প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই পৃথিবীর বুকে নেমে আসে স্নিগ্দ শরৎ৷ নির্মল সুনীল আকাশে শাদা মেঘের ছোপ, বাতাসে শিউলি, কেতকীর সৌরভ মানুষের মনে জাগায় খুশীর হিন্দোল৷ বঙ্গে শরৎ ঋতুর আগমন মানেই শারদোৎসবের প্রস্তুতি৷ পাড়ায় পাড়ায় সুদৃশ্য প্যাণ্ডেলে রংবাহারি কারুকার্যের বৈচিত্র্যে দক্ষ শিল্পীর নিপুণ শিল্পকর্মের নিদর্শন ফুটে ওঠে৷ দিন যত এগিয়ে আসে সকলের ব্যস্ততা ততই তুঙ্গে উঠতে থাকে৷ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মাতৃবন্দনা ও শক্তি আরাধনার আনন্দযজ্ঞে সামিল হয়৷ ঢাকের বাদ্যি, আলোর রোশনাই, ধূপের গন্ধ ও বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণে সকলের মনে খুশীর প্লাবন বয়ে চলে৷ নূতন জামাকাপড়ে সুসজ্জিত মানুষজন শারদোৎসবের দিনগুলিতে দৈনন্দিন দুঃখ-বেদনাকে ভুলে আনন্দে মেতে থাকে৷ সকলেই বিনম্র শ্রদ্ধায় মহাশক্তির চরণে ব্যষ্টিগত ও সামগ্রিকভাবে সমাজের মঙ্গলকামনায় প্রার্থনা জানায়৷ প্রত্যেকেরই আন্তরিক কামনায় ব্যক্ত হয় অশুভ শক্তির বিনাশে শুভশক্তির বিজয়বার্তা৷
বস্তুতঃ শারদোৎসবের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে দশভূজা দশপ্রহরণধারিণী মহাশক্তির প্রচণ্ড প্রহারে দুর্বৃত্ত অসুরের নিধন আর সেই শক্তিসম্পাতেই সর্ববিধ অশুভ ও অমঙ্গলের করাল ছায়া থেকে সকল মানুষকে রক্ষা করার ঐকান্তিক প্রার্থনা৷ পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে কাল্পনিক দেবী ও অসুরের মূর্ত্তি গড়ে মহা আড়ম্বরে স্তব-স্তুতি অর্চনা করলেও যে অসুরগুলির দ্বারা ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগত জীবনে সর্বনাশ সংঘটিত হয়ে চলেছে, তার প্রতি আমরা প্রকৃতপক্ষে দৃষ্টিপাত করছি না৷ বাস্তবে সর্বাপেক্ষা শক্তিধর অসুরগুলি লুকিয়ে রয়েছে মানুষের মনের মধ্যে আর তাদের পার্শ্বচর- অনুচরগণ যথা অশিক্ষা-কুশিক্ষার অসুর, শোষণ অন্যায়ের অসুর, দুর্নীতি, দূষণ, ভেজাল, ভাবজড়তা ও কুসংস্কারের অসুর, দারিদ্র্যের অসুর---সমাজজীবনে চরম বিভীষিকার সৃষ্টি করে চলেছে৷ মানুষের সীমাহীন লোভ সমগ্র পৃথিবীর সব পার্থিব খনিজ, বনজ, জলজ সম্পদকে কুক্ষিগত করতে চায়, আর তার জন্যে যে কোনও রকম অন্যায় বা দুর্নীতির আশ্রয় নিতে সে প্রস্তুত৷ লোভ-লালসা, কামনা-বাসনার পরিপূর্ত্তির জন্যে মানুষ যেন-তেন প্রকারে সম্পদের পাহাড় গড়তে থাকে৷ লাভের অঙ্ক বাড়াতে গিয়ে একসঙ্গে বহু মানুষকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিতেও দ্বিধা করে না৷ ফলে সমাজে নানাবিধ শোষণ, দুর্নীিত্রত ও হিংসার বিস্তার ঘটে৷ একশ্রেণীর মানুষ লোভের বশবর্তী হয়ে অঢেল সম্পদ করায়ত্ত করার চেষ্টায় ব্যাপৃত থাকার ফলে সমাজের বৃহৎ অংশ বঞ্চিত হতে বাধ্য হয় ও ক্রমাগত শোষণের শিকার হয়ে পড়ে৷ অশিক্ষা-কুশিক্ষার ফলে বৃহত্তর সমাজে চলতে থাকে ভাবজড়তা ও কুসংস্কারের দাপট৷ এর সুযোগ নেয় সমাজের মুষ্টিমেয় চতুর মানুষ৷ আধুনিকতার নামে চলে বেলেল্লাপনা ও অশ্লীল ক্রিয়াকর্ম৷ পরিকল্পনাবিহীন নগরায়নের ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের নির্বিচারে ধবংসলীলা ও বনজঙ্গল কেটে মানুষের বাসস্থানের সংস্থান করতে গিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে চলেছে৷ বায়ুমণ্ডলে কার্বণ যৌগের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে উষ্ণায়ন বেড়ে চলেছে৷ বিশ্বের বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা দীর্ঘকাল যাবৎ বিশ্ব উষ্ণায়নের বিষয়ে সতর্ক করছিলেন৷ গত ৮ই অক্টোবর ২০১৮, রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ইণ্টার গভর্ণমেণ্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ’ বা আই.পি.সি.সি. এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমগ্র পৃথিবী আজ বিপর্যয়ের সম্মুখীন৷ ভারতের অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর৷ দিল্লীর তাপমাত্রা গড়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে আর কলকাতার বেড়েছে ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ বিজ্ঞানীদের অভিমত অনুযায়ী এই গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশী হলে মহাপ্রলয় ঘটে যেতে পারে৷ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পৃথিবীর সামনে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা৷ এর সঙ্গে রয়েছে জলদূষণ, শব্দদূষণ, ভেজাল খাদ্য, পানীয় ও অতি প্রয়োজীনয় দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী, এমনকি ঔষধ পত্রাদি পর্যন্ত৷ ভেজালমুক্ত জিনিস পাওয়া বর্তমানে রীতিমত ভাগ্যের ব্যাপার৷ এমতাবস্থায় মানুষের মনের ভেতরের এই অসুরগুলির (লোভ, লালসা, হিংসা, দুর্নীতি ইত্যাদি) নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে পৃথিবী নামক গ্রহটি হয়ত একদিন নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাবে৷
