পরিবর্তন

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

সিপিএমের পৈশাচিক সন্ত্রাস থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গকে উদ্ধার করেছেন, তাই পশ্চিমবঙ্গবাসীর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা তাঁকে দু-হাত তুলে আশীর্বাদ করেছেন৷ তাছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরল অনাড়ম্বর জীবন, তাঁর সততা, তাঁর অদম্য কর্মনিষ্ঠার জন্যে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন৷ এতে কোনও সন্দেহ নেই৷ তিনি পরিবর্তনের শ্লোগান তুলে সিপিএমের তৈরী সেই চরম সন্ত্রাসজনক পরিস্থিতির পরিবর্তন এনেছেন৷ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন করেছেন৷

মমতার অতীত ইতিহাস হ’ল তিনি কংগ্রেসেরই জনপ্রিয় নেত্রী ছিলেন৷ সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক নিয়ে মূলতঃ কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর বিরোধ৷ তিনি কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস করলেন৷ আগে দিল্লীর নেহেরু-গান্ধী পরিবারের দিকেই তথা কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হ’ত, কিন্তু এখন তিনি নিজেই তাঁর দলের সর্বেসর্বা৷ তাই তিনি স্বাধীনভাবে নিজের নীতি ও পলিশি অনুসারেই চলতে শুরু করলেন৷ তাঁর দলের অন্যান্য সবাই তাঁর নীতি-পদ্ধতি মেনেই চলতে শুরু করল৷

এ অবস্থায় তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন আনলেন ঠিকই, কিন্তু মূল নীতিতে কী কোন পরিবর্তন আনলেন? এটাও একটু ভেবে দেখা দরকার৷

কংগ্রেস পুঁজিবাদী নীতিকে মেনেই সমাজের পরিবর্তন আনতে চায়৷ মমতাও কংগ্রেসের এই মৌলিক নীতিতে কোন পরিবর্তন আনেননি৷ এটা মানতেই হবে৷ কিন্তু পুঁজিবাদী কাঠামোয় যে সমাজের প্রকৃত কল্যাণ সম্ভব নয় এটা চরম সত্য কথা৷

তবে অন্যান্য ইস্যুর থেকে মমতার দৃষ্টিভঙ্গীতে স্বতন্ত্রতা রয়েছে, এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই৷ যেমন অসমে সম্প্রতি নাগরিকপঞ্জীর নামে যে ঘৃণ্য বাঙালী বিরোধী চক্রান্ত শুরু হয়েছে, লক্ষ লক্ষ বাঙালীর নাগরিকত্ব হরণ করে তাদের বিদেশী তক্মা দিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর চেষ্টা চলছে, মমতা এর প্রতিবাদে পুরোপুরি সরব হয়েছেন৷ কংগ্রেস কিন্তু আগে বাঙালী নির্যাতনের বিরোধিতা  তো করেইনি, বরং সর্বতোভাবে মদতই দিয়েছিল৷ ১৯৮৫ সালে রাজীব-অগপ চুক্তি তারই প্রমাণ৷ এখনও পর্যন্ত কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এন.আর.সি-র নামে অসমে বাঙালী নির্যাতনের বিরুদ্ধে তেমন একটা মুখ খোলেননি৷ কিন্তু মমতা স্পষ্টতঃই অসমে বাঙালী নির্যাতনের ও এন.আর.সি. প্রক্রিয়ার স্পষ্ট বিরোধিতা করে চলেছেন৷ মমতার এই ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়৷

এবার অন্য এক প্রসঙ্গে আসি৷ ২৮শে আগষ্ট তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসে কলকাতার মেয়ো রোডে ছাত্র সমাবেশে মমতা তাঁর পুরো বত্তৃণতাতেই কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চ্যালেঞ্জ জানালেন ও বিজেপির সমস্ত কুকীর্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বত্তৃণতা দিয়ে গেলেন৷

