সামাজিক-অর্থনৈতিক  ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

বর্তমানে সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, দেখা দিয়েছে চরম বিপর্যয়৷ সামাজিক ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিদিনই নারী-নির্র্যতন শ্লীলতাহানি, বৃদ্ধ পিতা মাতার প্রতি তাদের পুত্রদের  অমানবিক আচরণ, এসব থেকে শুরু করে নানান্ অসামাজিক ক্রিয়াকলাপ  চলছে, যা আজকের সভ্য সমাজকে  লজ্জা দেয়৷ বিজ্ঞান প্রযুক্তির নব নব  আবিষ্কারের---যেমন কম্প্যুটর, মোবাইল  ইন্টারনেটের  এমন ধরণের  অপব্যবহার  চলছে  যে সমাজের শান্তি রক্ষকদের  চোখের ঘুম ছুটে গেছে৷

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একদিকে ধনী-দরিদ্রের মধ্যেকার  ব্যবধান, শোষণ চরমভাবে  বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ দুর্নীতি তো আজকের  সমাজে মহামারিরূপে  দেখা  দিয়েছে৷  দুর্নীতির ঘুণে ঝাঁঝরা  হয়ে গেছে সমাজের ঊধর্বস্তর থেকে নিম্নস্তর  পর্যন্ত৷

সমাজর  এই সমস্যার সমাধান কোথায়? সেটা আজকের দেশ-নেতারা খঁুজেই পাচ্ছেন না৷ সর্বত্র দাবী উঠছে প্রশাসনকে  কঠোর থেকে  কঠোরতর  হতে হবে৷ তাদের  আশা, প্রশাসন ঠিক হলেই সমস্যার সমাধান হবে৷ মহামারী যখন দেখা দেয়, তখন রোগ তো কাউকেই  ছাড়ে না৷ প্রশাসনের  মধ্যেও তো দুর্নীতির রোগ! ফলে রক্ষকই ভক্ষকে পরিণত৷ তাহলে রক্ষা করবে কে? মন্ত্রী থেকে  পুলিশ-কনষ্টেবল  পর্যন্ত ঘুষ নিচ্ছে৷ ঘুসের কাছে সবাই কাবু৷  তাহলে এ রোগের  ওষুধ কী?

সমাজ বলতে বোঝায়, সকলে মিলে পরস্পর পরস্পরকে সহায়তা করে’ এক সঙ্গে  চলা৷ কিন্তু এই যে পরস্পর পরস্পরকে সহায়তা করা---এর জন্যে যে স্বার্থত্যাগ করতে হয়, সেই স্বার্থত্যাগের প্রবণতাটা কোথায়? যতক্ষণ মানুষ নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ-ত্যাগ করে অপরের পাশে এসে না দাঁড়াবে, ততক্ষণ সুস্থ সমাজ গড়ে উঠবে না৷ এটাই  সমাজ চেতনা৷ এই সমাজ চেতনা এই  ঐক্য ভাবনা---এর  উৎস সন্ধান করতে হবে৷ নিঃসন্দেহে সব সমস্যার মূলে  রয়েছে মানুষের  নৈতিক অবক্ষয়, নৈতিক চেতনার অভাব৷

এই জিনিসটা বুঝতে হবে, মানুষ যত জড়বাদী হচ্ছে, ততই মানুষের  নীতিবোধ হ্রাস পাচ্ছে৷ প্রত্যেকের  নিজ নিজ মন আছে৷ আর প্রত্যেকের মনের  মধ্যে রয়েছে  সীমাহীন  বাসনা ৷ প্রত্যেকে তার নিজ নিজ বাসনার পরিতৃপ্তির জন্যে সদা তৎপর৷ জড় জগতে ভোগ্যবস্তু সীমিত৷ এই সীমিত ভোগ্যবস্তুর পেছনে সবাই  নিজ নিজ অসীম বাসনা নিয়ে ছুটে চলেছে৷ তাহলে তো পারস্পরিক  সংঘর্ষ দেখা দেবেই! এই সংঘর্ষে,  এই সীমাহীন প্রতিযোগিতায় যে জিতবে  সেই অধিকাংশ ভোগ্যবস্তুর  অধিকারী হবে৷ অপরে বঞ্চিত হবে৷ কেউ কেউ  প্রভূত সম্পদ সঞ্চয় করবে৷ তখন অন্যদিকে  অভাব দেখা দেবেই৷ তখন যারা অভাবগ্রস্ত  তাদের  সঙ্গে অন্যদের সংঘর্ষ ও  অশান্তি আরও বৃদ্ধি পাবে৷ এটাই  স্বাভাবিক৷

এক্ষেত্রে  প্রাউট-প্রবক্তা  তথা ধর্মগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, মানুষ তার মনের অভাব বা অনন্ত বাসনাকে  যদি কেবল জাগতিক ভোগ্যবস্তুর দিকে ছুটিয়ে দেয় তাহলে জাগতিক ভোগ্যবস্তু সীমিত হওয়ার  জন্যে মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ অবধারিত, কেউ প্রয়োজনাতিরিক্ত  সম্পদ অধিকার করে নেবে, আর কেউ বা বঞ্চিত  ও ক্ষুব্ধ হবে, এটা স্বাভাবিক৷ এক্ষেত্রে মানুষের  কাছে  একমাত্র রাস্তা হল, মানুষ  তার মনের ক্ষুধাকে অনন্ত আধ্যাত্মিক  সম্পদের  দিকে পরিচালিত করুক৷

