রিজার্ভ ব্যাঙ্কের  সাম্প্রতিক   রিপোর্ট বনাম মোদিজীর চমক

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

২০১৬ সনের ৮ই নভেম্বর সন্ধ্যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শ্রী নরেন্দ্রমোদী ঘোষণা করেন, ৮ই নভেম্বর ২০১৬ তারিখ রাত্রি ১২ টার পর  ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল অর্র্থৎ বাজার-দোকানে অচল হয়ে যাবে৷  দেশের নাগরিকগণ  ব্যাঙ্কে গিয়ে নিজ নিজ এ্যাকাউন্টে বাতিল নোট জমা দিতে পারবেন৷  এই নোট বাতিলের উদ্দেশ্য হিসাবে   ঘোষিত হলো-- ১) কালো টাকা উদ্ধার ২) জাল টাকা ধবংস ৩) সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ৷ পরবর্তীকালে  আরো  জানানো হল, যে এই নোট বাতিলের অন্যান্য উদ্দেশ্যগুলি হচ্ছে---দুর্নীতিরোধ,ক্যাশলেস ইকোনমি বা নগদহীন অর্থব্যবস্থা ও ডিজিটাইজেশন বা চেক,ডেভিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড মোবাইলের মাধ্যমে লেন দেন বৃদ্ধি অর্র্থৎ  নগদর্থের (নোট বা ধাতবমুদ্রা) পরিবর্তে প্লাস্টিক মানির সাহায্যে লেনদেনে উৎসাহ প্রদান ৷  অবশ্য কয়েকদিন পরেই এই ক্যাশলেশ ইকোনমির  অবাস্তবতা উপলদ্ধি করে সেটাকে লেশ ক্যাশ ইকোনমিতে পরিবর্তিত করা হল৷ সঙ্গে সঙ্গে রিজার্ভব্যাঙ্কের তরফে ঘোষণা করা হয় যে,  নূতন রূপে , রঙে ও ঢঙে ৫০০ ও ২০০০ টাকার নোট বাজারে ছাড়া হবে যেগুলো কিছুতেই জাল করা সম্ভব নয়৷  তারপর ৯ই নভেম্বর ২০১৬-র পরবর্তী ঘটনাক্রম আমরা, আপামর ভারতবাসী সকলেই জানি৷ প্রায় প্রতিদিনই ব্যাঙ্কে জমা দেওয়ার সময় সীমা, টাকার অঙ্ক ,এটিম থেকে টাকা তোলার অঙ্ক, কীকী কারণে কত টাকা তোলা যাবে বা জমা দেওয়া যাবে ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে এক এক রকম ফরমান জারি হতে লাগল৷  এই ফরমান বা নির্দেশিকার  ধাক্কায় সাধারণ মানুষ থেকে ব্যাঙ্ক- পোস্টফিসের কর্মচারী গণ সকলেই বেসামাল ও হয়রান৷ এটিএম ও ব্যাঙ্কগুলির সামনে লম্বা লম্বা লাইন মাসের পর মাস চলতে লাগল৷ যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ভোর থেকে অধিক রাত অব্দি সেই লাইনে দন্ডায়মান৷ শাতধিক মানুষের লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর সংবাদ ইতোমধ্যেই সংবাদে প্রকাশিত৷

প্রথমদিকে সাধারণ মানুষ এই কষ্টকে বরণ করে নিয়েছিলেন এই আশায় বুক বেঁধে যে তাঁদের কষ্টের পরিবর্তে দেশ অন্ততঃ দুর্নীতিমুক্ত, কালো টাকা ও জাল টাকার করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে উন্নতির শিখরে  উঠতে সক্ষম হবে৷ কিন্তু দিন যত এগিয়েছে ততই এই আশার ঔজ্জ্বল্য ক্রমশঃ ম্লান হয়েছে৷  মানুষের সৎভাবে উপার্জিত বা  কর্মজীবনের অবসরে প্রাপ্ত অর্থ ব্যাঙ্কে বা পোস্টফিসে থাকা সত্ত্বেও নগদর্থের অভাবে দৈনন্দিন ব্যয় , চিকিৎসা  ও অন্যান্য আপৎকালীন প্রয়োজন, বিবাহ ইত্যাদি সামাজিক দায় দায়িত্ব পালনের বেত্রে  তাদের চরম অসুবিধায় পড়তে হয়েছে৷  ছোট অঙ্কের নোট বা নগদের অভাবে ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্র বেচাকেনা করতে পারেননি---বাজারে আনাজ-পাতি শাক-সব্জি কেনার লোকের অভাব৷ কুটির শিল্প, ক্ষুদ্রশিল্পগুলিতে শ্রমিকদের মজুরী দেওয়ার অর্থ না থাকায় মালিকেরা ঝাঁপ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে৷ হাজার হাজার মানুষ হয়েছে কর্মহীন৷ শুধু তাই নয়, কলকারখানায় আইনশৃঙ্খলার অবনতিও ঘটেছে৷ ভিনরাজ্যে যারা রুজিরোজগারের জন্য গেছিলেন তারা কর্মহীন, অন্নহীন, কপর্দকহীন হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন৷ সবমিলিয়ে এক দুর্বিসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা৷ আর এগুলোর সঙ্গেই চলছিল সরকারী প্রচারযন্ত্রের নোট বন্দীর সমর্থনে ঢক্কানিনাদ যা পরিস্থিতিকে আরো সঙ্গীন করে দিচ্ছিল৷ ব্যাঙ্কগুলি থেকে বেশিরভাগ সময় ২০০০ টাকার নোট দেওয়ার ফলে সেগুলো ভাঙানো ছিল এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার৷ মানুষের হাতে টাকা থাকা সত্ত্বেও ক্রয়ক্ষমতা ছিল না৷ বড় অঙ্কের নোটের চলমানতা ভীষণভাবে হ্রাস পাওয়ার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি প্রায়ই ধবংস হতে বসেছিল৷ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও অর্থের চলমানতাই হচ্ছে অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি আর তা নষ্ট হলে অস্থির অর্থনৈতিক অবস্থা অনিবার্য৷