শিক্ষার্থী সমাবেশে তাঁর বত্তৃণতাতে শিক্ষার নীতি, উদ্দেশ্য বা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে একটি কথাও উচ্চারণ করলেন না৷

শিক্ষা যে কোন দেশের একটা জাতির মেরুদণ্ড৷ এখানে কটা শিক্ষাকেন্দ্র, সুকল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী হয়েছে সে সংখ্যাটাকেও মুখ্য বলা যাবে না, কী শিক্ষা হচ্ছে, প্রকৃত শিক্ষাদান হচ্ছে কি না, ছাত্ররা তাদের কর্তব্য করছে কি না, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কী হওয়া উচিত---কী চলছে, কলেজে-কলেজে ছাত্র সংসদগুলি বর্তমানে যে হানাহানি রক্তারক্তি করছে, ছাত্র সাংসদরা কীভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তা থেকে শিক্ষাকেন্দ্রগুলিকে মুক্ত রেখে---শিক্ষাকে দূষণমুক্ত করা---শিক্ষাকে সার্থক করে তোলা---এই ব্যাপারগুলো নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে কিন্তু নূতন কোন বার্তা পাওয়া গেল না৷

বর্তমানে রাজ্যের প্রায় সব কলেজেই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সংসদ, আর তাদের নেতা-নেত্রীরাই ছাত্র ভর্তিকে কেন্দ্র করে লক্ষ লক্ষ টাকা তোলাবাজী করল, এ ব্যাপারে সেভাবে কোন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ--যাতে করে ভবিষ্যতে এটা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়---তারও আশ্বাস পাওয়া গেল না৷ কিছুটা হয়ত ইঙ্গিত রয়েছে কিন্তু এইটুকু তো বলতেই হয়, নাহলে তো মুখ থাকে না৷ কিন্তু একটা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাতে এটা মোটেই যথেষ্ট নয়৷

তাছাড়া মমতা পরিবর্তনের শ্লোগান তুলেছিলেন৷ তাহলে অন্ততঃ শিক্ষা-ব্যবস্থাটাকে পুরোপুরি দলীয় রাজনীতিমুক্ত করা---যা সত্যিকারের শিক্ষাবিদ্রা আশা করেন---এটা মমতার করা উচিত ছিল৷ অন্ততঃ এখনও এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত৷ কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখছি শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি রাজনীতির অধীনে রাখা হচ্ছে৷ এতে তো প্রকৃত শিক্ষার বিকাশ হবে না!

প্রাউট-প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার মানুষের যথার্থ কল্যাণের জন্য আদর্শ শিক্ষানীতি সম্পর্কে বলেছেন যে, দলীয় রাজনীতির হাত থেকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সযত্নে মুক্ত রাখা দরকার৷ শিক্ষা ব্যবস্থার আর্থিক দায়িত্ব সরকারের, কিন্তু পঠন-পাঠন, পাঠরীতি তথা পাঠ্য নির্বাচনের একছত্র অধিকার শিক্ষাব্রতীদের হাতেই থাকা উচিত৷ রাষ্ট্র বা সরকার এই শিক্ষাব্রতীগণকে বা বিশ্ববিদ্যালয়কে পরামর্শ দিতে পারেন---হুকুম করতে পারেন না, কোন প্রস্তাব বিচার বিবেচনার জন্যে পাঠাতে পারেন গ্রহণ করতে চাপ দিতে পারেন না৷ স্বাভাবিকভাবে সুকল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদেও দলীয় রাজনীতির কোন প্রভাব থাকা উচিত নয়৷

শিক্ষার উন্নতির জন্যে এই নীতির বিরুদ্ধে কিছুই বলবার নেই৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমাদের অনুরোধ, আপনি চিরকাল মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন না, কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থাতে যদি এই পরিবর্তন আনতে পারেন, তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থার স্থায়ী ও যথার্থ কল্যাণ হবে৷