিক গড়ে তুলতে এছাড়া বিকল্প আর কিছুই নেই৷

মহিলাদের প্রতি অশালীন আচরণের ঘটনার পেছনে পরোক্ষ কারণ হিসাবে কাজ করছে অশ্লীল নারীদেহ সর্বস্ব বিজ্ঞাপন৷ এই বিজ্ঞাপন বহুল প্রচারিত বিভিন্ন সংবাদপত্র, সাময়িক পত্র,  টেলিভিশান ছাড়াও রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন হোর্ডিংয়ে শোভা পাচ্ছে৷ এই ধরণের বিজ্ঞাপন যে সর্বত্র শোভা পাচ্ছে এ বিষয়ে বুদ্ধিজীবীদের কিন্তু কোন প্রতিবাদ নেই৷ গণমাধ্যম–যারা নারী নির্যাতন, ধর্ষণ প্রভৃতি ঘটনার বিরুদ্ধে সবচেয়ে সরব, তারাও তো তাদের সংবাদপত্রে বা চ্যানেলে এই ধরণের অশ্লীল বিজ্ঞাপনের প্রদর্শন বন্ধ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে না? যৌন আবেদনমূলক এই ধরণের বিজ্ঞাপন যে একশ্রেণীর যুবক–যুবতীকে বিপথগামী করে তুলছে – এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই৷ কিন্তু এ ব্যাপারে কি সংবাদমাধ্যম, কি বুদ্ধিজীবী কারও কোনও সদর্থক ভূমিকা নেই৷ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন অল্প কিছু মানুষ বা সংগঠন এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেও বিখ্যাত গণমাধ্যমগুলি সে গুলির খবর সযত্নে এড়িয়ে যায়৷ তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি একশ্রেণীর গণমাধ্যমও নারী স্বাধীনতার নামে এই ধরণের অশ্লীল বিজ্ঞাপন প্রদর্শনে মদত দিচ্ছে? সবচেয়ে বিস্ময় লাগে আমার – মহিলারা, যাঁরা বিপথগামী একশ্রেণীর পুরুষের লালসার শিকার হচ্ছেন, কই তাঁরাও তো সংঘবদ্ধভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে বলছেন না – এ ধরণের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন চলবে না  আইন করে এ ধরণের বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে হবে৷ আমার বিশ্বাস মহিলারা যদি এ বিষয়ে উদ্যোগী হন ও তাঁরা নিজেরা এই ধরণের বিজ্ঞাপনে বা চলচ্চিত্রে নগ্ণ দেহ প্রদর্শন করবেন না বলে দৃৃপ্রতিজ্ঞ হন তাহলে অবস্থার পরিবর্তন হতে বাধ্য৷

একটা সুস্থ–সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে হলে সকলকেই সচেষ্ট হতে হবে৷ একে অপরের বিরুদ্ধে শুধু দোষারোপ করে কিংবা মোমবাতি মিছিল করে বা চ্যানেলে চ্যানেলে বসে গালভরা বিবৃতি দিলে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়৷

আসুন, নারীদের মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে প্রথমে সবাই মিলে আওয়াজ তুলি – ‘‘নারীদেহ সর্বস্ব অশ্লীল বিজ্ঞাপন ও চলচ্চিত্রে প্রদর্শন করা চলবে না৷’’