বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের ‘জাতীয়তাবাদ ও মানবতাবাদ’ সম্পর্কীয় চিন্তাধারাসহ বহু চিন্তা ধারা বিজেপির চালিকা শক্তি আর.এস. এস-এর সঙ্গে যুক্ত এক প্রতিষ্ঠান ‘শিক্ষা-সংসৃকতি উত্থান ন্যাস’-এর পছন্দ নয়৷ তাই পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘জাতীয়তাবাদ’ প্রবন্ধ সহ তাঁর বিখ্যাত কিছু কবিতাকেও বাদ দেওয়ার জন্যে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে এই সংস্থা৷ রবীন্দ্রনাথের রচিত ‘নৈবেদ্য’র বিখ্যাত ‘প্রার্থনা’ কবিতা ‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির’ কবিতাটিকে ও ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতাটিকে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়ারও সুপারিশ করেছে ওই সংস্থা৷
কী স্পর্র্ধ ! নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, ‘মহান মানবতাবাদী ‘বিশ্বকবি’ রূপে সর্বজন স্বীকৃত রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা ভুল! কেন ভুল?
রবীন্দ্রনাথ মানবতাকে উগ্র জাতীয়তাবাদের ঊধের্ব স্থান দিয়েছেন৷ এটা নাকি রবীন্দ্রনাথের মস্ত বড় ভুল! রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা ওঁদের পছন্দ নয়৷ আমরা ওদের প্রশ্ণ করি, জাতীয়তাবাদকে যদি সবের্র্বচ্চ আদর্শরূপে মানতে হয়, তাহলে হিটলার কী দোষ করেছিল? তিনিও তো তাঁর জাতীয়তাবাদ নীতিকে সর্বোচ্চ নীতি হিসেবে মেনেছিলেন ও গোটা পৃথিবীর ওপর জার্র্মন রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব আনতে সচেষ্ট হয়েছিলেন ৷ মানবতাবাদ তাঁর কাছে মূল্যহীন ছিল৷ বিজেপি, আর-এস-এস বা তাঁর সঙ্গে সংযুক্ত ওই ‘শিক্ষা সংসৃকতি উত্থান ন্যাস’ কি হিটলারের মত উগ্র জাতীয়তাবাদের নীতিকেই সবের্র্বচ্চনীতি বলে মানেন? ভুললে চলবে না, হিটলারের ত্রুটিপূর্ণ নীতির ফলেই দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধ ঘটেছিল৷ তারপরে এই উগ্র জাতীয়তাবাদের ভুল বুঝতে পেরে ‘রাষ্ট্র সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷
প্রাউট-প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারও পরিস্কার ভাষায় বলেছেন, প্রাদেশিকতাবাদ বা জাতীয়তাবাদ নয়, বিশ্বৈকতাবাদই সমাজের সর্র্বেচ্চ লক্ষ্য হওয়া উচিত৷ তিনি বলেছেন ‘আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠাই হওয়া উচিত আমাদের লক্ষ্য৷
বস্তুতঃ জাতীয়তাবাদকে চরম লক্ষ্য হিসেবে মানলে বিভিন্ন জাতির তথা রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘর্ষে, বিশেষ করে এই পারমাণবিক বোমার যুগে, বিশ্বসভ্যতার ধবংস অনিবার্য হয়ে পড়বে৷ তাই লক্ষ্য হবে বিশ্বৈকতাবাদ তথা ‘বিশ্বরাষ্ট্র’ গড়ে তোলা৷ তবে তা তো হঠাৎ করে সম্ভব নয়৷ তাছাড়া, বিশ্বৈকতাবাদ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক শর্তই হল--- কোনো রাষ্ট্র বা জাতি বা জনগোষ্ঠী যেন অন্য রাষ্ট্র বা জাতি বা জনগোষ্ঠীর ওপর শোষণ বা অবদমন বা অন্যায় না করে -- তা নিশ্চিত করা৷ এমনিভাবে পারস্পরিক শোষণ, অন্যায় জবরদস্তি বা অবদমন বন্ধ করে, বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার মধ্যদিয়ে সর্র্বত্মক উন্নয়নের পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদের অভিমুখে এগিয়ে চলতে হবে৷ তবেই সমস্ত জাতির, রাষ্ট্রের তথা জনগোষ্ঠীর যথার্থ কল্যাণ সাধিত হবে৷
আর, রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য’ কবিতাতে বিশ্ব পিতার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে, ‘আমাদের চিত্তকে ভয়শূন্য কর, শিরকে উচ্চ কর, কারুর সংকীর্ণ ভাবনা যেন বিশ্বকে খন্ড-বিখন্ড না করে তোলে, কোনরকম কুসংস্কার যাতে বিবেকের কন্ঠরুদ্ধ না করতে পারে...হে বিশ্বপিতা, ভারতকে সেই স্বর্গে প্রতিষ্ঠিত কর’৷ মহান্ কবি রবীন্দ্রনাথের এই উদার ভাবনা সংঘ পরিবারের পছন্দ নয় তা বুঝতেই পারা যাচ্ছে৷
রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার মত এমনি একটি বিশুদ্ধ হাস্যরসের কবিতাও যে কেন সংঘ পরিবারের পছন্দ নয়, তা বুঝে ওঠা দায়৷ এখানে হবু রাজা ও গোবুমন্ত্রীর যে নির্বুদ্ধিতার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে--- সেটাকে কি ওঁরা ওঁদের বিরুদ্ধেই বলে মনে করছেন? কিন্তু কেন? এটাও ভাবনার বিষয় বৈ কি!
এর আগে এঁদের কিছু নেতা রবীন্দ্রনাথের রচিত জাতীয় সংগীতের সমালোচনা করেছিলেন৷ বিশ্ববিধাতার উদ্যেশ্যে কবির প্রার্থনাকে ওঁরা মনে করেন ওটা নাকি ইংলন্ডেশ্বরীর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা ছিল৷ ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-চেতনা, রবীন্দ্রভাবনা ও রচনার সঙ্গে চরমভাবে যারা অজ্ঞ তাঁরাই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এই ধরণের ভাবনা ভাবতে পারে৷ বিশেষজ্ঞদের ধারণা--- কিছুদিন পরে ওরা এই জাতীয় সঙ্গীতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও উদ্যত হবে৷
প্রধানমন্ত্রী মোদীজী কিন্তু সব জেনেও না-জানার ভান করছেন, ওঁদের সহযোগী চ্যালা-চামুন্ডাদের নানান কর্মকান্ডে৷ যে সমস্ত কর্মকান্ডে সমস্ত দেশবাসী বিব্রতবোধ করছে--- দেশে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে---সে সবকিছুই জেনে না জানার ভান করছেন৷ এই চালাকি দেশবাসী বোঝে৷ তাঁর, যেন মনে থাকে, অতি চালাকির গলায় দড়ি৷ উগ্র সংকীর্ণতাবাদী বা সাম্রদায়িকতাবাদী কাজকর্মকে সচেতন দেশবাসী বেশিদিন মেনে নেবে না৷
- Log in to post comments