ভারতবর্ষের মতো বিশাল দেশ যেখানে ৭৫ শতাংশ দেশবাসী গ্রামে গঞ্জে বাস করেন,  ৭০ শতাংশ  মানুষ শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত---সেখানে চেক, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড মোবাইল ওয়ালেট ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাপক লেন দেনের চিন্তা ভাবনা দিবাস্বপ্ণেরই সামিল৷ নোট বাতিলের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ লক্ষ্য করে দেশ বিদেশের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহল আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন--- এর প্রভাবে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি যথেষ্ট ব্যাহত হবে ও বিভিন্নবেত্র বিশেষতঃ  কর্মসংস্থান যথেষ্ট প্রভাবিত হবে৷ রিজার্ভব্যাঙ্কের সাম্প্রতিকতম বার্ষিক রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে যে বাতিল হওয়া ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটে প্রায় ৯৯ শতাংশই ব্যাঙ্কে ফিরে এসেছে৷  সুতরাং কালো টাকা উদ্ধারের বিষয়টি মাঠেই মারা গেল৷ বস্তুত পবে কালো টাকা শুধু নোটে রাখা হয় না--- চতুর কালোটাকার মালিকেরা নানারকম ফন্দি ফিকিরের মাধ্যমে সোনা দানা, স্থাবর  অস্থাবর সম্পত্তি ও  অন্যান্যভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখেন যাতে সরকারের চোখে ধুলো দেওয়া যায়৷ সরকারের পবে ঘোষণা ছিল যে প্রায় তিন লক্ষ কোটি টাকা কালো ধন উদ্ধার হবে কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ‘‘পর্বতের মূষিক প্রসব’’ ছাড়া কিছুই নয়৷ বরং নোটবন্দীর ফলে সরকারের তহবিলে বিভিন্ন খাতে এসেছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা কিন্তু  নতুন নোট ছাপানো ইত্যাদিতে  খরচ হয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা ৷ দ্বিতীয়তঃ জাল নোটের কারবারীরা  বাজারে প্রচুর ২০০০ টাকার জাল নোট ছড়িয়ে ফেলেছে যার বৃহদংশ ইতোমধ্যে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে পৌঁছে গেছে৷ এছাড়া এই আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাসে জি.ডি.পি (মোট জাতীয় সম্পদ) বৃদ্ধির হার ৫.৭ শতাংশে নেমে এসেছে যা  গত বছরের এই সময় ছিল ৭.৯ শতাংশ  অর্র্থৎ জিডিপি বৃদ্ধির ২ শতাংশের বেশি কমে গেছে ও  অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে৷ অথচ সরকারের কর্র্তব্যষ্টিগণ  এই আশঙ্কাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন৷ শুধু তাই নয়, নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকেও  তাঁরা বিদ্রুপ করতে ছাড়েন নি৷  প্রকাশিত তথ্য অনুয়ায়ী এবছরে কর্মসংস্থানও গত ৭ বছরের তুলনায় সর্বনিম্ন---অপরপবে অসংঘটিত বেত্রে হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে  অনাহারে অর্র্ধহারে দিনাতিপাত করেছেন৷ তথ্যাভিজ্ঞ মহলের মতে এই নোটবন্দীর উদ্দেশ্য অর্থনৈতিকের থেকে রাজনৈতিক চমক দেওয়াটাই ছিল মুখ্য৷

