প্রসঙ্গৎঃ ত্রিপুরা নির্বাচন

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর ধরে একটানা ক্ষমতায় থেকে সিপিএম অজস্র খুন-জখম করে৷ বিরোধীদের ওপর চরম অত্যাচার চালিয়ে চতুর্দিকে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ভেবেছিল তাদের কোনওকালে কেউ ক্ষমতার আসন থেকে সরাতে পারবে না৷ কিন্তু নিয়তির বিধানে এক ঝটকায় তারা এখানে উৎখাত হয়ে গেল৷ এখানে এদের বহু অফিসে বাতি জ্বালানোরও কেউ নেই৷ ঠিক তেমনই ত্রিপুরাতেও ২৫ বছর ধরে সিপিএম বহু খুন-জখম, নারী নির্যাতন করেছে৷ উপজাতিদের তোষণ করে সংখ্যাগুরু বাঙালীদের জীবনকে দুর্বিষহ করেছে৷ ত্রিপুরায় সিপিএমের এই কুটনীতির জন্যে বাঙালীরা এখানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছে৷ অহরহ অত্যাচারের শিকার হয়েছে৷ মদগর্বী সিপিএম নেতা কর্মীদের ধারণা ছিল এ রাজ্য থেকে তাদের কেউ হটাতে পারবে না৷ কিন্তু এবার নির্বাচনী  সুনামাতে অবিশ্বাস্য ভাবে সিপিএম হিরো থেকে প্রায় জিরো-তে এসে গেল৷

২০১৩-এর বিধানসভা নির্বাচনে যেখানে সিপিএম পরিচালিত বামজোট দুই- তৃতীয়াংশেরও বেশী---৬০-এর মধ্যে ৪৯টি আসন পেয়েছিল, এখন হঠাৎ সেই আসন সংখ্যা নেমে হয়েছে মাত্র ১৬৷

অন্যদিকে গত বিধানসভা নির্বাচনে যে বিজেপি জোট একটিও আসন পায়নি, তারা এবার পেয়েছে ৪৩টি আসন৷ কংগ্রেস গতবারে পেয়েছিল ১০টি আসন৷ এবারে প্রাপ্তি শূন্য৷

তাহলে বিজেপির এই হঠাৎ উত্থানের কারণ কী? এর প্রধান কারণ, সিপিএমের পঁচিশ বছরের অপকীর্ত্তির বিরুদ্ধে জনসাধারণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ৷ আর দ্বিতীয় কারণ হ’ল টাকার বস্তা৷ এবার বিজেপি মূলত বস্তা বস্তা টাকা বিলি করে কাজ হাসিল করেছে৷

এমনিতে কেন্দ্রে মোদী সরকার এমন কিছু কাজ করেনি যে তার পক্ষে এই, বলা যায়, গণ অভ্যুত্থান৷ মোদিজী ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, প্রতি বছর ২ কোটি করে বেকারের চাকরীর ব্যবস্থা করবেন, দারিদ্র্য দূর করবেন, সুইস ব্যাঙ্ক সহ বিভিন্ন বিদেশী ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের লুকোনো টাকা বের করে এনে প্রতিটি গরীব ভারতীয়দের ব্যাঙ্কের অ্যাকাউণ্টে ভরে দেবেন, দুর্নীতিমুক্ত ভারত গড়বেন ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এর একটাও প্রতিশ্রুতি পালিত হয়নি৷ আর সর্বশেষে মামা-ভাগ্ণের অর্থাৎ মেহুল চোকসি আর নীরব মোদী সহ বিভিন্ন পুঁজিপতিদের যেভাবে বিভিন্ন ব্যাঙ্কে জমা রাখা জনসাধারণের বিপুল পরিমান টাকা লুট করার সংবাদ বের হচ্ছে ও তার পেছনে সরকারী আমলা ও মন্ত্রীদের হাত আছে বলে নানান প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মোদীর প্রতি জনগণের আস্থাতে টোল খেয়েছে৷ কিন্তু এক্ষেত্রে সিপিএমের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ও টাকার থলির লোভের কারণে বিজেপির ভাগ্যের শিকে ছিঁড়েছে৷

