রাজনৈতিক ধান্দাবাজদের জন্যই দেশের এই করুণ অবস্থা

লেখক
প্রভাত খাঁ

পরিবর্তনশীল জগতের ধর্মই হচ্ছে থেমে না থেকে এগিয়ে চলা৷ এই যে চলা এটাকেই জগৎ বলে৷ তাই গত ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট যে পরিস্থিতি যে আনন্দ উৎসব দেখেছিলুম সেই আনন্দ উৎসব আজ কিন্তু চোখে পড়ে না৷ কেন এমন হ’ল তার খোঁজ করাটা অতি জরুরী৷ তাই এই প্রতিবেদন৷ সেদিন আমাদের মত আজকের বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা ছিল একেবারে কিশোর ও কিশোরী৷ মনে পড়ে সারা রাত ধরে কাগজের শিকলি তৈরী করে বড়দের সঙ্গে পরদিন সকাল বেলায় সারা পাড়াকে সাজিয়েছিলুম৷ পতাকা উত্তোলন করার পর পতাকা নিয়ে কয়েক মাইল ধূলো মাখা পায়ে হেঁটেছিলুম৷ শেষে মিষ্টান্ন পেয়ে খুশী হয়ে দুপুরে বাড়ী ফিরি বড়দের সঙ্গে৷ ইংরেজ চলে গেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাতে মনে কতটা যে আনন্দ তা প্রকাশ করাই যায় না৷ কিন্তু দীর্ঘ ৭১ বছরের যে অভিজ্ঞতা এটা মোটেই আনন্দের নয়৷ আমরা অতি নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে ছিলুম৷ আমাদের তো কোনও আর্থিক সামাজিক উন্নতি হয়নি৷ সেদিন যা ছিল তা প্রায় সবকিছুই হারিয়ে বসেছে৷ দরিদ্র চাষীর ঘরে জন্ম৷ জমি জমা যা ছিল চরম দুর্ভিক্ষ ও বিশ্বযুদ্ধের করাল গ্রাস সবই শেষ হয়৷ অতি কষ্ট করে একটু লেখাপড়া শিখি৷ তাই গ্রামে শিক্ষকতা করে কাল কাটাই৷ সেদিন শিক্ষকগণের বেতন বলতে কিছুই ছিল না৷ আজকের মত নয়৷ অতি কষ্টে জীবন-যাপন করে গেছি৷ সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলে যুক্ত ছিলুম না৷ তাই কোনও সুযোগ-সুবিধার প্রশ্ণ ওঠে না৷ সেদিন জনগণের মধ্যে প্রচার ছিল যে দেশে কংগ্রেস নাকি স্বাধীনতা এনেছে৷ প্রথম দিকে দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে আজকের মত এত মারামারি ঝগড়া ছিল না৷ রাজনৈতিক নেতাদের সমাজে একটা বিশেষ মর্যাদা ছিল নেতাদের কথাবার্তা পোষাক ও আচার-আচরণে একটা বিশেষ নম্র ও মধুর ভাব প্রকাশ পেত যা দেখলেই একটা শ্রদ্ধা মনের মধ্যে জাগ্রত হ’ত৷ আজ কিন্তু সেটা উঠে গেছে৷ সেদিন সাধারণ নির্বাচনটা ছিল একটা গুরুগম্ভীর পরিবেশে অনুষ্ঠিত একটা অতি পবিত্র অনুষ্ঠান৷

যতদিন যেতে লাগল এই নির্বাচন হয়ে উঠল ভয়ঙ্কর, হিংসাশ্রয়ী এক রক্তাক্ত জঘন্য কাণ্ড৷ দেখা গেল এমন কোনও নির্বাচন হ’ল না, যেখানে নিরীহ মানুষদের ক্ষতি হয় নি৷ ছল-বল-কৌশলে রাজনৈতিক দলের সক্রিয় ক্যাডাররা কোন না কোন ইচ্ছাকৃত অপরাধ করে বসছে৷ দলের একটাই লক্ষ্য জিততে হবে সেটা যে কোন ভাবেই হোক৷ তাই তো দেখা যায় নেতাদের বিশেষ করে শাসক দলের হুমকী, আগামী নির্বাচনকে বিরোধী শূন্য করে ছাড়বে৷ নির্বাচনের প্রাক্কালে বোমা, লাঠিসোটা, পিস্তল, বন্দুক অনেক স্থান থেকে পুলিশ সার্চ করে বের করে৷ আগে সাধারণ নির্বাচনে বিশেষ করে এম এল এ ও এম পি নির্বাচনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলি জোর দিত বেশী৷ কিন্তু স্কুল-কলেজের নির্বাচনে, পৌরসভা পঞ্চায়েত নির্বাচনে, বর্তমানের মত রাজনৈতিক দলের তেমন আগ্রাসী মানসিকতা ছিল না৷

