ন্যুনতম  চাহিদাপূরণের গ্যারান্টী চাই

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

সম্প্রতি পূর্ব-দিল্লির  মন্দাওয়ালিতে  একই পরিবারের ৩ জন শিশুর  অনাহার মৃত্যুর ঘটনার  খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত  হওয়ার পর  সারা দেশজুড়ে  তোলপাড়  শুরু হয়েছে৷ গত ২৪শে জুলাই দিল্লির  লালবাহাদুর  শাস্ত্রী হাসপাতালে  এই তিন শিশুকে  ভর্তি  করাতে গেলে  তাঁরা  শিশু তিনটিকে  মৃত বলে ঘোষণা করেন৷  চিকিৎসকগণ  পোষ্টমর্টেম করে বলেন,  অনাহারের কারণেই  এদের মৃত্যু হয়েছে৷ এদের পেটে  এক দানা খাদ্যও ছিলনা৷ জানা গেছে  ৯/১০দিন  যাবৎই  এরা অনাহারে  ছিল৷

এদের বাবা মঙ্গল আসলে পূর্ব মেদিনীপুরের বাসিন্দা৷ ১৫ বছর  আগে জীবিকার সন্ধানে  সে দিল্লি যায়৷ সেখানে  গিয়ে রিক্সা চালিয়ে জীবিকা অর্জন করত৷ সেখানে সে বিয়েও করে৷ তিনকন্যা হয়৷  শিশুদের  মায়ের নাম বীণা দেবী৷  তিনি এখন  মানসিক রোগী বলে জানা গেছে, কিছুদিন আগে মঙ্গলের রিক্সাটা (ভাড়ার রিক্সা) চুরি  হয়ে যায়৷  তারপর থেকে  আর কাজ নেই৷ জীবিকার সন্ধানে এখানে ওখানে  ঘুরে বেড়াতে থাকে৷  ফলে টানা ৯/১০ দিন  ওই শিশুদের অনাহারেই থাকতে হয়৷  এই অবস্থায়  ৩ শিশুরই মৃত্যু হয়৷  মা মানসিক  রোগী তার তেমন হুঁশও নেই৷

এই তো আমাদের ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লির  চিত্র! বলাবাহুল্য এটা খোদ রাজধানীর  ঘটনা৷ তাই  সঙ্গে সঙ্গেই এ খবর  প্রকাশিত হতে পেরেছে৷ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে  বিভিন্ন রাজ্যের প্রত্যন্ত পাড়াগাঁয়ের  কত আবালবৃদ্ধ  বণিতারই যে এমনি  অনাহারে মৃত্যু ঘটছে, তার হিসেব কে রাখে?

ইন্টারন্যাশন্যাল ফুড পলিসি  রিসার্চ ইন্সটিটিউটের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের ক্ষুধা সূচকে ভারতেব স্থান ১০০ নম্বরে৷ এই ভারতের সূচকে চীন  স্থান ২৯ নম্বরে৷ বাংলাদেশের স্থান ৮৮ নম্বরে৷ মায়ানমারের স্থান ৭৭ নম্বরে৷ পাকিস্তানের স্থান ১০৬ নম্বরে৷ নম্বর  যতো কম হবে  তার মানে  অনাহারে মৃত্যুর হার কম৷ যতো  নম্বর  বেশী মানে অনাহার  মৃত্যুর  হার বেশি৷  অর্থাৎ  এ ব্যাপারে  ভারতের  অবস্থা বাংলাদেশ ও মায়ানামারের চেয়েও খারাপ৷

কিন্তু  ভারতের  প্রধানমন্ত্রী তো দাবী করেন, ভারত দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ৷ ভারতের  উন্নয়নের  চাকা নাকি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে৷ এই হচ্ছে দ্রুত গতিতে উন্নয়নের নমুনা !

ভারত সরকারের পরিসংখ্যানে জানা যায়, ভারতের  সমস্ত  মানুষের  পেটভরে খাওয়ার  জন্যে  প্রতি বছর  গড়ে ২২.৫ থেকে  ২৩ কোটি  টন  খাদ্যশস্যের  প্রয়োজন৷ আর ভারতে  উৎপাদন হয় (২০১৬ সালের  হিসেব) ২৭.৩ কোটি টন৷ তার মানে উৎপাদনের  দিক থেকে উদ্বৃত্ত৷ কিন্তু  তবু এত  অনাহার  মৃত্যু কেন?  বন্টনের  সুব্যবস্থা নেই৷