তবে বিজেপিও যে এখানে স্বস্তিতে রাজত্ব করবে তারও আশা কম৷ কারণ বিজেপি-র জোট সঙ্গী আই পি এফ টির দাবী ত্রিপুরার এডিসি এলাকা নিয়ে পৃথক রাজ্য৷ আই পি এফ টির এই বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবীর প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার নাকি সহানুভূতিশীল৷ আই পি এফ টির শীর্ষনেতাদের এইটাই দাবী৷ কিন্তু এই দাবী মানতে গেলে ত্রিপুরায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীরা বিদ্রোহ করবেই৷ তখন বিজেপির পক্ষে ক্ষমতায় থাকা সহজ হবে না৷ অন্যদিকে বিজেপি তাদের প্রতিশ্রুতি না রাখলে আই পি এফ টি-রও হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনে নামবার আশঙ্কা৷ তাই বিজেপির স্বস্তি নেই৷ আসলে ত্রিপুরায় সমস্ত মানুষের সুষ্ঠু উন্নয়নের কোনও সুসংহত আদর্শ না আছে বিজেপির, না আছে ছিল সিপিএমের, না ছিল কংগ্রেসের৷ সবাই কেবল সস্তায় কিছু পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিভিন্ন সস্তা সেণ্টিমেণ্টের সুড়সুড়ি দিয়েই ক্ষমতা দখল করছে৷ এটা এখন সারা দেশে প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিরই একমাত্র পলিসি৷ এরা হয় পুঁজিবাদী, না হয় মার্কসবাদী আদর্শে বিশ্বাসী৷ আর এটা এখন পরীক্ষিত সত্য যে, এ দুটোর কোনও পথেই জনগণের প্রকৃত কল্যাণ হতে পারে না, এই দর্শনগুলি কেবল ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার মাত্র৷

এখানে বলতে দ্বিধা নেই, সম্মিলিত ভাবে সমস্ত মানুষের উন্নয়ন আজ একমাত্র সম্ভব প্রাউটের অর্থনৈতিক গণতন্ত্র তথা নব্যমানবতাবাদের আদর্শের মাধ্যমে৷

ত্রিপুরায় সমতলবাসী বাঙালী ও পাহাড়বাসী বাঙ্গালী (যাদের বলা হয়েছে উপজাতি) সবাইকে নিয়েই---একসঙ্গে সবাইকার যথার্থ কল্যাণের পথ একমাত্র প্রাউটই৷ আর এই আদর্শকে নিয়ে আজ মানুষের সেবায় নেমেছে ‘আমরা বাঙালী’ দল৷

আদর্শগত ভাবে দেউলিয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল কেবল ক্ষমতা লাভের নেশায় মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও টাকার ঝুলি মানুষের সামনে তুলে ধরে ক্রমাগত মানুষকে বিভ্রান্ত করছে৷ তারা ‘আমরা বাঙালী’ দলের বিরুদ্ধে নানান কুৎসা রটনা করে মানুষকে বিপথে পরিচালিত করছে৷ ওদের হাতে একাধারে টাকার ঝুলি ও তার সাহায্যে প্রচার মাধ্যমগুলিকেও কব্জায় রেখেছে৷ ‘আমরা বাঙালী’ তথা প্রাউটের মহান আদর্শ সম্পর্কেও মানুষকে ঠিক ভাবে বুঝতে দেওয়া হচ্ছে না৷ যেদিন মানুষ বুঝবে, সেদিন কিন্তু এইসব অন্তঃসারশূন্য রাজনৈতিক দলগুলির মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে না ভুলে তারা তাদের প্রকৃত উন্নয়নের পথই বেছে নেবে৷