একদিকে সরকার বলছেন, বাঙলাকে ভাগ হতে দেব না অন্যদিকে বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপভাষাকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন৷ এই দুটি ঘটনার মধ্যে যে বিরাট ফাঁক রয়ে গেছে সেই ছিদ্র পথেই একদিন ধবংস হবে বাঙলা ও বাঙালীর জাতি সত্তা, ভৌম-অখণ্ডতা ও ভাষা-সংস্কৃতি৷ শুধু সংকীর্ণ রাজনীতির ফায়দা লুটতে কোনো সরকারেরই এই ধরণের জঘন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত নয় ৷
সম্প্রতি ২১ শে ফেব্রুয়ারী তারিখে দেশপ্রিয় পার্কের এক সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজবংশী ও কামতাপুরীকে আলাদা ভাষা ও অন্যান্য লিপিতে লেখার স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন৷ তাঁর এই বক্তব্য বাঙালী জাতি ও বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে যে কতটা মারাত্মক হবে তা বোধহয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জানা নেই৷ জানা থাকলে বাঙালী জাতি ও বাংলাভাষার সর্বনাশ ঘটাতে এমন আত্মঘাতী ঘোষণা করতেন না৷
মনে রাখতে হবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৃতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে বাঙালীর জাতিসত্তা গড়ে উঠেছে৷ এ সবের সমন্বয়ে একটি সাংবেদনিক উত্তরাধিকার বা সেন্টিমেণ্টাল লিগ্যাসির ভিত্তিতে৷ সেই সেন্টিমেণ্টাল লিগাসিকে মজবুৎ বন্ধনীতে ধরে রেখেছে তার ভাষা-সংস্কৃতি৷ প্রাচীন গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের উত্তর-পূর্বপ্রত্যন্তের রামগড় পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পূর্বে আরাকান, উত্তরে হিমালয় পাহাড়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ যে ভূমিখণ্ড তা রাঢ়, সমতট, বরেন্দ্র ও বঙ্গ নিয়ে বৃহত্তর বাঙলাদেশ বা বাঙ্গালীস্তানের (বাঙালীস্তান অর্থাৎ বাঙালীদের নিজস্ব বাসভূমি) কূর্মি-মাহাতো, সদ্গোপ, নমশূদ্র, চাকমা, রাজবংশী, কোচ---এই মূল এই ছয়টি জাত-বাঙালী ও তাদের বারটি উপভাষা নিয়ে বাংলা ও বাঙালী৷
মূল বাংলা ভাষার এই বারটি উপভাষা বাঙালীস্তানের যে যে ভৌম-এলাকায় রয়েছে, সংক্ষেপে তা হলো ঃ-
(১) মধ্য রাঢ়ীয় বাংলা - দুমকা, জামতারা, দেওঘর, নলহাটি ও মুরারই বাদে বীরভূম জেলা বর্ধমানের দুর্র্গপুর থেকে আসানসোল ইন্দাস বাদে বাঁকুড়া জেলাসিংভূম জেলার উত্তরপূর্র্বংশ ধানবাদ, গিরিডি ও রাঁচী জেলার অংশ বিশেষ আর কাঁথি এলাকা বাদে মেদিনীপুর জেলা
(২) কাঁথি বাংলা - রসুলপুর নদীর মোহনা থেকে সুবর্ণরেখা নদীর মোহনা পর্যন্ত
(৩) কলিকাতা বাংলা - কলকাতা, (উভয়) চবিবশ পরগণা, হুগলি, উলুবেড়িয়া বাদে মেদিনীপুর জেলা
(৪) নদীয়া বাংলা - নদীয়া জেলা, বর্ধমানের কালনা মহকুমা বীরভূম ও নৈহাটি আর পূর্ব মুর্শিদাবাদের দক্ষিণাংশ
(৫) শেরশাহবাদীয়া বা মালদাইয়া বা জঙ্গীপুরী বাংলা-মুর্শিদাবাদ জেলার অধিকাংশ এলাকা পাকূড় ও রাজমহল মহকুমা মালদা জেলা কাটিহার জেলার বারসই এলাকা ও পূর্বাংশের কিছু কিছু এলাকা উত্তর দিনাজপুরের ডালখোলা ও রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ মহকুমা
(৬) বারেন্দ্রী বাংলা - নবাবগঞ্জ মহকুমা বাদে রাজশাহী জেলা পাবনা জেলার পশ্চিমাংশ দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাংশ কুষ্ঠিয়া জেলার উত্তরাংশ ও বগুড়া জেলার দক্ষিণাংশ
