আজ ১২ই জানুয়ারী সারা দেশব্যাপী স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৫তম জন্ম বার্ষিকী উৎসব পালন করা হচ্ছে৷ স্বামীজীর প্রতিকৃতিকে ফুল–মালা দিয়ে সাজিয়ে তাঁর সামনে গুরু–গম্ভীর বত্তৃণতা, নাচ, গান প্রভৃতি হচ্ছে৷ কিন্তু উৎসব শেষে আবার সবাই যথারীতি স্বামীজীকে ভুলে যাবেন বা ভুলে থাকবেন৷ এভাবেই তো বর্তমানে মহাপুরুষদের জন্মোৎসব প্রভৃতি পালিত হয়৷
এই প্রসঙ্গেই কবি যতীন সেনগুপ্তের একটি কবিতা রয়েছে, যেখানে এইভাবে রবীন্দ্রোৎসব পালনের বিলাসিতার কথা বলা হয়েছে৷ কবি বলেছেন – ‘ঘরের দেওয়ালে টাঙ্গানো কবির ছবিখানি/ পঁচিশে বোশেখে বাইশে শ্রাবণে টানাটানি ..........’’৷ কবির ছবিকে দেওয়াল থেকে পেড়ে ফুল, ধূপ, দীপ, চন্দন দিয়ে সাজিয়ে আমরা উৎসব করি৷ উৎসব শেষে – ‘‘দেওয়ালের ছবি ফিরে সে দেওয়ালে / মোরা খাই দাই আপন খেয়ালে / শুক্নো ফুলের মালা খুলে নিতে যাই ভুলে৷’’
এইভাবেই তো সমস্ত মহাপুরুষদের স্মরণোৎসব পালন করে আমরা দায় সারি৷ এর বেশি যে আমাদের কোনো কর্তব্য আছে, তা আমরা কজনই বা উপলব্ধি করি? স্বামী বিবেকানন্দের জন্মোৎসব পালনের ক্ষেত্রেও প্রতি বছর এটাই হয়৷ কিন্তু আমরা কি গভীর ভাবে তাঁর আদর্শের – তাঁর বাণীর তাৎপর্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি৷ বোধহয় করিনি৷ আর করিনি বলেই তাঁর আদর্শের যে মূল কথা ঃ ঈশ্বরকে জীবনের চরম লক্ষ্য করে চলতে হবে, তার সঙ্গে সঙ্গে সর্ব জীবের মধ্যে ঈশ্বরের প্রকাশ – এই সত্য উপলব্ধি করে জগতের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে হবে – তবেই জীবনের সার্থকতা – স্বামীজীর বাণীর এই সারকথা মেনে চলার আন্তরিক প্রয়াস কজনের রয়েছে? স্বামীজী পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার উদ্দেশ্যে বলেছেন যে, পাশ্চাত্ত্যেরভোগবাদী সভ্যতা একটা জীবন্ত আগ্ণেয়গিরির ওপর দাঁড়িয়ে আছে৷ যে কোনো মুহূর্তে এর চরম বিপর্যয় দেখা দেবে৷ তাই স্বামীজীর সাবধান বাণী, পাশ্চাত্ত্য সভ্যতা যেন ভারতের আধ্যাত্মিকতার কাছে নতজানু হয়ে দীক্ষিত হয়৷ পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার বাঁচার দ্বিতীয় পথ নেই৷
আমরা ভারতবাসীরা কি স্বামীজীর এই বাণীর তাৎপর্য বিন্দুমাত্র উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি? করিনি৷ বরং আমরা ভারতীয়রা সর্বতোভাবে আজ পাশ্চাত্ত্যের ভোগবাদী সভ্যতাকে অনুকরণ করার প্রাণান্তকর প্রয়াস চালাচ্ছি৷ তার পরিণতি যে কত মারাত্মক তা এখনও আমরা বুঝতে চেষ্টা করছি না৷
ভোগবাদ আত্মসুখতত্ত্বের নামান্তর৷ এক্ষেত্রে মানুষ কেবল নিজের সুখ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে লালায়িত৷ মুখে সমাজের স্বার্থের কথা বললেও বা সামাজিক সেন্টিমেন্টের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানুষ অনেক সময়ে অনেক সংযম বা ত্যাগ স্বীকার করলেও, তা স্থায়ী হয় না৷ শেষ পর্যন্ত আত্মসুখটাই তার কাছে বড় হয়ে যায়৷ অন্যের জন্যে ত্যাগ স্বীকার করার ভাব স্থায়ী ভাবে থাকে না৷ অপরপক্ষে অধ্যাত্মভাব বা ব্রাহ্মীভাব মানুষের মনে এই ভাবকে জাগরুক রাখে যে আমার মধ্যে যে ব্রহ্ম বা আত্মা রয়েছে, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সেই আত্মাই বিরাজিত৷ তখন মানুষ নিজের সুখ–দুঃখকে সবার সুখ–দুঃখের সঙ্গে মিলিয়ে সবার সঙ্গে একাত্ম হতে পারে৷ একেই বলে সমসমাজতত্ত্ব ও আরও ব্যাপকার্থে নব্যমানবতাবাদ অর্থাৎ সমস্ত মানুষ, প্রাণীজগৎ ও উদ্ভিদ জগৎ সবার সঙ্গে একাত্মতা৷ বসুধৈব কুটুম্বক্ম্ – এই ভাব অধঃপতিত নিপীড়িত মানবতার একমাত্র আশ্রয়৷ পাশ্চাত্ত্য শিক্ষায় যুক্তি–বিজ্ঞানের প্রাধান্য আছে, কিন্তু অভাব আছে আধ্যাত্মিক শিক্ষার৷
পাশ্চাত্ত্যের বিজ্ঞানকে আমরা দোষ দিচ্ছি না৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী চেয়েছেন পাশ্চাত্ত্যের বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতার সুষম সমন্বয়৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালী মনীষীগণ–রাজা রামমোহন রায় থেকে স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজী সুভাষচন্দ্রের চিন্তাধারার মধ্যে এটাই তো মূলগত বৈশিষ্ট্য৷ আমরা মুখে ওই সমস্ত মনীষীদের বন্দনাগান গাইছি কিন্তু কার্যতঃ পাশ্চাত্ত্যের ভোগবাদ তথা জড়বাদের পেছনেই তীব্র বেগে ছুটে চলেছি৷ আর তার মধ্যে যেটুকু ধর্মপ্রীতির ছোঁয়া রেখেছি, সেই ধর্ম আবার প্রকৃত ধর্ম নয়, ধর্মের নামে কিছু কু–সংস্কার ও সম্প্রদায়ভিত্তিক বাহ্যিক আচার–নুষ্ঠানের প্রতি ‘প্রীতি’ – যার পেছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজ করছে বিশেষ কোনো স্বার্থ সিদ্ধির অভীপ্সা৷
এ সব বাদ দিয়ে স্বামীজীর তথা ওই সব মহামনীষীদের জীবনাদর্শের সারকথা আন্তরিকভাবে মেনে চলতে হবে৷ দেশবাসীকে এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে হবে৷ না হলে দেশের – সমাজের প্রকৃত সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়৷