শারদোৎসবের দিনগুলিতে একদিকে উৎসবের আনন্দে যেমন মানুষ মেতে থাকে, অপরদিকে সবার অলক্ষ্যে সর্বনাশের বিষবৃক্ষও বাড়তে থাকে৷ এই সময় মাইক, ডিজে, ঢাক-ঢোলসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র ও নানাবিধ বাজি পটকার প্রবল শব্দনিক্ষেপ বহু মানুষের ক্ষতির কারণ হয়৷ শিশুদের স্থায়ী শ্রবণ সমস্যা ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা দেখা দেয়৷ আর বয়স্কদের হৃদরোগে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে এই শব্দদৈত্যের তাণ্ডবে৷ দ্বিতীয়তঃ কোটি কোটি টাকার বাজি পুড়িয়ে একদিকে যেমন অর্থের অপচয় হয়, অপরদিকে তেমনি বায়ুমণ্ডলে দূষণের পরিমাণ এতটাই বেড়ে যায় যে, মানুষের সহনশীলতার মাত্রাকে অতিক্রম করে এক মর্মান্তিক অবস্থার সৃষ্টি করে৷ এছাড়া প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রার সময় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বিশৃঙ্খলা ও ভক্তগণের কুরুচিকর নৃত্য ও অঙ্গভঙ্গি, মাদকের প্রভাবে অনেকের টলমল অবস্থা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু মনে হয়৷ এই সময় উশৃঙ্খল ভক্তদের নিয়ন্ত্রণ করাটাই একটা দুরূহ ব্যাপার৷
শারদোৎসব উদ্যাপনের জন্যে সারা দেশে যে হাজার হাজার সুদৃশ্য-সুশোভিত প্যাণ্ডেল, বিদ্যুতের বহুল ব্যবহার, সাজসজ্জায় বিপুল অর্থব্যয় করা হয় --- তার বৃহদংশই কোনও স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে না৷ ফলে বহু অর্থের অপচয় ঘটে৷ এই বিশাল অর্থের কিয়দংশ যদি সুপরিকল্পিতভাবে জনগণের কল্যাণে স্থায়ী সম্পদ নির্মাণে ব্যবহৃত হয় তবে সাধারণ মানুষের উপকারে লাগে আর আনন্দের পরিমাণ ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায়৷ এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে যদি ব্যয়িত বিশাল অর্থের এক-তৃতীয়াংশ পূজা-উৎসব ও অপর দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষাবিস্তার, চিকিৎসাক্ষেত্র ও স্থায়ী কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ব্যয় করা হয় তবে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, রোগ ব্যাধি ও অনাহার দারিদ্র্যরূপী অসুরগুলির বিরুদ্ধে মানুষ জয়ী হতে পারে৷ এই বিষয়ে পূজা উদ্যোক্তাগণ, প্রশাসন ও সচেতন নাগরিকগণ এগিয়ে এলে সমাজের প্রভূত উন্নতি সাধন সম্ভব৷ উৎসবকে কেন্দ্র করে ব্যয় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অর্থের অপচয় বন্ধ হওয়া একান্ত আবশ্যক৷
জীবন মানেই সংগ্রাম৷ জীব, উদ্ভিদ, মানুষ সকলকেই জন্মের পরমুহূর্ত্ত থেকেই নিরন্তর সংগ্রাম করে চলতে হয়৷ মানুষ বিবেকপ্রধান জীব হওয়ায় শুভ-অশুভের বিচার করে শুভের পথেই অগ্রসর হয়৷ তবে শুভের পথে, ধর্মের পথে, সত্য ও ন্যায়ের পথে প্রতি পদে বাধার সম্মুখীন হতেই হয় আর এই বাধা অতিক্রম করার শক্তি তাকে আধ্যাত্মিকতার পথে চলেই অর্জন করতে হয়৷ মানুষের অন্তরেও চলেছে সর্বদায় শুভ-অশুভের লড়াই৷ সত্য-ধর্ম ও প্রকৃত আধ্যাত্মিকতাই তাকে সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যোগায় ও জয়যুক্ত করে৷ আবার এই আধ্যাত্মিকতার সাহায্যেই সে ন্যায় নৈতিকতার পথে চলার শক্তি অর্জন করে ও সমাজের দুর্নীতি, শোষণ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে পারে৷ সাময়িকভাবে অশুভ শক্তির আধিক্য ও প্রাবল্য পরিলক্ষিত হলেও শেষ বিচারে শুভ শক্তিরই জয় সূচিত হয়৷ তাই প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার পথের অনুসারী হয়ে শুভশক্তির উদ্বোধনের দ্বারা সমাজের সকলকে নিয়ে এক সুন্দর শোষণহীন আনন্দময় সমাজ গড়ে তুলতে পারলেই শরদোৎসবের নির্মল আনন্দ সকলে একসঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করতে পারবে আর তখনই শারদোৎসবের মহিমার পরিপূর্ণ প্রকাশ সম্ভব হবে৷
- Log in to post comments