পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত মানুষের কর্মস্থান এরাজ্যেই করতে হবে

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

বাঁকুড়ার  হেমন্ত  রায় কেরলে কাজ করতে গিয়েছিল৷ সম্প্রতি সেখানে তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে৷ এই মৃত্যু আত্মহত্যা না খুন-পুলিশ তদন্ত  করছে৷ সপ্তাহ খানিক আগে মালদা জেলার আর এক যুবক কাজ করতে রাজস্থানে গিয়েছিল ৷ ওখানে এক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলার সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷ এই কারণে তাঁকে  নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়৷ এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবাঙলা থেকে ভিন রাজ্যে যাঁরা কাজের জন্যে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের রাজ্যে ফিরে আসতে আহ্বান জানিয়েছেন, তিনি বলেছেন, ‘এ রাজ্যে কাজের অভাব নেই৷ তাঁরা জেলা শাসকের  কাছে  নাম লেখান৷  তাহলে তাদের ৫০ হাজার করে টাকা দেওয়া হবে৷  এই টাকায় আর  কিছু না হোক চায়ের দোকান  তো করতে পারবেন৷’

এই পরিপ্রেক্ষিতে  বলতে হয়, পশ্চিম বাঙলার হাজার হাজার যুবক কাজ করার জন্যে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন৷ পশ্চিম বাঙলার প্রতিটি জেলার     প্রায়  প্রতি গ্রাম থেকেই দলে দলে  যুবক ছেলেরা দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে কর্র্মেপলক্ষ্যে পাড়ি দিয়েছেন৷ তাদের সবাইকে  ৫০ হাজার  টাকা  করে  রাজ্য সরকার  দেবে, আর  তা দিয়ে  তারা চা দোকান খুলবে৷ এটা কোনো সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নয়৷ এমনিতে  এরাজ্য চা-দোকানের  কমতি নেই, তাই আরও চা-দোকান হলে ওই দোকানে চা খাবে কে?

কেবল টাকা ছড়ালে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হয় না৷  পঞ্চায়েতের মারফৎ অনেক যুবক-যুবতীকে অনেক টাকা দেওয়া হয়--- তা কিন্তু সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা না থাকার জন্যে তারা বেহিসেবীভাবে খরচ করে  ফেলে৷ ফলে দেখা দেয়, তারা যেমন বেকার ছিল তেমনি থেকে যায়৷

এখন তো দেখা যায় বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্যে দিবারাত্র পুঁজিপতিদের কাছে এমনকি  বিদেশী পুঁজিপতিদের কাছে গিয়েও সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছেন৷

তাঁদের পুঁজি বিনিয়োগের জন্যে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন৷ এ ব্যাপারটাই তো স্বাধীনতার পরথেকে চলছে৷ কিন্তু তাতে কি বেকার সমস্যার সমাধান  হয়েছে?  মোটেই নয়৷ কারণ, পুঁজিপতিদের লক্ষ্য মুনাফা অর্জন৷ তাই তারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি অবলম্বন  করে  যত কম  সম্ভব  মানুষকে কর্মে নিযুক্ত করে  ও যত বেশি  সম্ভব লাভের পথ খোঁজে৷ আবার  যখন দেখে লাভের অঙ্ক কোনো কারণে  হ্রাস পাচ্ছে, তখন তারা তাদের শিল্প-কারখানায় তালা ঝুলিয়ে পুঁজি সরিয়ে অন্যত্র চলে যায়৷ বন্ধ শিল্পের হঠাৎ বেকার হওয়া শ্রমিকরা  অনাহারে অর্দ্ধহারে মরতে থাকে৷ এটাই তো পশ্চিমবঙ্গের মর্র্মন্তিক চিত্র৷

আর বড় বড় পুঁজিবাদী দেশ যেমন আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্র্মনী,প্রভৃতি দেশে তো পুঁজিপতির অভাব নেই, পুঁজি বিনিয়োগের লোকের অভাব নেই৷ তবুও ওই সমস্ত  দেশে চরম  বেকার সমস্যা কেন?

ধনকুবেরদের বৃহৎশিল্পগুলি প্রথমে কিছু সংখক শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলেও  পরবর্তীকালে দেখা যায়, এই বৃহৎ শিল্পগুলির  সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বহু  ক্ষুদ্র শিল্প  বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ অর্থাৎ নতুন করে বেকারবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে৷

বিভিন্ন শহরে দেশী-বিদেশী ধনকুবেরদের  দ্বারা পরিচালিত বিগ্বাজার, মলগুলির জন্যে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দোকান বন্ধ হওয়ার মুখে বা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷

তাই, এভাবে বৃহৎ ধনকুবেরদের বিনিয়োগের ফলে বা  সরকারী অনুদানে চা-দোকান, পান-দোকান, চপের -দোকান করে বেকার  সমস্যার সমাধান হবার নয়৷ এজন্যে চাই কৃষি-শিল্পের সুসংহত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, কৃষি ও শিল্পকে বিচ্ছিন্নভাবে ভাবলে চলবে না, বরং এ দুটোকেই এক  সূত্রে গেঁথে  পরিকল্পনা তৈরী করতে হবে৷

মান্ধাতার আমলের কৃষিনীতি যেভাবে চলছে--- এভাবে চললে চাষীরা ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে৷ তাই তো ঋণের  বোঝা সইতে না পেরে বহু চাষী আত্মহত্যা করছে৷ কৃষিকে লাভজনক করতে হবে৷ কৃষিপণ্যের বাজারদর উৎপাদনমূল্যের বেশী হতে হবে৷  চাষীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে৷

তাই কৃষির আধুনিকরণ চাই৷  আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কৃষিতে ব্যবহার  করতে হবে৷ তার সঙ্গে সঙ্গে কৃষির প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সার (জৈব হওয়াই বাঞ্ছনীয়), কীটনাশক (তাও জৈব হওয়া বাঞ্ছনীয়) প্রভৃতি উৎপাদনের  জন্যে সমবায় ভিত্তিক কৃষি সহায়ক শিল্প গড়ে তুলতে হবে, তেমনি ব্যাপকভাবে কৃষিভিত্তিক শিল্পও গড়ে তোলার পরিকল্পনা রচনা করতে হবে৷ সেগুলোও হবে সমবায় ভিত্তিক৷ কৃষি উৎপাদিত দ্রব্যকে কাঁচামাল করে যে শিল্প তাকেই কৃষিভিত্তিক শিল্প বোঝানো হচ্ছে৷ যেমন চালকল, তেল কল, ধানের তূষ থেকে রাইসব্যান ওয়েল তৈরীর ব্যবস্থা, কাগজকল প্রভৃতি৷

স্থানীয় কাঁচামালের ভিত্তিতে গ্রামাঞ্চলে কৃষি ভিত্তিক শিল্পের প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে৷ এই সম্ভবনা অনুসারে  সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করতে হবে৷  এরপর প্রয়োজনে অকৃষি শিল্পও গড়ে তুলতে হবে৷ এইভাবে এই রাজ্যকে  স্বয়ং সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিতে হবে৷  তা হলে এ রাজ্যের সকল মানুষের জন্যে এ রাজ্যের মধ্যেই কর্মসংস্থানের  ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে৷ এ রাজে তখন আর কাউকে ভিন রাজ্যে কর্মের সন্ধানে যেতে হবে না৷.