স্বাধীনতার ৭০ বছর পর ভারতে বাঙালীরা বিদেশী কেন

লেখক
কেশব মজুমদার

বাঙলা ও বাঙালীরা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তৎকালীন নেতৃবৃন্দের তথা নেহেরু-প্যাটেল দুষ্টচক্রের বিশ্বাসঘাতকতার বলি৷ শুধু বাঙলা নয়, এই বিশ্বাসঘাতকদের কারসাজিতে বলি প্রদত্ত হয়েছে পঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তরপূর্ব সীমান্ত প্রদেশ ও বালুচিস্তান৷ এই সীমান্তপ্রদেশ ও বেলুচিস্তান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হওয়ায় সেখানকার কংগ্রেসীরা কোনমতে এই বেইমানিকে সামাল দিতে পেরেছেন৷ অঘোষিত লোক বিনিময়ের ফলে পাঞ্জাবীদের পূর্ব পঞ্জাব ও দিল্লীতে পুনর্বাসনে ও রাষ্ট্রীয় মূলধারায় মিশে যেতে তেমন বেগ পেতে হয়নি৷ কিন্তু শেষ হয়ে গেছেন সিন্ধ্রির অধিবাসীরা তাদের রাজ্য বা প্রদেশ বলে আজ আর কিছুই নেই যারা এপারে এসেছেন, (শতকরা প্রায় ৯৮ জনই চলে এসেছেন) তারা বর্তমানে ছড়িয়ে আছে মহারাষ্ট্র, ক্তজরাট, রাজস্থান ও দিল্লীতে ও তারা নিজ নিজ এলাকায় আজ গ্রহণীয় হয়ে গেছেন৷ তাদের বিদেশী বা অনুপ্রবেশকারী বলে আজ কেউ গালাগাল দেয় না৷ তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ায় না, এটা আমার অভিজ্ঞতা৷
কিন্তু এ পারে আসা বাঙালীদের অবস্থা দেশভাগ তথা স্বাধীনতার ৭০ বছর পরে এসে দেখছি সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাঙালীরা আজ বিদেশী অনুপ্রবেশকারী রূপে চিহ্ণিত৷ দেখা যাচ্ছে অবিরাম ও অবাধ ঘৃণা, হিংসা, বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী৷ আজ যারা ভূমিপুত্রের দাবী তুলে চক্রান্ত করে বাঙালীদের জন্মভূমি---শস্যশ্যামল বঙ্গভূমি বিদেশীর হাতে তুলে বাঙালীর স্বার্থত্যাগ, সর্বস্ব ত্যাগের বিনিময়ে গদীতে আসীন হয়েছেন তারা কিন্তু একবারও এগিয়ে এসে বলছেন না, বাঙালীরা স্বাধীনতার বলি, ভারতের যে কোনও রাজ্যে যে কোনও অঞ্চলে বসবাস করার, স্থায়ী বাসস্থান গড়ার তাদের আইনগত অধিকার রয়েছে৷ তারা বিদেশী নয়, অনুপ্রবেশকারী নয়, তাদের পুনর্বাসনে ও সুখ-স্বাস্থ্য বিধানে আমরা তথা ভারত সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷ বরং ১৯৭১ সালের একটা বে-আইনি আইনের ধুয়া তুলে বাঙালীদের বিদেশী আখ্যা দিয়ে বিতাড়নের চেষ্টা চালাচ্ছে সেই কুচক্রী বিশ্বাসঘাতকরা৷ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়ের সময়কালে অরুণাচলে চাকমা-হাজংদের বিদেশী বলে তাড়ানোর চক্রান্ত করা হয়েছিল, সেই ব্যাপারে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাদের স্থায়ী পুনর্বাসন দেওয়া হয় যার ফলে অরুণাচল প্রদেশে কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়৷
স্বাধীনতার অনেক পরে আমার জন্ম৷ যা বলার জন্যে বা লেখার জন্যে কলম ধরছি সম্পূর্ণ ইতিহাসের পাতা থেকে৷ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মূল আদর্শ ছিল অখণ্ড ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা৷ লাহোর কংগ্রেসের (১৯২৯) পরে তা আরও দৃঢ়মূল হয়৷ ব্রিটিশ ভারতে অর্থাৎ পরাধীন ভারতে যতক্তলো নির্বাচনে কংগ্রেস প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে তা সবকটিই নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি ছিল অখণ্ড ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা৷
পরাধীন ভারতের শেষ নির্বাচনেও---যা ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়, কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহারে ছিল অখণ্ড ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা৷ এই অখণ্ড ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করে এক বছর পরে যারা ভারত-খণ্ডন সমর্থন করলেন ও অতঃপর খণ্ডিত ভারতের তখ্ৎ তাউসের অধিষ্ঠিত হলেন---তারা কি ভারতবাসীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেননি? সুদীর্ঘ কাল ধরে লালিত-পালিত-ঘোষিত জাতীয় কংগ্রেসের মূল নীতি থেকে কি তারা বিচ্যুত হননি? আদর্শচ্যুত বা নীতিভ্রষ্ট ছাড়া তাদের আর কি বলা যেতে পারে৷ তাদের তো আবার জনগণের দুয়ারে আসা উচিত ছিল ও এসে বলা উচিত ছিল, ভারত খণ্ড করা ছাড়া স্বাধীনতা আসবে না৷ আপনারা রায় দিন, মতামত দিন এর ভিত্তিতে আবার নির্বাচন বা গণভোট হওয়া উচিত ছিল৷ হয়েছে কি হয়নি? অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার প্রতিজ্ঞা করে নির্বাচনে জিতে যারা ক্ষমতায় গেল, তারা ভোটারদের তথা জনগণকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে বিক্রি করে ফেলল৷ কত বড় বেইমানি! কত বড় জালিয়াতি!