(৭) রংপুরী বাংলা - রংপুর জেলা দিনাজপুর জেলা উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা কুচবিহার জেলা জলপাইগুড়ি জেলা দার্জিলিং জেলার সমতট অংশ পূর্ণিায়া জেলার কিছু অংশ বগুড়া জেলার অংশ বিশেষ আসামের গোয়ালপাড়া ও নেপালের ঝাঁপা জেলা
(৮) সিলেটি বাংলা - সিলেট, কাছাড়, করিমগঞ্জ, কুমিল্লা জেলা ও খাসিয়া-জয়ন্তিয়া পাহাড়ের সমতল অংশ
(৯) ঢাকাই বাংলা বা বিক্রমপুরী বাংলা - ঢাকা জেলা গোপালগঞ্জ মহকুমা বাদে ফািদপুর জেলা ও পাবনা জেলার পূর্বাংশ
(১০) যশোর বাংশ - যশোর জেলা খুলনা জেলা ও ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমা
(১১) বরিশাল বা চন্দ্রদ্বীপী বাংলা - বরিশাল জেলাখুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমা ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর মহকুমা ও পটুয়াখালি জেলা
(১২) চট্টল বাংলা - দক্ষিণাংশ বাদে সমগ্র চট্টগ্রাম জেলা ও নোয়াখালি জেলার কিছু অংশ এই ভাষায় অনেকগুলি উপভাষা আছে
---এই যে বারটি উপভাষা ও উপ-উপভাষা নিয়ে বৃহত্তর বাংলাভাষা তার কোথাও কামতাপুরী বা রাজবংশী ভাষা বলে কিছু নেই৷ এটা মধ্য যুগে উত্তর বাংলার রাণী ফুলটুসী বর্মনের দেওয়া প্রজাবৎসল উপাধি৷ তিনি ভূটান রাজাকে পরাস্ত করে যুদ্ধজয়ের কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পদাধিকারী কৈবর্ত বাঙালীদের রাজার বংশজাত বা রাজবংশী বলে সম্মানিত করেছিলেন৷ এই ইতিহাস ভুলে, বাংলা উপভাষার ইতিহাসের অজ্ঞতার কারণে যারা বাঙালী জাতি ও বাংলা ভাষার অঙ্গচ্ছেদনে তৎপর তাদের আর যাই বলি দেশহিতৈষী বলা যায় না৷
বর্তমান সরকার বাংলার সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে আত্মঘাতী পথে হাঁটতে শুরু করেছেন, তার রাশ টেনে ধরতে না পারলে বাংলা ও বাঙালীর সমূহ সর্বনাশ ঘটবে বাংলা ভাষার সৌধ নড়বড়ে হয়ে যাবে৷
গত ২১ শে ফেব্রুয়ারী যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হলো সমগ্র বিশ্ব জুড়ে, তার প্রাক্কালে বাংলা ভাষা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এহেন ঘোষণা আত্মঘাতী ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে৷
বাংলা ভাষা ও বাঙালী জাতির স্বার্থে বলছি বাংলা, বাঙালী, বাঙালিস্তান ও বাংলভাষা সম্পর্কে নোতুন চিন্তা ও বিস্তারিত তথ্য সবার নাও জানা থাকতে পারে৷ কিন্তু একুশ শতকের প্রগতিশীল চিন্তার মানুষদের জন্য প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার সার্বিক দিশা ও দর্শন দিয়ে গেছেন৷ তিনি বাঙালী জাতি ও বাংলা ভাষার বিস্তারিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর সেই গ্রন্থ অনুসন্ধিৎসুদের পাঠ করতে অনুরোধ জানাই৷ এ ব্যাপারে প্রাউটিষ্টদের সহায়তা নিন মনে রাখবেন সরকারী ক্ষমতা ব্যবহার করে কোনো প্রকার হঠকারী বা বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তাতে দেশ, জাতি ও ভাষার সমূহ ক্ষতি হয়ে যাবে৷ তাই আত্মঘাতী পথে হাঁটবার আগে আরও একবার ভাবুন৷
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মোতাবেক মোটা পুরস্কারের আশায় নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীরা হয়তো লিপিহীন, স্বতন্ত্র ভাষার বৈশিষ্ট্যহীন এক উপভাষাকে (বাংলা ভাষার) অলাদা ভাষার নামে যুক্তি দাঁড় করাবেন৷ কিন্তু তাতে করে মূল বাংলা ভাষার কী পরিমাণ ক্ষতি হবে তা কি একবারও ভেবে দেখেছেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী মশাইরা৷
- Log in to post comments