রাজ্যের মাঝেরহাটের সেতুটি ভেঙ্গে পড়ার পর রাজ্য প্রশাসন রাজ্যের কুড়িটি বেহাল সেতু সম্বন্ধে নড়েচড়ে বসেছেন৷ পশ্চিমবাঙলার মধ্যে যে ছোট-বড় অসংখ্য সেতু আছে তার প্রতি সেতুর ব্যাপারে রাজ্য প্রশাসন কী সঠিক খোঁজখবর রাখার দিকে নজর দেন? নদী-মাতৃক বাঙলার ওপর দিয়ে পূর্ব ভারতে বর্ষার জল প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে৷ প্রতি নদ-নদী পলি পড়ে মজে গেছে৷ জলে জলমগ্ণ দক্ষিণ বাঙলা৷ জল হ’ল পীচ ও কংক্রীটের চরম শত্রু৷ পি ডব্লু ডি নাকি সারা বছরই সজাগ৷ অশ্বত্থ, বট নানা ধরণের আগাছা প্রায়ই জন্মায় সেতুর দেওয়ালে তাছাড়া অত্যন্ত দুঃখের ও লজ্জার কথা সেগুলি নির্মূল করার দিকে ঠিকমত নজর পড়ে না৷ সরকারের লোকজন আছে৷ কিন্তু যত দিন যাচ্ছে কাজের দিকে নজরটা কমেই যাচ্ছে৷ ইংরেজ আমলে যে সব নির্মাণ কাজ হয়েছে বহু বছর পরও দেখা যায় সেগুলি আজ অনেক ক্ষেত্রে প্রায় ঠিক আছে৷ কিন্তু ৫০-৬০-৪০ বছর আগে দেশ স্বাধীন হবার পর অনেক নির্মিত সেতু রাস্তাঘাট একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে নানান কারণে৷ এর যে কী কারণ সেটা অনেকেরই জ্ঞাত৷
যখন ক্ষতি হয়, ধবংস হয়, মানুষ মরে তখনই রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার হৈ হৈ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ সে সব বিরোধী দল আছে সংবাদপত্রে ও দূরদর্শনে তারাও নিজ নিজ মতদান করে দেখায় যে তারা কতটা সজাগ৷ এ সব আমরা দেখে আসছি স্বাধীনতার পর থেকে৷ ভোট ছাড়া এদেশের রাজনৈতিক নেতা ও নেত্রী কিছুই জানে না আর বোঝেও না৷ শিয়ালদহে যেটাকে বিদ্যাপতি সেতু বলা হয় তার অবস্থা শোচনীয়৷ সেতুর আশেপাশে দোকানদারগণ কারবার করে সংসার প্রতিপালন করছে৷ এরও জীবনী শক্তি হ্রাস পাচ্ছেপ্রতিদিন হাজার হাজার লরি ভারী বোঝা নিয়ে যাচ্ছে৷ আর লক্ষ লক্ষ যাত্রী যাতায়াত করে চলেছে দিনরাত এর ওপর দিয়ে৷ এর ওপর নজর দেওয়া জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজন৷ অভিযোগ স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলির মদতে সেতুর উপর গাড়ী চলাচল আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথে সেতুর তলদেশে দোকান খোলা হয়৷ এমনকি এক একটি দলের বিশেষ বিশেষ স্থানে নিজ নিজ এলাকা বলে চিহ্ণিত আছে৷ দোকানদারদের কাছ থেকে তোলাবাজী করে টাকা তোলা হয়৷ এটা সকলের জানা৷ ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক দলবাজীতেই দেশ পঙ্গু হয়ে পড়েছে৷ এ ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসন নীরব দর্শক হয়ে থাকে৷
