দেখতে দেখতে একটা গোটা বছর আমরা কাটিয়ে ফেললাম৷ বিদায় নেওয়ার পালা ১৪২৪৷ অন্যদিকে দরজায় কড়া নাড়ছে ১৪২৫৷ বাঙ্গালীর কাছে ১লা বৈশাখ দিনটি একটি মাত্রা নিয়ে আসে৷ যদিও পরিতাপের বিষয় যে ইংরেজী নববর্ষকে নিয়ে বিশ্ববাসীর যে উন্মাদনা দেখা যায় তাঁর বিন্দুমাত্র বাংলা নববর্ষের কপালে জোটে না৷ জুটবেই বা কেন এ যে নেহাৎ ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পান না’র মত দশা৷ আমরা বাঙালীরা যতটা ধুমধামের সঙ্গে ইংরেজী নববর্ষ উদযাপন করি বাংলা নববর্ষের বেলায় ততটা অবহেলা করি৷ বাঙালী আত্মবিস্মৃত জাতি হিসেবে নিজেকে দেখতে ও দেখাতে খুশি হয়৷ কিছুদিন হল আমরা ২১শে ফেব্রুয়ারীর স্মরণে নানা উৎসব অনুষ্ঠান করলাম৷ ‘বাংলা আমার প্রাণের ভাষা’ বলে চোখ থেকে দুফোঁটা জলও ফেললাম৷ কিন্তু কোথায় কি কটা দিন কাটতে না কাটতেই আবার সবকিছু স্বাভাবিক৷ অথচ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের খাঁটি বাঙালী প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠি৷ কোন কোন T.V Channel এ আবার শ্লোগান দেয় ‘ষোলআনা বাঙালী মানা’৷ বিশ্বায়নের প্রভাবেই হোক বা নিজেদের জাতিগত ঐতিহ্যকে বহন করতে না পারার অক্ষমতা হোক বাঙালীর আজ চরম দুর্দশার দিন৷ যতদিন যাচ্ছে তত আমরা নিজেদের ভাষা–সাহিত্য–সংস্কৃতি ভুলে অন্য ভাষা–সংসৃক্তির পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠছি, আমরা ভুলে গেছি একদিন এই বাংলার বুকে রবিঠাকুর গান ধরেছিলেন৷ ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি৷’ বা বিশশতকের অন্যতম কবি জীবনানন্দ বলেছিলেন–‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি / পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে চাই না আর’ বাঙ্গালীর জীবনচর্যার অভিজ্ঞানে বিদেশী আদব কায়দা খুব সহজেই গ্রহণ করা হয়েছে৷ হয়তো একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইংরেজী মাসের নিরীখেই স্কুল–কলেজ–ফিস–আ কর্মসূচী রাপায়িত হয়ে থাকে৷ তাই হয়তো বাংলা তারিখ জানাটা অত গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ কিন্তু সমস্ত কিছুকেই যদি কাজের সুবিধার্থে সহজ করে নেওয়া হয় তাহলে আখেরে তো নিজেরই ক্ষতি হয়৷ অন্যটা যেমন কাজের জন্য জরুরী তেমনি অকাজের জন্যেও না হয় কিছু তো একটা করা জরুরী৷ একবার ভেবে দেখুন তো ২৫ বৈশাখ বলতে বা শুনতে যে আত্মীয়তার সুর মনের সেতারে বেজে ওঠে সেটাকি কোন ইংরেজী তারিখের মধ্যে পাওয়া যায়?
বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বাংলা তারিখটা তো দূরের কথা, বাংলা সালটিও হয়তো ঠিক করে বলতে পারবে না৷ কেন আমরা যুগের প্রয়োজনে একটা বিষয়কে যতটা প্রাধান্য দেবো অন্য বিষয়টিকে ততটাই অবহেলা করবো?
এবার আমাদের সংসৃক্তির দিকে চোখ ফেরানো যেতে পারে৷ এই যেসব চলচ্চিত্র গুলো নির্মাণ করা হচ্ছে তার মধ্যে বাঙালীয়ানার বিন্দু–বিসর্গও দেখা নেই৷ বাংলাগানের মধ্যে হিন্দী গানের লাইন৷ বাঙালী পোশাক আসাক, খাদ্যাভাস সব কিছুই বর্জিত৷ – আর ঠিক এই জায়গা থেকেই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে৷ আমাদের স্বাজাত্যাভিমানকে বিসর্জন দিলে চলবে কেন? সুস্থ সংসৃক্তি চর্চার ধারক ও বাহক হিসেবে যে বাঙালীর একদিন সুখ্যাতির শেষ ছিল আজ তার পরিণাম ঘটেছে৷ এই অবনমন কি চলতেই থাকবে? বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চয় এর উত্তর খুঁজবেন৷
আমাদের বলার কথা যেটা হল বাঙালী অবশ্যই বিদেশ পাড়ি দেবে, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, আরো অনেক কিছুই করবে কিন্তু যেটা করবে না সেটা হল নিজের জাতিগত অস্তিত্বকে বিসর্জন দেবে না৷ এবারের নববর্ষে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার৷
- Log in to post comments