প্রভাতসঙ্গীতে আলোকের বার্তা

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

‘‘আলো এল, ভোরের আলো নূতনের বারতায়৷

কলি হাসল, ফুল ফুটল রঙেরই সুষমায়৷৷’’

(প্রভাত সঙ্গীত ৪৮৪৬)

অমারাত্রির অবসান ঘটিয়ে প্রভাতের বার্তা নিয়ে এসেছে ‘প্রভাত সঙ্গীত’৷ মানবসমাজে আজ যে পুঞ্জীভূত অন্ধকার জমে আছে এই অন্ধকারের জগদ্দল পাথরকে সরিয়ে আলোকের পথ ধরে যারা চলতে চায় যুগপুরুষ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী, যাঁর লৌকিক নাম শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার–‘প্রভাত সঙ্গীতে’র মধ্যে তাঁদের ডাক দিয়েছেন–

ডাক দিয়ে যাই যাই যাই,

                                আমি ডাক দিয়ে যাই যাই যাই৷

আলোকের পথ ধরে যারা যেতে চায়

                                                তাহাদের চিনে নিতে চাই৷৷

মানুষ পেয়েছে নানা ব্যাধি–ক্লেশ–তাপ,

                                মানুষ পেয়েছে নানা শোক সন্তাপ৷

তাদের অশ্রু যারা মুছাইতে চায়

                                                তাহাদের জেনে নিতে চাই৷৷

মানুষ সয়েছে বহু ক্ষুধার জ্বালা,

                                                সহিয়াছে অপমান অবহেলা৷

যারা তাদের ক্ষতেতে প্রলেপ দিতে চায়

                                                তাহাদের মেনে নিতে চাই৷৷

(প্রঃসঃ ৪৯)

* * *

আগামী ১৪ই সেপ্ঢেম্বর ‘প্রভাত সঙ্গীত’ দিবস৷ ১৯৮২ সালের ১৪ই সেপ্ঢেম্বর দেওঘরে মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী, যাঁর লৌকিক নাম শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার, প্রভাত সঙ্গীত রচনা শুরু করেছিলেন৷ সেদিন প্রথম যে গানটি দিয়ে প্রভাত সঙ্গীত শুরু করেছিলেন, গানটি হ’ল–

বন্ধু হে, নিয়ে চল

আলোর এই ঝর্ণাধারার পানে৷

আঁধারের ব্যথা আর সয় না প্রাণে৷৷

ঘুমের ঘোর ভাঙ্গানোর গানে গানে৷৷

–এই প্রথম সঙ্গীতটির মাধ্যমে তিনি অন্ধকারের জগদ্দল পাষাণে নিপিষ্ট নিপীড়িত মানবতার আলোর জন্যে যে প্রবল আকুতি প্রকাশ করেছেন–যে আকুতি ধবনিত হয়েছে বেদের প্রাচীন ঋষির কণ্ঠে–‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’–(‘অন্ধকার থেকে আমাকে আলোর পথে নিয়ে চলো’)৷

এই আলো জীবনের সর্বস্তরের আলো৷ ভৌতিক স্তরের আলো, মানসাধ্যাত্মিক স্তরেরও আলো৷ ভৌতিক ক্ষেত্রের আলোর অর্থ–ভৌতিক (ফিজিক্যাল) দুনিয়ায় আমরা বাস করছি৷ এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে গেলে অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, চিকিৎসা চাই, বাসস্থান চাই, আর চাই শিক্ষা–আজ সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যে যা একান্ত প্রয়োজন৷ কিন্তু মানুষের এই নূ্যনতম প্রয়োজন থেকে মানুষ বঞ্চিত৷ এই বঞ্চনা ও শোষণ থেকে মুক্তির সংকল্প ঘোষিত হয়েছে এই প্রভাত সঙ্গীতে৷ যার একটি–

উল্কা অশনি বহিছে বহ্ণি সফণ কালো সর্প৷

জাগাও মানবতা নাশো দানবতা

                                                আসুরী শক্তি করে খর্ব৷৷

 

এ আকাশ এ বাতাস স্বয়ং প্রকাশ

                                                সবার তরে দিল বিধাতা৷

তারকা খচিত নভঃ অবারিত

                                                শ্যামল শষ্পে ধরা ধাতা৷

সবার তরে ভাই এসো তাই মিশে যাই,

                                                সবাই সবার মোরা গর্ব৷৷

 

