প্রভাতরঞ্জনের  মননে গন্ধ পরিক্রমা

লেখক
সমরেন্দ্রনাথ ভৌমিক

পরম পূজ্য ‘ৰাৰা’ (শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার) ‘গন্ধ্’ ধাতুটির ১২টি অর্থ ও ব্যাখ্য করেছেন৷ কিন্তু এই ১২টি অর্থ বলেই ৰাৰা থেমে যান নি৷  অনেকের মনে হতে পারে তাঁর এই জ্ঞান-ভান্ডার স্কুল-কলেজের  অধ্যয়নের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে অথবা বিভিন্ন পুস্তক অধ্যয়ন ক’রে অর্জিত হয়েছে৷ কিন্তু যাঁরা ৰাৰার সান্নিধ্যে অনুক্ষণ রয়েছেন তাঁরা প্রত্যেকেই নিশ্চিতভাবেই জানেন যে, ৰাৰার ঘরে কোনওদিনই কোন পুস্তকই নেই৷ ঘরে তো দূরের কথা, পৃথিবীতে কোন  মহান ব্যষ্টি এধরণের  পুস্তক এখনও লেখেন  নি৷ এ সবই  জন্মার্জিত৷

এখন তাঁর রচিত ‘শব্দচয়নিকা’ গ্রন্থে অষ্টাদশ পর্বে ৰাৰা ‘গন্ধ’ শব্দটির ২৩ টি  অর্থ দিয়েছেন, তিনি যেভাবে অর্থগুলি দিয়েছেন, সেই অর্থগুলি চয়ন করে সুধী পাঠকবৃন্দের সমক্ষে উপস্থাপিত করছি---

গন্ধ  ঃ  গন্ধ্+ অচ্= গন্ধ ৷

(১) ‘গন্ধ’ শব্দের একটি অর্থ হ’ল যা বিরক্তিকারক ও কষ্টদায়ক৷ তোমরা হয়তো ভাবতে পার গন্ধ আবার কষ্ট দেবে কেন৷  হ্যাঁ, সত্যিই কোন চড়াপচা বা পূতিগন্ধ তোমাকে খুবই কষ্ট দেয়৷ কোথাও যদি তুমি দূর থেকে পথিপার্শ্বস্থ কোন জীবদেহ Caracass  অনেকেCarcass বলেন৷ সেটা কিন্তু ভুল করে বলেন৷ ডিকশনারীতেও অনেক সময়  বানানটিতে  ভুলের অনুরণন ঘটে৷ শব্দটি ল্যাতিন থেকে আসা  মূলতঃ  আইবেরিয়ান৷ তাইCaracass-ই হবে) দেখ তাঁর দুর্গন্ধ কি তোমায় আহত করে না?  নিশ্চয়ই করে৷

(২) যদি কারো আঁতে ঘা দিয়ে কোন কথা বলা হ’ল সেই কথাটাকেও বলা হবে ‘গন্ধ কথা’ বা ‘গন্ধোক্তি’৷ ধরো, রাম যদি সীতাকে বলেন --- ‘‘সীতা তুমি রাবণের অশোকবাটিকায় নিশ্চয় আনন্দেই ছিলে’’৷ সীতা তার উত্তরে হয়তো বললেন--- ‘‘রাম, তোমার এই গন্ধোক্তি আমার সহ্য হচ্ছে না’’৷

(৩) হনুমতা বালি ঃ গন্ধীকৃতঃ অর্র্থৎ হনুমান বালিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেদিয়েছিল৷ ‘গন্ধ’ শব্দের অর্থ হল ধাক্কা৷

(৪) ‘গন্ধিত ঃ রামেন রাবণঃ’ অর্র্থৎ রাম কর্তৃক রাবণ নিহত হয়েছিল৷ এখানে গন্ধ মানে নিধন৷

(৫) বায়ুতে চম্পক সুরভি প্রবাহিত হচ্ছে অথবা বায়ুতে কেতকীকেশর প্রবাহিত হচ্ছে৷ একথা না বলে বলতে পার ‘‘বায়ুতে চাঁপার গন্ধ পাচ্ছি কেতকী কেশরের গন্ধ পাচ্ছি৷’’  আমরা যখনই কোন বস্তুর গন্ধ পাই তার মানে বায়ুভরে সেই বস্তুর গন্ধরেণু প্রবাহিত হচ্ছে৷ যে সকল বস্তু বা ফুলের রেণু একটু ভারী তা হালকা বায়ুতে প্রবাহিত হয় না৷ হয় বায়ুর ভারী অবস্থায়৷  একই ফুলের রেণু গ্রীষ্মকালে দিনের বেলায় তার গন্ধ নাসিকাগ্রে পৌঁছায় না কারণ গরম কালে হাওয়া সূর্যতাপে হাল্কা হয়ে যায়৷ তাই তারা ভারী গন্ধরেণু বহন করতে পারে না৷ রজনীগন্ধা, শিউলির গন্ধরেণু বেশী ভারী৷ চাঁপাফুল  ছোট হলে কী হবে--- গন্ধরেণু ভারী৷ তাই দিনের বেলায় রজনীগন্ধা, শিউলির গন্ধ পাবেই না৷ রাত্রিতে কিছুটা শীতলতায় হাওয়া ভারী হয়ে যায়৷ তখনই এদের গন্ধ পাওয়া যাবে৷