বিশাল এদেশের গ্রামগঞ্জের মানুষ সংসার খরচ নির্র্বহ করার জন্য ও বিপদ-আপদ,     রোগ-দুঃখ, দুর্র্যেগ-দুর্বিপাকের  জন্য নগদ অর্থ সঞ্চয় করে রাখেন৷ মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া কেউই সিন্দুকে বা লেপ বালিশের তলায়  নোটের  বান্ডিল জমিয়ে রাখেন না৷ নোট বাতিলের ফলে সাধারণ মানুষের  অতিকষ্টে সঞ্চিত টাকাগুলি ব্যাঙ্কে জমা পড়ার কারণে ব্যাঙ্কগুলিতে নগদ অর্থ প্রচুর জমে যায়৷ ব্যাঙ্ককে এই বিপুল পরিমান অর্থের সুদ গুণতে হচ্ছে অথচ লগ্ণি করার সুযোগ বিশেষ নেই৷  তাই বাধ্য হয়ে ব্যাঙ্কের মেয়াদী জমায় ও সম্প্রতি সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সুদ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ স্বপ্ল সঞ্চয়, মেয়াদী জমা, সেভিংসে সুদ কমানোর ফলে বয়স্ক নাগরিকদের  অশেষ অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে৷ তাদের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমশঃ কমে চলেছে অথচ মোদিজীর আরেকটি চমক তড়িঘড়ি জি.এস.টি চালুর ঠেলায় জিনিসপত্র ও ঔষধ পত্রাদির মূল্য ঊর্দ্ধমুখী৷ এই দুই’য়ের জাঁতা কলে প্রবীণ নাগরিকগণের  প্রাণ ওষ্ঠাগত৷ অন্যদিকে দেশের বড় বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ীগণ জনগণের  কষ্টসঞ্চিত হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ না করে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন নতুবা  বিদেশে পালিয়ে গা ঢাকা দিচ্ছেন কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ সদর্থক পদবেপ নেওয়া হচ্ছেনা৷ 

মোদিজীর আরেক চমক ---স্বচ্ছ ভারত অভিযান৷ লোক দেখানো মন্ত্রী সান্ত্রী সেলিব্রেটিদের ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নেমে টিভি ক্যামেরার সামনে পোজ দেওয়া ছাড়া  কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না৷  স্বচ্ছ ভারতের নামে বাড়তি ট্যাক্স আদায় করে জনগণকে আরো বিপর্যস্ত করা হচ্ছে৷ স্বচ্ছতা নাগরিক  অধিকার ও দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে৷  প্রকৃত  অর্থে স্বচ্ছতা আনতে গেলে সর্বপ্রথম মন কে স্বচ্ছ করতে হবে৷ মনের হীনবৃত্তি ও স্বার্থবুদ্ধিকে দূর করে  আধ্যাত্মিক  নৈতিকতা সমৃদ্ধ শুভচেতনার প্রসারে মনকে শুদ্ধ ও পবিত্র করতে হবে৷ শুধুমাত্র চমক দেওয়ার জন্য কোটি কোটি টাকা নয় ছয় না করে সঠিক পরিকল্পনার দ্বারা কল্যাণধর্মী মানসিকতার সাহায্যে সর্র্বত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, নইলে ঝাড়ুর ধূলায় স্বচ্ছতার চশমা  ময়লায় ঢেকে যাবে৷

মোদিজীর আরেকটি চমক, ‘‘মন কি বাত’’ --- সরকারী প্রচার মাধ্যমে সরকারী ব্যয়ে  রবিবাসরীয় সুললিত ভাষণ বর্ষণ৷ এটি একতরফা প্রচারে বোকা (?) দেশবাসীর মগজ ধোলাইয়ের প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয় কারণ এই ব্যবস্থায় জনগণের বক্তব্য শোণার বা মতামত জানার কোন দায় নেই৷ জনগণের  ‘‘মন কি বাত’’ বুকে চেপে রেখে মোদিজীর ‘‘বাত’’ দিয়ে ভাতের যোগাড়  হবে না কি না তা অবশ্য জনগণই জানেন ৷

ভারতবর্ষের মানুষ গত নির্র্বচনে মোদিজীকে  নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা দিয়ে  সুযোগ দিয়েছেন দেশের উন্নতির জন্য , মানুষের দুঃখ দুর্দশা দূর করার জন্য , অশিক্ষা-কুশিক্ষা দূর করে সুশিক্ষা বিস্তারের জন্য, অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-কর্মসংস্থান ইত্যাদি নূ্যনতম প্রয়োজনের রসদ যোগানের জন্য--- রাজনীতির চাতুরীপূর্ণ  চমকের জন্য নয়৷  সুতরাং চকিতচমকের  বাহ্যাড়ম্বর ছেড়ে মানুষের সার্ির্বক কল্যাণে সুব্যবস্থা গ্রহণই  জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র ভারতবাসীর দাবী---নইলে কে জানে শেষ চমকটা দেশবাসীই দেবেন কি না! তাই সাধু সাবধান নইলে রাজপাট  হবে খান্ খান্৷