সঞ্চয় উপসঞ্চয় যা রয়েছে

                                                মানুষের তরে তা যথেষ্ট৷

মিথ্যে কাড়াকাড়ি হানাহানি হয়েছে,

                                                হয়েছে ক্ষতি অনিষ্ট৷

আজ পূর্বাকাশে যে রবি হেসেছে

                                                তার আলোয় সব মন ভরব৷

অতীতে যা হয়নি তা করব৷৷

(প্রঃসঃ ৪৫৯৯)

প্রভাত সঙ্গীতে এমনি সমাজ চেতনা মূলক বহু গান রয়েছে, যা শোষণমুক্ত সমাজের রচনার আবহ সঙ্গীত৷

আর মানসাধ্যাত্মিক স্তরের আলো তথা বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক স্তরের আলোয় উত্তরণের সুর তো প্রভাত সঙ্গীতের প্রধান বৈশিষ্ট্যই৷

‘‘আঁধার শেষে আলোর দেশে

                                                অরুণ ভোরের কথা৷

(ভাই) শোণাব সবায় ডেকে ডেকে৷৷

(প্রঃসঃ ৩)

*  *  *

আলোর পরেতে আলো তারপরে আরও আলো৷

অপার আলোর ঢেউ বহে চলে যায়৷৷

যার লাগি এত আলো সে আমারে বাসে ভালো৷

মোর মনে তার ছবি ভাসিয়া বেড়ায়৷৷

কখনো বা অতি কাছে, কখনো বা অতি দূরে

নানান রূপে, নানা গানে ও সুরে

সবাইকে দোলা দিয়ে নেচে সে যে যায়৷৷

মনের কমল কত বর্ণে বিকশিত,

                                গন্ধ মধু নিয়ে তারই পানে ধায়৷৷

(প্রঃসঃ ১৫৩)

*  *  *

১৯৮২ সালের ১৪ই সেপ্ঢেম্বর প্রভাত সঙ্গীত রচনার শুরু৷ ওইদিন থেকে প্রভাত সঙ্গীতের স্রষ্টার মহাপ্রয়াণের আগের দিন পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৯০ সালের ২০শে অক্টোবর পর্যন্ত–মাত্র ৮ বছর ১ মাস ৭দিনের মধ্যে ৫০১৮টি সঙ্গীত রচিত হয়েছে৷ আর প্রতিটি গানে গীতিকার নিজেই সুর দিয়েছেন৷ এত কম সময়ের মধ্যে পাঁচ সহাস্রাধিক সঙ্গীত রচনা ও তাতে সুরারোপণ বিশ্বের ইতিহাসে এত অভিনব রেকর্ড৷

ভাব–ভাষা–সুর–ছন্দ–সব  দিক থেকেই প্রভাত সঙ্গীত অভিনবত্বের দাবী রাখে৷ প্রভাত সঙ্গীতে ধ্রুপদী থেকে শুরু করে বিভিন্ন সুর ও রাগের গান রয়েছে৷ তাছাড়া রয়েছে ঝুমুর, বাউল, টপ্পা, গজল, কীর্ত্তন প্রভৃতি সুরেরও গান৷ দেশ–বিদেশের বহু সুরের ও ছন্দের গানও রয়েছে প্রভাত সঙ্গীতে৷ পার্সিয়ান, চাইনিজ, ইজ্রাইলী, ক্ল্যান্ডিনেভিয়ান, আইবেরিয়ান সুরেরও গান দিয়েছেন প্রভাতসঙ্গীতের স্রষ্টা৷ এমনকি আড়াই হাজার বছর আগে লুপ্ত হওয়া বৌদ্ধসুরও আমরা প্রভাত সঙ্গীতের মধ্যে পাই৷

প্রভাতসঙ্গীতের আরও বৈশিষ্ট্য হ’ল প্রভাতসঙ্গীতে ভক্তিমূলক, সমাজচেতনামূলক গানের সঙ্গে সঙ্গে ষড়ঋতু গান, বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানের গান–যেমন অন্নপ্রাশনের গান, জন্মদিনের গান, বিবাহের গান, শ্রাদ্ধের গান, গৃহপ্রবেশের গান, বৃক্ষরোপনের গান–এমনিভাবে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উপযোগী গানও প্রভাতসঙ্গীতের ভাণ্ডারে মজুদ্ রয়েছে৷ আর কেবল বাংলাভাষাতেই নয়, ইংরেজী, হিন্দী, ঊর্দ্দু, অঙ্গিকা, মৈথিলী, ভোজপুরী প্রভৃতি ভাষাতেও প্রভাত সঙ্গীত হয়েছে৷

তবে সমস্ত গানের মধ্যেই রয়েছে নব চেতনার সুর, নব জাগরণের সুর, নোতুন আদর্শ মানব সমাজের সুর, আছে নব্যমানবতাবাদের সুর, আছে সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্–এর অনুরণন৷