উত্তরবঙ্গের ফাঁসিদেওয়ার সেতু ভেঙে পড়েছে মাঝামাঝি স্থানে৷ পিছলা নদীতে সেতু তৈরী হয় ২০০২ সালে৷ সেতুটির দৈর্ঘ্য ৭০ মিটার মাত্র৷ সেতু ভেঙ্গে পড়ায় চারটি গ্রামের মানুষ চরম অসুবিধায় পড়েছে৷ সংবাদে প্রকাশ সেতু নির্মানের জন্যে নাকি সাত লক্ষ টাকা মহকুমা পরিষদকে দেওয়া হয়৷ কিন্তু কাজ হয়নি৷ ফাঁসী দেওয়ার পাশে কান্তিভিটাতে একটি নির্মিয়মান ফ্লাইওভারের কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়েছে৷ সংবাদ আসছে যে শিলিগুড়ির অনেক সেতুই বিপজ্জনক৷ মহানন্দার সেতু নিয়েও মানুষ চিন্তিত৷
এদিকে বিপজ্জনক মঙ্গলকোটের লোচনদাম সেতু৷ এই সেতুর বয়স মাত্র ১৮ বছর৷ এটি পূর্ব বর্ধমান ও বীরভূম জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায়৷ এটি উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের সঙ্গে একটি সংযোগকারী সেতু৷ অত্যন্ত দুঃখের কথা এই সেতুর পিলারের ভরণস্থল প্রায় ৫০ থেকে ১০০ মিটার নদীর গর্ভে বসে গেছে৷ এই কারণে সেতুর একাংশ কিছুটা বেঁকে গেছে৷ এই সেতুর ওপর দিয়ে অজয় নদের বালির লরি যাতায়াত করে৷ সেতু পিলারের ১০০ মিটারে মধ্যে রমরমিয়ে চলছে বালি তোলা৷ রাতে জেনারেটর লাগিয়ে বালি লুট হচ্ছে৷ প্রভাবশালী ব্যষ্টিরা এতে যুক্ত৷ এই চোরাকারবার চালাচ্ছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতারা৷ তাই সেতুর ভবিষ্যৎ খুবই বিপজ্জনক৷
এদিকে বর্ধমানের কৃষক সেতু মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে তবে টনক নড়েছে প্রশাসনের৷ পূর্ব বর্ধমানের পালামপুর গ্রামের কাছে কৃষক সেতু৷ এই সেতুটি বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, হুগলী ও হাওড়াকে সংযোগ করে থাকে৷ ভারী যান চলাচলে কম্পন দেখা দেয়৷ বালি বোঝাই লরি বেশী চলে৷ সেতুর মাঝে ফাটল দেখা দিয়েছে৷ জোড়াতালি দিয়ে চলছে৷ সাধারণের মনে আতঙ্ক একটা লেগেই আছে৷
এদিকে মুর্শিদাবাদের জরাজীর্ণ সেতুগুলি মেরামতের দাবী তীব্র হচ্ছে৷ ভাগীরথী নদীর ওপর ৩৪ নং জাতীয় সড়কের ওপর রয়েছে রামেন্দ্রসুন্দর সেতুটি৷ উত্তর বাঙলার সঙ্গে দক্ষিণ বাঙলার যোগসূত্র এই সেতু৷ জনগণ দাবী তুলেছেন সংস্কারের৷ জেলাশাসক পিডব্লুডি মহকুমা শাসকদের কাছে তাদের এলাকার সেতুগুলির অবস্থা সম্বন্ধে ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন৷
এদিকে পশ্চিম মেদিনীপুরের দেশপ্রাণ বীরেন্দ্র শাসমল সেতু সংস্কারের অভাবে ধুঁকছে৷ কাঁসাই নদীর ওপর সেতু নষ্ট হওয়ার পর গত ১৯৭২ সালে তার পাশে নতুন সেতু তৈরী হয়৷ নাম হয় বীরেন্দ্র শাসমল সেতু৷ প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ী যাতায়াত করে ৬০ নং জাতীয় সড়কের ওপর সেতুটিতে৷ ভারী লরির চাপে সেতু কেঁপে ওঠে৷ যান চলাচলের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ভারী লরি মালবোঝাই অবস্থায় সেতুর ওপরে দাঁড়িয়ে থাকে৷ জেলাশাসক পি মোহন গান্ধী বলেন সেতুটির অবস্থা দেখে