খণ্ডিত ভারতের স্বাধীনতার জন্যেই কংগ্রেস লড়াই করেছে আর বাঙলা, পঞ্জাব, সিন্ধু সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানকে বিসর্জন দিয়ে হায়নার মুখে ঠেলে দিয়ে কংগ্রেস দেশের স্বাধীনতা চেয়েছে---একথা পূর্বাহ্ণে জানলে কি অন্ততঃ বাঙালী-পাঞ্জাবী-বালুচি জনগোষ্ঠী স্বর্বস্ব পণ করে এই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ত না? বাঙালী, পাঞ্জাবী, সিন্ধ্রিরা শয়ে শয়ে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলত৷ হাজারে হাজারে কারাবরণ করত৷ লাখে লাখে পুলিশের লাঠি ও বুলেটের আঘাতে হাত-পা, বুকের পাঁজরা ভেঙ্গে মৃত্যুর দিন ক্তণত৷ এই পরিণতি জানা থাকলে তারা তাদের নিজস্ব পথ বেছে নিতে পারত৷ কিন্তু দুষ্ট বেইমানেরা ছল-চাতুরী করে তাদের তা বুঝতে দেয়নি৷ সারাক্ষণ তাদের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার লালিপপ৷ আর একেবারে শেষ মুহূর্তে অত্যন্ত দ্রুততা ও শঠতায় তারা তাদের কার্য হাসিল করে নিয়েছে৷ এদেশভাগ বে-আইনী এই স্বাধীনতা বে-আইনী কারণ যারা দেশ ভাগ করে স্বাধীনতা নিয়েছে তারা তার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিল না, তারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিল একমাত্র অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতায়৷ তাই ছিল তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও একেবারে শেষ মূহূর্ত্তেও৷
এবার বলতে হচ্ছে অতীতে ভারতের বড়লাট মাউণ্ট ব্যাটেনের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ভারত ভাগে সম্মতি দিয়েছে৷ তখন গান্ধীজীর সম্মতি আদায় করার জন্যে গান্ধীজীকে বোঝানো হল ভারত ভাগের সম্মতি না দিলে আমরা সারা জীবন স্বাধীনতা সংগ্রাম করে যাব৷ কিন্তু স্বাধীনতা আমরা দেখে যাব না৷ তখন গান্ধীজী ছিলেন নিরুত্তর এই নীরবতা গান্ধীর সম্মতি ছাড়া আর কিই বা হতে পারে কথায় বলে মৌনং সম্মতি লক্ষণম্৷ নেহেরু তারপর লর্ড মাউণ্ট ব্যাটেনকে দেশ ভাগের প্রতি জনগণের পাক্কা সমর্থনের কথা জানিয়ে দিলেন৷
আর দীর্ঘ আলোচনা না করে আমার মূল দাবীতে আসছি৷বাঙালী বহিরাগত, বিদেশী, অনুপ্রবেশকারী, শোষক এদের তাড়িয়ে দাও, বহিষ্কার কর এ-সব শুণতে শুণতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে৷ আর ভাল লাগে না, এর একটা সুরাহা দরকার---যাতে সকলেই উপকৃত হবে৷
ভারত সরকার অন্যায় ভাবে দেশ ভাগ করে বাঙালীদের চরম বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন ও বাঙালীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের জন্মভূমি বিদেশীদের হাতে তুলে দিয়ে তাদের ভিটে-মাটি ছাড়া করেছেন৷ ভারত সরকার বাঙালীদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি খেলাপ করেছেন৷ ভারত সরকারের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি, সংখ্যালঘুরা ওপার বাঙলা থেকে এপারে মানে ভারত ভূখণ্ডে চলে আসতে বাধ্য হলে তাদের সাদরে গ্রহণ করা হবে৷ তাই এখন আমাদের দাবী, উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলক্তলো নিয়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক শোষণমুক্ত অঞ্চল বাঙালীস্তান গঠন করা হউক৷ সব জনগোষ্ঠীই সেই স্থানে বসবাস করতে পারবে, যা এখন করা হচ্ছে না৷ এখানে কাউকে তাড়াবার প্রশ্ণই ওঠে না৷
বর্তমানে যেভাবে বাঙালীদের ওপর নির্যাতন চলছে সেখানে ভারত সরকার মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে তামাসা দেখলে তা হবে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ৷ দীর্ঘদিন বাঙালীদের এই ভাবে আঘাত করলে একসময় আঘাতের প্রত্যাঘাত আসবেই৷ আর যদি প্রত্যাঘাত না পেতে চান তাহলে আঘাত বন্ধ করতে হবে৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন---বাঙালী অদৃষ্ট কর্তৃক অপমানিত হবে, কিন্তু মার খেয়েও মারের ওপর মাথা তুলবে৷

Comments

nabinjana

Tue, 11/04/2017 - 23:17

খুব সুন্দর লেখা। বিশ্বাসঘাতকরা বাঙ্গালীর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল লুটে পুটে খাচ্ছে, আর বাঙালিরা হয়েগেছে বিদেশি।