যঁুই বা রজনীগন্ধার গন্ধ দিনের বেলায় পাই বটে, তবে খুবই কম রাত্রিতেই বেশী পাই৷ ভারী গন্ধরেণু যুক্ত হওয়ায় বকুল, শিউলি ওরা রাত্রিতেই  ফোটে দিনের বেলায় ঝরে পড়ে৷ দিনের আলো হাওয়ার চাপে তার বোঁটা আলগা করে ঝরিয়ে দেয়৷

‘‘রাতেরবেলায় সবাই ঘুমায় শিউলি কেন জাগে৷

বলতে হবে মাগো আমায় বলতে হবেই আগে৷

আর ফুলেরা দিনে জাগে রাত্তিরে ঘুমায়,

দিনের বেলায় সুবাস ঢালে মধুতে গান গায়৷

তাদের সাথে মোর পরিচয় আলোর অনুরাগে৷

ঘুমায় ময়না কুকুরছানা যে মউমাছি

শিউলি তরু হেসে বলে আমি জেগে আছি৷

রাতের শেষে শিউলি ঝরে

---------ঘুমটি যাবে তোর৷৷’’

---প্রভাত সঙ্গীত

(৬) যে ফুল যখন ফোটবার, বায়ুর ধাক্কায় ঠিক সময়টাতেই সে ফুটে যায় অর্থাৎ বায়ু ফুলটিকে চিরে দেয়৷ এই জন্যে গন্ধ বললে বায়ুকেও বোঝায়৷  আবার বায়ু গন্ধ বহন করে বলে গন্ধবহ বলতে বায়ুকেও বোঝায়৷ গন্ধবহ, প্রিয় গন্ধ বহন করে আনো’’---‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’৷

(৭)‘‘রামঃ আম্রং গন্ধয়তে’’--- আঁবের খোলা ছাড়াচ্ছেন ৷ এই খোলা ছাড়ানো আঁবকে বলা হবে--- ‘‘গন্ধফলম্’’৷  আর যার খোলা ছাড়ানো হয়নি সে ফলকে  বলব ‘‘খোলকফলম্’’৷

(৮) আবার ধরো আরশোলা মারার জন্য যদি কেউ  ছড়িয়ে দিচ্ছেন৷ এই ছড়িয়ে দেওয়া গ্যামাক্সিন বা ডি .ডি .টি-কে বলব ‘গন্ধ’৷

(৯) তিনি মধুকর..... মাধুকরী বৃত্তিতে আছেন৷ তাই তিনি গৃহস্থ বাড়ির সামনে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে দাঁড়াবেন না৷ গন্ধবৃত্তি তাঁর নয় অর্র্থৎ ‘ভিক্ষাং দেহি.....‘চাট্টি ভিক্ষা পাব মা ঠাকুরন’ বলবেন না৷

(১০) আজকে শিশুর অন্নপ্রাশনের দিন কিনা৷  তার  বোন তার মুখে চন্দন-গন্ধ লেপে দিচ্ছে৷ এখানে গন্ধ  মানে বাটা-চন্দন৷

(১১) তিল অন্যের গন্ধ তাড়াতাড়ি  গ্রহণ করে৷  সেজন্য তিলের একটি বিশেষ নামই হল গন্ধ৷ তিলের সংস্পর্শে যদি গোলাপের জিনিস রাখা হয় তবে সেই তিলে গোলাপের গন্ধ আসবে৷ এক্ষেত্রে সেই তিল  সীবন্তিগন্ধ’৷  ‘সীবন্তিগন্ধযুক্ত তিল’--- এত কথা না বললেও চলবে৷