প্রয়োজননীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ বর্তমানে মাল বোঝাই লরির সংখ্যা অত্যধিক বেড়েছে৷ সেতুর ওপর দিয়ে ৯ টনের অধিক মাল বোঝাই করা লরি চলাচল বিপজ্জনক৷ এ ব্যাপারে প্রশাসনকে দৃষ্টি দিতে হবে৷ প্রতিটি সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ করতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে৷ যে পৌরসভা ও পঞ্চায়েতে সেতুটি অবস্থিত তাদের সজাগ থাকতে হবে ও জেলাশাসককে সংবাদ দিতে হবে৷
মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের আট চাকার বেশী যুক্ত ভারী লরি চলাচল নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দিয়েছেন৷ বেদনার কথা এই যে, আমাদের সবই ব্যবস্থা আছে কিন্তু সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের ও নাগরিক সচেতনতার কিছুটা অভাবেই জাতীয় সম্পদ নষ্ট হচ্ছে৷ আজ নানা দিক থেকে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে বাঙলার গৌরব কলকাতা নগরী৷ গত কয়েকটা বছরের মধ্যে সেতু ভেঙ্গে পড়ল৷ তাতে প্রাণহানি হ’ল৷ বেশ কিছু জাতীয় সম্পদ নষ্ট হ’ল৷ বাঙলার বুকে এমনধারা হাজার হাজার সেতু আছে৷ যাদের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না৷ নদ-নদীগুলির সঠিক সংস্কার হয়না৷ বালি তোলা হয় না৷ বালি তোলা হয় বে-অইনীভাবে নদনদী থেকে৷ সংস্কারের অভাবে নদী গর্ভদেশে চরা পড়ে গেছে৷ সেতুগুলি নানা কারণে দুর্বল হয়ে পড়ছে৷ যেগুলি যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম৷ ভারী ভারী লরিগুলি মালবোঝাই করে সেতুর ওপর দিয়ে নিয়ে যায়৷ রক্ষকরা সবই দেখেশুণে নানা কারণে নীরব থাকে৷ এটা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়৷ কারণ জাতীয় সম্পদ দেশের তাই শাসকবর্গকে আরও সজাগ হতে হবে৷
মনে রাখতে হবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদেরও দায়িত্ব আছে৷ সজাগ থাকাটা তাই সবার দায়িত্ব৷ দেশের স্বার্থে সকলকে জাগ্রত হয়ে জাতীয় সম্পদ রক্ষা করতে হবে৷ শুধু নিজেদের স্বার্থের কথা ভাবলে চলবে না৷ নদনদীর বালি তোলাটা প্রয়োজন৷ কিন্তু সেতু যেখানে আছে তার বহুদূর থেকে বালি তোলা দরকার৷ সেতু দাঁড়িয়ে আছে পিলারের ওপর৷ তার আশপাশ অবশ্যই রক্ষা করতে হবে৷ সেটা অনেক ক্ষেত্রে হয় না৷ এটা অনেকেরই জানা৷ তাছাড়া লরির বোঝা যেন ইচ্ছাকৃতভাবে বেশী করে বাড়ানো না হয়৷ তাতে সেতুর ক্ষতি হয় যা জাতীয় সম্পদের পক্ষে ক্ষতিকারক৷ বেশী লাভের আশায় এই সব অগণতান্ত্রিক কাজ মোটেই কাম্য নয়৷ প্রশাসনকে এ ব্যপারে অবশ্যই কঠোর হতেই হবে৷
মোদ্দা কথা হ’ল যাদের ওপর দায়িত্ব থাকে তাদের অবশ্যই দায়িত্বশীল হতেই হবে৷ কাজের ফাঁকিটা অপরাধ, তাই তো এত অঘটন ও ক্ষয়ক্ষতি৷
- Log in to post comments