শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি বিশেষ করে যাঁর শাসনে আসেন তাঁদের মাথা ব্যথার অন্ত নেই, যদিও দীর্ঘ দিনের দাবী শিক্ষাকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রাখতে হবে৷ একথা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলার শ্রদ্ধেয় আশুতোষ মুখোপাধ্যায় দৃঢ় মানসিকতার সঙ্গে দাবী তুলেছিলেন ও আজীবন সেই আদর্শ অনুসরণ করে গেছেন ৷ ইংরেজ সরকারের সঙ্গে তাঁর এ ব্যাপারে তীব্র বিরোধিতা হতো৷ তিনি, শিক্ষাকে সরকারী হস্তক্ষেপ থেকে চিরদিন পৃথক রাখতে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন৷ পরবর্তীকালেও শিক্ষার ক্ষেত্রকে যাতে শাসকগণ সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীনে না আনতে পারে সে ব্যাপারে বহু আন্দোলন হয় ৷
ভারতবর্ষ দ্বিখন্ডিত হয়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়ার পর অর্র্থৎ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষার উন্নয়নে বহু কমিশন বসান৷ সেই অনুসারে শিক্ষাক্ষেত্রে বহু পরিবর্তন ঘটে৷ তবে শিক্ষা যেহেতু যৌথভাবে রাজ্যসরকারেরও অধীন তাই শিক্ষা নিয়ে রাজ্যে যখন যে সরকার আসে শিক্ষাকে তাদের মতো করেই পরিবর্ত্তন করে থাকে৷
পূর্বে বিদ্যালয়গুলিতে পাঠ্য পুস্তক বছরে বছরে পরিবর্ত্তন করা হতো না৷ বহু বছর একই বই পড়ানো হতো৷ কিন্তু স্বাধীনতার পর দেখা গেল যে সব রাজ্যে শাসনে আসতে লাগলো তারাই তাদের মতো করে পাঠ্য পুস্তক পাঠ্য তালিকায় অনুপ্রবেশ করাতে থাকে৷ ফলে পাঠ্য তালিকায় ব্যাপক পরিবর্ত্তন আসে৷ ধীরে ধীরে রাজ্য সরকার প্রধান প্রধান পাঠ্য পুস্তকগুলি ছাত্র-ছাত্রাদের বিনা পয়সায় যোগান দিতে থাকে৷ আগে নানা কারণে ছেলে-মেয়েরা সুকল ত্যাগ করতো৷ তাই সুকলে প্রাথমিক স্তর থেকে এমনকি মাধ্যমিক স্তর পর্য্যন্ত মধ্যাহ্ণ আহারের ব্যবস্থা করতে সুকলে ‘‘ড্রগ-আউট’’ বন্ধ হয়েছে কিন্তু এ ব্যাপারে বহু সুকলে অব্যবস্থা থেকে গেছে৷ মেয়েদের শিক্ষার হার বেড়েছে বর্ত্তমানে৷ তবে প্রকৃত শিক্ষার অভাবে শ্রেণীকক্ষে পড়াশুনার দারুণ দুরবস্থার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে৷ অধিকাংশ ক্লাশ প্রায় হয় না৷ যে হারে সরকার বেতন দিচ্ছেন সেই হারে কিন্তু শিক্ষার্থীগণ সার্থক শিক্ষা লাভ করতে সক্ষম হচ্ছে না যদিও পরীক্ষায় লেটার মার্কস -এর ছড়াছড়ি৷ প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার মান এ রাজ্যে নীচে নেমে গেছে৷ কর্মসংস্থানের দারুণ অভাব হওয়াতে শিক্ষার আকর্ষণ কমছে৷ ছাত্র-ছাত্রাদের সনের আচরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমনই দুর্বিনীত হয়ে পড়ছে যা সভ্যতাকেও লজ্জা দিচ্ছে৷ শিক্ষা জগতে যেন সংযমের দারুণ অভাব দেখা দিয়েছে৷ পূর্বের সেই বিনয় ও শ্রদ্ধা যেন সরস্বতীর মন্দির থেকে বিতাড়িত ! এটা বড়ই দুর্র্ভগ্যের বিষয়৷ বিদ্যা বিনয়ং দদাতি৷’’ একথা যেন অতীত হয়ে গেছে৷ ‘‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে’’৷ এই মহান আদর্শের কথা আজ যেন শিক্ষক-শিক্ষিকাও ছাত্র ছাত্রাদের মধ্যে নেই৷ যেন এক অন্ধকারাচ্ছন্ন--- অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দেশ এগোচ্ছে!