(১২) ‘গন্ধ’ শব্দের আরেকটি অর্থ হ’ল আত্মীয়৷

(১৩)  ‘গন্ধ’ শব্দের আরেকটি মানে হ’ল দুর্বিনীত .... উদ্ধত৷

(১৪)  ‘গন্ধ’ শব্দের  অন্য একটি মানে হ’ল অহঙ্কারী... দেমাকী৷

(১৫) ‘গন্ধ’ শব্দের  আরেকটি অর্থ হ’ল একটুখানি.... অত্যন্ত অল্প মাত্রায়....এতটুকু....টিকে-টিকে (ওড়িয়া)....টুকু-টুকু (রাঢ়ি বাংলা)...ইংরাজীতে wee bit,—. ‘গন্ধং লবণং দেহি’ একটুখানি নুন দাও৷

(১৬)  ‘গন্ধ’ শব্দের আরেকটি অর্থ হ’ল তরু বা গাছপালা৷

(১৭)  ‘গন্ধ’ শব্দের আরেকটি অর্থ হ’ল শোঁ-পোকা caterpillar)

(১৮) ‘গন্ধ’ শব্দের অপর একটি অর্থ হ’ল জলধারা ঃ ‘‘বর্র্ষর গন্ধে এই সাময়িক হ্রদটি তৈরী হয়৷’’

(১৯)  ‘গন্ধ’ শব্দের অন্য একটি অর্থ হ’ল যে ছিনতাই করে অর্র্থৎ যে চোর লুকিয়ে চুরি করে প্রকাশ্যে চুরি করা বা হাঁক-ডাক করে চুরি করা ডাক দিয়ে চুরি করা নয়৷ ‘‘দেখ, অমুক তারিখে তোমার বাড়ীতে যাব.... ধনদওলত যা আছে আমার জন্যে দেউড়িতে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে দিও৷ নইলে বল প্রয়োগ করে তা নিয়ে আসব’’--- এই যে ডাক দিয়ে চুরি করা একে বলে  ডাকাতি৷ যে গোপনে চুরি করে তাকে সংসৃকতে বলে ‘চোর’ বা চৌর’৷ যে হাঁকডাক করেনি কিন্তু প্রকাশ্যে চুরি করেছে তাকে বলে ‘তস্কর’৷

(২০) ‘গন্ধ’ শব্দের  আর একটি মানে হ’ল গন্ধক sulpler) ৷

(২১)  ‘গন্ধ’ শব্দের  একটি মানে নাজনে গাছ৷ নাজনে বলতে কলকাতা অঞ্চলে বারমেসে শোজনেকে বোঝায়৷ উভয়েই  মোরঙ্গা বর্গের  গাছ৷শোজনে শীতকালে হয়...নাজনে বারমাস হয়৷ শোজনে ফুল ধবধবে শাদা, নাজনের ফুল ঘি রঙের৷ শোজনে ফুলে কষায়ভাবের সঙ্গে মিষ্টত্ব মিশে থাকে৷ তাই সুস্বাদু৷ একটু তেল দিয়ে বাঁধলেই অতি উপাদেয়৷ নাজনের ফুল কষায়৷ তাই তাতে  তেল দিয়ে রাঁধলেও সোয়াদ খোলে না৷ শোজনে কে সংসৃকতে ‘শোভাঞ্জন’ বলা হয়৷                          শোভাঞ্জন>শোহাঞ্জ>শোঞ্জন>শোজিনা>শোজনে৷

‘‘ভাল নাম শোভাঞ্জন ডাক নাম শোজনে,

চিবিয়ে চিবিয়ে খাই মামা আর ভাগ্ণে,

ছিবড়া একপাশে ফেলি, ফেলি নাকো সামনে৷’’

---‘‘তাড়া বাঁধা  ছড়া’’

মোরাঙ্গা বর্গীয় এই গাছটি বৈদেশিক৷ এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ‘গন্ধ’ মানে নাজনে কিন্তু ‘গন্ধক’ মানে শোজনে৷

(২২) পদ্ম কোরকের ভেতর যে পদ্মের বীজ থাকে যা আকারে মুড়ির চেয়েও বেশ বড়... পৃথিবীর কোথাও কোথাও (যেমন-কাশ্মীরে) এর ডালনা-চচ্চড়িও তৈরী করা হয়৷ যা খেতে ভাল ও পুষ্টিকর৷ এই যে বস্তুটি বর্দ্ধমানে যাকে বলা হয় পদ্মটাটি, এরও নাম ‘গন্ধ’৷

(২৩) মেয়েরা মাথায় বিনুনি বাঁধার সময় কখনও কখনও তেলে জলে মোশানো হাত চুলের ওপর হালকাভাবে প্রয়োগ করেন৷ এই যে তেলজল মেশানো জিনিসটা যা বিনুনি বাঁধার ব্যবহৃত হয়, তাকেও গন্ধ বলে৷