আধ্যাত্মিক সম্পদ  অর্র্থৎ ব্রহ্ম অনন্ত৷  তাই এক্ষেত্রে কোনো সংঘর্ষ বাধবে না৷ সবাই তার মনকে  তৃপ্ত  করার সুযোগ  পাবে৷ অন্যদিকে  সবাই মিলে জাগতিক সম্পদের  সর্র্বধিক  উপযোগ ও যুক্তিসংগত বন্টন  করবে৷

তাছাড়া আধ্যাত্মিক  ভাবনা মনের  মধ্যে  শুভভাবনার  উন্মেষ  ঘটায়৷ হ্ম  সর্বসত্তায় বিরাজিত৷ তাই সর্র্বনুুসূ্যত  ব্রহ্মের  প্রতি ভালবাসা তাকে  বিশ্বের সবকিছুকে --- সমস্ত  সত্তাকে  ভালবাসতে শেখাবে৷ তাকে বিশ্বপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে৷ 

তাই নীতিবাদের  উৎস আধ্যাত্মিকতা৷ তবে এখানে  বলা প্রয়োজন এই আধ্যাত্মিক চেতনাই হ’ল প্রকৃত  ধর্মচেতনা৷ ধর্ম বলতে কতকগুলো যুক্তি বিবর্জিত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার নয়৷

প্রচলিত ধর্মমতের  বেশিরভাগটাই  এই অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে ভরা৷ এক অনাদি অনন্ত  ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের ভাবনা নিয়েই আধ্যাত্মিকতা শুরু৷ সেই অনন্ত হ্মের ভাবনা ধর্মের  সারকথা৷ তাই প্রকৃত  ধর্ম  বিশ্বৈকতাবাদের কথা বলে৷ প্রাউট-প্রবক্তার  ভাষায় এটাকে বলা হচ্ছে নব্যমানবতাবাদ, যাতে সমস্ত মানুষ, পশু-পক্ষী-তরুলতা সবার  প্রতি ভালবাসার  কথা বলা হচ্ছে৷ যা এই বিশ্বৈকতাবাদের বিরুদ্ধে গিয়ে জাত-পাত সম্প্রদায়ের  কথা  বলে তাা প্রকৃত ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা নয়৷ এগুলো স্রেফ অন্ধবিশ্বাসই৷ আধ্যাত্মিকতাতে কোন  জাত-পাত-সম্প্রদায়ের  বিভেদের স্থান নেই৷

আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক যোগ হল আধ্যাত্মিক  শিক্ষার  বৈবহারিক দিক৷  পৃথিবীর যে  কোনো  মানুষ এই  যোগাভ্যাসের  মাধ্যমে আধ্যাত্মিক  পথে  এগিয়ে  চলতে পারেন, আধ্যাত্মিক উন্নতি  ঘটাতে পারেন৷

মানুষ যতই আধ্যাত্মিকতার পথ ধরে  এগিয়ে যাবে ততই তার মধ্যে নীতিবোধ তথা সমাজ-চেতনার  বৃদ্ধি পাবে৷ আর এইভাবে চলতে চলতেই সে নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত  হতে পারবে৷ তখনই মানুষের  মন প্রকৃত  সমাজবাদী হয়ে উঠবে৷ তখন ব্যষ্টি-সমাজের  মধ্যে  স্বার্থের বিরোধ দেখা  দেবে না৷ বরং প্রকৃত ঐক্যবোধের  জাগরণে  মানুষ বুঝতে  পারবে, ব্যষ্টিগত ভাবে যে সমস্যার  সমাধান  সম্ভব নয় সমষ্টিগত প্রয়াসেই  সেই সমস্যার সমাধান সম্ভব৷

নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক তো পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত, একের সঙ্গে অন্যের  সম্পর্ক  অবিচ্ছেদ্য৷ যেখানে নীতি নেই, সেখানে  আধ্যাত্মিকতাও নেই৷ সেখানে  যা আছে  তা হ’ল  ধর্মের নামে  কিছু  অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার তথা ডগ্মা৷ আধ্যাত্মিকতার থেকে এইসব ডগমার  পার্থক্য বুঝতে  হবে৷ আধ্যাত্মিকতার  ক্ষেত্রে কোনো কৃত্রিম বিভেদের স্থান নেই,এমনকি তথাকথিত ধর্মগত ভেদেরও স্থান নেই৷ আধ্যাত্মিকতা মানবধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ আধ্যাত্মিকতা যুক্তি-বিজ্ঞান ও বাস্তব অনুভূতির ওপর আধারিত৷

ব্যাপক নৈতিক তথা আধ্যাত্মিক  শিক্ষার দ্বারাই সমাজে সৎ ও নীতিবাদী মানুষ গড়ে তোলা যায়৷  আর সমাজে  এই সৎ ও নীতিবাদী মানুষের প্রভাব যত বেশি হবে, ততই সমাজ কলুষমুক্ত হবে৷ সামাজিক  অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আজ যে ব্যাপক অবক্ষয় তথা বিপর্যয় দেখা দিয়েছে--- এই  সমস্যার  সমাধানের  জন্যে সমাজে  ব্যাপকভাবে নৈতিক তথা আধ্যাত্মিক শিক্ষার  প্রয়োজন৷ তার সঙ্গে অবশ্যই প্রশাসনিক কঠোরতাও  প্রয়োজন তাতে সন্দেহ নেই৷                প্রাউট প্রবক্তার ভাষায় এক্ষেত্রে External presser & internal urge’--- বাহ্যিক চাপ ও  ভেতরের প্রেরণা’--- দুইই বিশেষ জরুরী৷