আন্তর্জাতিক  খ্যাতি সম্পন্ন দারিদ্র্য বিরোধী এক এন.জি.ও ‘অক্সফ্যামে’র  এক রিপোর্ট  থেকে জানা যাচ্ছে, পৃথিবীর  মাত্র  ১ শতাংশ ধণিক শ্রেণীর  হাতে  রয়েছে৷ বর্তমানে  পৃথিবীর  প্রায় ৫০ শতাংশ  সম্পদ৷ ‘ফোবস্’  পত্রিকায়  প্রকাশিত  সংবাদে  জানা যায়,  গত ১০ বছরে ভারতের  কোটিপতির  সংখ্যা বেড়েছে ১০গুণ৷  অপরদিকে  ভারতের  প্রায় ২৭ কোটি  মানুষকে  ক্ষুধা নিয়ে রাতে ঘুমুতে  হয়৷  আর  বছরে  প্রায় ২ কোটি  মানুষের মৃত্যুর কারণ  ক্ষুধা তথা  অপুষ্টি জনিত  রোগ৷

নীতিগতভাবে  তত্ত্বগতভাবে বলতে হয়, এই বিশ্বের সমস্ত সম্পদের মালিক  বিশ্বস্রষ্টা--- ঈশ্বর৷ ঈশ্বরের সন্তান  হিসেবে পিতার  সম্পদে  বা সম্পত্তিতে সমস্ত  সন্তানেরই  ন্যায্য অধিকার  বর্তায়৷  তাই পৃথিবীর  সমস্ত  সম্পদে  বিশ্বের সমস্ত মানুষের  যৌথ অধিকার  রয়েছে৷ ঈশ্বর বা প্রকৃতি  কারুর  নামে কোনো সম্পদ  বা সম্পতি  রেজেষ্ট্রি করে দেননি৷ তাহলে  কেন,  বিশ্বের কিছু মানুষ বিশাল পরিমাণ  সম্পদ  কুক্ষিগত  করে নিজের জিম্বায় আটকে  রাখবে,  আর কোটি কোটি মানুষকে  ক্ষুধার  জ্বালায় শুকিয়ে মরতে হবে?  এটা ঘোরতর অন্যায়৷ 

তাহলে বিভিন্ন দেশের  সরকারগুলি কী করছে? ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্যেই  তো তাদের  হাতে  শাসনক্ষমতা  অর্পিত হয়েছে৷ কিন্তু  তারা তো বঞ্চিতদের পাশে  না দাঁড়িয়ে  শোষকগোষ্ঠীর তাঁবেদারি করছে  ও  তাদের  কৃপাকণা লাভে নিজেদের ধন্য মনে  করছে৷

বর্তমান ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি ব্যবস্থা--- যা প্রায় সমস্ত  দেশেই  চলছে--- সর্বক্ষেত্রে  প্রায় এইটাই  চলছে৷  মার্কসবাদী কম্যুনিষ্ট সরকারগুলি বিভিন্ন  দেশে  নিজেদের সর্বহারার সরকার  বলে  দাবী করলে ও আসলে মার্কসবাদও রাষ্ট্রীয়  ধণতন্ত্র৷ কারণ এইসব দেশেও অর্থনৈতিক  ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত  থাকে  সরকারের হাতে  অর্থাৎ শাসকগোষ্ঠীর হাতে৷ প্রকৃতপক্ষে  জনগণের  হাতে  অর্থনৈতিক  ক্ষমতার  বিকেন্দ্রীকরণ হয় না৷ তাই জনগণ প্রকৃতপক্ষে  নানানভাবেই  শোষণ ও বঞ্চনার  শিকার  থেকেই  যায়৷

তাই  মহান্ দার্শনিক  শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার  এক নোতুন যুগান্তকারী সামাজিক  অর্থনৈতিক  তত্ত্বের প্রবর্তন  করেছেন--- যার নাম ‘প্রাউট’৷  এই প্রাউটে  তিনি  প্রকৃত ‘অর্থনৈতিক  গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার  ওপর  সমধিক  গুরুত্ব দিয়েছেন৷  এই অর্থনীতি ব্যবস্থায় বিশ্বের  প্রতিটি মানুষেরই  ন্যূনতম চাহিদা পূরণের  অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের  গ্যারান্টী দেওয়ার  প্রতিশ্রুতি  রয়েছে৷ তার সঙ্গে  সঙ্গে যুগের চাহিদা অনুযায়ী সকলের  ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিরও গ্যারান্টী দেওয়া হচ্ছে৷

আজ তাই প্রতিটি সমাজ সচেতন মানুষকে প্রকৃত মানবতাবাদী এই যুগান্তকারী সামাজিক-অর্থনৈতিক দর্শন  প্রাউটকে  জেনে একে  বাস্তবায়িত করার জন্যে  উদ্যোগী হতে উদাত্ত আহ্বান জানাই৷