সেগুলিতে স্থানীয় ভোটারগণ আঞ্চলিক ক্ষেত্রে যোগ্য সমাজসেবা মানুষদের নির্বাচিত করতেন৷ সেখানে ততটা হিংসার মানসিকতা প্রকাশ পেত না৷ দলীয় রাজনীতির ততটা বহিঃপ্রকাশ ঘটত না৷ এই পশ্চিমবঙ্গে এই সব ক্ষেত্রে অন্ধ দলীয় রাজনীতির আমদানি করে বামফ্রণ্ট৷ আগে নাগরিক সমিতি এই নির্বাচন চালাত৷ প্রথম কংগ্রেসী একচ্ছত্র অধিকার সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করে কংগ্রেসের আগ্রাসী নীতি মানুষকে নানাভাবে বঞ্চিত করায় বিরোধী দলের প্রভাব বাড়ে৷ তাতে করে ধীরে ধীরে এই রাজ্যে তথা সারা ভারতে কংগ্রেস বিরোধিতার জাগরণ হয়৷ তাতে করে সারা ভারতে দল ভাঙাভাঙি হয়ে বহু আঞ্চলিক দলের জন্ম হয়৷ কংগ্রেসই ভেঙ্গে বহু দল হয় দক্ষিণ ভারত ও উত্তর ভারতের হিন্দী আগ্রাসী নীতিকে কোনওদিনই মেনে নেয়নি৷ তাই দক্ষিণী আঞ্চলিক দলগুলি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে৷  এই দলে ধীরে ধীরে ধনী পরিবারের লোকেদের, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের রাজনীতিতে অংশ নিতে দেখা যায়৷

ঠিক তেমনই উত্তর ভারতের কয়েকটি পরিবার রাজনীতিকেই আশ্রয় করে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন নামে দলের নিয়ন্ত্রক হয়ে রাজত্ব কায়েম করে৷ কংগ্রেসকে ভাঙ্গে খোদ জওহরলাল৷ তারপর তাঁর কন্যা ইন্দিরা কংগ্রেস দলকে দুর্বল করে তোলেন৷ ইন্দিরা কংগ্রেসই কংগ্রেসকে গ্রাস করে৷ ঠিক তেমনই জনতা দল ভেঙ্গে অনেক আঞ্চলিক দল হয়৷ জনতা দল দুর্বল হয়ে পড়ে৷ হিন্দী বলয়ে বিজেপি প্রবল হয়৷ আর ইন্দিরা কংগ্রেস অস্তিত্ব রক্ষা করছে বর্তমান রাহুলকে দিয়ে৷

কেন্দ্রে মিলিঝুলি সরকার চালিয়ে গেল কংগ্রেস৷ শেষে বিজেপিকে কেন্দ্রে এনেছে৷ অনেক আঞ্চলিক দল মাথা চাড়া দিয়েছে৷ সেগুলিও ধীরে ধীরে ব্যষ্টিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কোম্পানী হয়ে উঠেছে৷ তাদের লক্ষ্য হ’ল নিছক গদী৷ তারা জনগণকে নানা প্রলোভনে ভুলিয়ে রাখার নানান ফন্দি করে চলেছে৷ দেশ বর্তমানে চরম আর্থিক কেলেঙ্কারীতে, চরম বেকার সমস্যায় ও চরম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে জর্জরিত৷ রাজনৈতিক দলগুলি বর্তমানে আদর্শহীন হয়ে পড়েছে৷ কিছু রাজনৈতিক নেতা দল ভেঙ্গে অন্য দলে যোগ দিয়ে নোংরা দল ভাঙাভাঙিতে উঠে-পড়ে লেগেছে৷ টিকিট না পেলেই দল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দিচ্ছে ব্যষ্টিস্বার্থসিদ্ধিতে৷ তাই আজকের দলীয় গণতন্ত্র হয়ে উঠেছে জনগণের চোখে এক মারাত্মক বিভীষিকা৷ মানুষ হারিয়ে ফেলছে বিশ্বাস ও আস্থা৷ এর জন্যে আজ তরুণ সৎ, নীতিবাদী, আদর্শবানদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশকে রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে৷ তা না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার৷