অত্যন্ত দুঃখের কথা দেশের ভবিষ্যৎ এই ছাত্রছাত্রাগণকে যেন কোন এক অদৃশ্য শক্তি ধবংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে এ সম্বন্ধে সারাদেশের নাগরিক ও শিক্ষিতব্যষ্টিগণকে গভীরভাবে ভাবতে হবে যাতে দেশের তরুণ সমাজ বিপথগামিতার হাত থেকে রক্ষা পায়৷ এসবের কারণ কিন্তু কারোরই অজানা নয়৷ গড্ডালিকা প্রবাহে দেশকে এগোতে দিলে চলবে না৷ প্রাথমিক সুকল আছে , আছে মাধ্যমিক, আছে উচ্চমাধ্যমিক সুকল৷ কিন্তু সেইসব সুকলে পড়াশুনা করাবার জন্যে শিক্ষকগণের দারুণ অভাব৷ ক্লাসগুলি অধিকাংশ সুকলে ফাঁক যায়৷ ছাত্র ও ছাত্রাগণ তাই সুকলের প্রতি আকৃষ্ট হয় না৷ বর্ত্তমানে পঠন পাঠনে সরকার পবিবর্ত্তন এনেছে৷ এক একজন পড়ুয়ার জন্য ৪/৫ জন প্রাইভেট শিক্ষক ও শিক্ষিকা রাখতে হয়৷ প্রতি বিষয়ের জন্য সপ্তাহে শিক্ষক ও শিক্ষিকাগণ এক বা দুই দিন পাঠ দান করে৷ আর প্রতিক্ষেত্রে বেতন দিতে হয় অভিভাবকদের ২০০/৩০০/৪০০ টাকা করে৷ নিম্নমধ্যবিত্তদের এতে দারুণ আর্থিক সংকটে পড়তে হচ্ছে৷ বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থাটাই যেন এক অসহনীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ যদিও রাজ্য সরকার পড়ুয়াদের বাৎসরিক কিছু আর্থিক সাহায্য বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দিয়ে থাকে৷ পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার মান কিন্তু অনেক রাজ্যের পশ্চাতে পড়ে আছে৷ চাকুরী না পাওয়াতে শিক্ষা সম্বন্ধে তরুণ মনে দারুণ বিষাদের ছায়া নেমে আসছে ৷ শিক্ষার সাথে সাথে রুজি রোজগারের বাস্তবধর্মী শিক্ষা দান জরুরী৷
রাজনীতিতে এক দলের পর অন্য দল ক্ষমতায় এলে ক্ষমতাসীন দল শিক্ষা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালায় ও নিজেদের মতাদর্শ অনুসারে পরিবর্তন ঘটায় এতে প্রকৃত শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে৷
সুকলে হঠাৎ পরীক্ষাটাই তুলে দেওয়া হলো৷ পাশ ফেলের ব্যাপারে পড়াশুনা একেবারে ঝুলে পড়লো৷ আবার নানা নানা দিক থেকে পাশ ফেল প্রথা চালু করতে চাইছে৷ তবে প্রতিটি শিশু পড়ুয়া যাতে ন্যূনতম শিক্ষা পায় তার ব্যবস্থা থাকাটা জরুরী৷
আগে প্রতিটি সুকলে পরিদর্শক আসতেন৷ সেটা বর্ত্তমানে একেবারেই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে৷ সেটার যে প্রয়োজন নেই তা নয়৷ অভিভাবকগণের তো একটা দায় আছে৷ তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার উন্নতি সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া ও সুকলের উন্নয়ন সম্বন্ধে তাদের সচেতন হওয়া উচিত৷ মনে রাখতে হবে শিক্ষক, ছাত্র/ছাত্রা/অভিভাবক যদি যৌথভাবে শিক্ষার উন্নতিতে সচেষ্ট না হন তাহলে সার্থক শিক্ষা দান ও শিক্ষালাভ সম্ভবপর নয়৷