এগার বছরের ছেলেটি৷ র্যাভেনশ কলেজিয়েট সুক্লের ছাত্র৷ ভারি সুন্দর দেখতে৷ টানা টানা চোখ৷ একমাথা কালো চুল৷ পুষ্টল গোলগাল মিষ্টি মুখখানা৷ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ভালবাসতে ইচ্ছে করে৷ কিন্তু যে বয়সের যা তার ভীষণ ব্যতিক্রম এই ছেলেটির স্বভাবে৷ কোথায় সারাদিন খেলা–ধুলো নিয়ে মেতে থাকবে তা’ নয় – লাজুক ও গম্ভীর প্রকৃতির ছেলেটি – সকলের সঙ্গ এড়িয়ে – একাকী বসে বসে কী সব ভাবতেই যেন ভালাবাসে৷ ভাসা ভাসা চোখের প্রসারিত দৃষ্টি মেলে সে যখন বসে থাকে – দেখে মনে হয় – সে কিছুই যেন দেখছে না, শুধু ভাবছে আর ভাবছে আবার কখনো মনে হয় কী যেন খুঁজছে অথবা ঢুকতে চাইছে কোনো গভীরতর ভাবনার অন্তরঙ্গ প্রদেশে৷
ডাক্তারবাবুরা বলেছেন, চোখ দুটো খারাপ৷
রাত্তিরে পড়াশুনো করা চলবে না৷ তাই রোজ সকালে আড়াই ঘন্টা একমনে পড়েই তাকে একদিনের পড়া সাঙ্গ করতে হয়৷ পড়ার শেষে দুঃখী ভিখিরিদেরকে নিজের হাতে ভিক্ষে দিয়ে তারপর সুক্লে যাওয়া তার রোজ দিনের অভ্যাস৷ কোনোদিন তার ব্যত্যয় ঘটলে সারাদিন মনটা খচ্খচ্ করে৷ ভাল লাগে না৷
সুক্ল থেকে এসে কিছু খেয়েই বেড়াতে বেরোনো চাই৷ সঙ্গে ২/১ জন মনোমত সঙ্গী৷ বেড়ানোটা কিন্তু শহরের রাস্তা ঘাটে বা পার্কে নয়, বাড়ী ঘর ও জনকোলাহল ছাড়িয়ে নদীর ধারে৷ নির্জন নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে কখনো তারা চলে যায় শ্মশান–ঘাটে৷ মাঝে মাঝে সেখানেই ছেলেটি পদ্মাসনে বসে ধ্যান সুরু করে৷ সঙ্গী হারুচন্দ্র গাঙ্গুলী অথবা জগন্নাথ চউধুরী অবাক হয়ে তা’ দেখে৷ পরিচিত বন্ধুটিও যেন হঠাৎ তাদের চোখে অপরিচিত ও রহস্যময় হয়ে ওঠে – তাকে যেন কিছুতেই তারা সম্যক বুঝে উঠতে পারে না৷
ছেলেটির বয়স যখন চৌদ্দ – তখন তার এই প্রকৃতিবাদী নির্জনতা–প্রেমী মনটাকে হঠাৎ আর্তপ্রেমী হয়ে ওঠার জ্বলন্ত প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে তুললেন তার মা৷ সে একটি ছোট্ট ঘটনা৷ কিন্তু বৈবহারিক তাৎপর্যের মূল্যায়নে তা মোটেই ছোট্ট নয়৷
র্যাভেনশ কলেজের মেসে তথাকথিত নীচু জাতের ছেলে মঙ্গল মাঝি কঠিন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত৷ আবাসিক ছাত্র কেউ তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করছে না৷ সেবা ও শুশ্রূষার অভাবে বেচারা মরতে বসেছে৷ দিনের পর দিন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে৷ খবরটা একদিন পঁৌছে গেলো কটকের ওড়িয়া বাজারের মুসলমান প্রধান অঞ্চলে – সরকারী উকিল ও পাবলিক প্রসিকিউটারের বিরাট বড় বাড়ীটির অন্দর মহলে৷ শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে বাড়ীর গৃহিণী একখানা লালপাড় শাড়ী পরে বেরিয়ে পড়লেন৷ সোজা এসে ঢুকলেন মেসে৷ বসলেন গিয়ে রুগ্ণ ছেলেটির শিয়রে৷ পরম যত্নে তার চোখ মুখ মুছে দিলেন ও মাথাটি নিজের কোলের ওপর তুলে নিলেন সস্নেহে৷ মেসের ছেলেরা অবাক হয়ে সব দেখলো৷ নিজেদের হূদয়হীন ব্যবহারের জন্যে একটা অপরাধ–বোধ তাদের মর্মে মর্মে দংশন করে গেলো৷ লজ্জায় ছোট হয়ে গেলো তাদের মুখ৷
ঘরের বাইরে তখন লজ্জাহত ছেলেদের ভিড়৷ এমন সময় ভিড় ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলো সেই ছেলেটি৷ সেবার ভার নিজের হাতে গ্রহণ করে সে অনুতপ্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললো – তুমি বাড়ী যাও মা৷ এরকম ভুল আমাদের আর কখনো হবে না৷
না, ভুল তার আর সত্যি কখনো হয়নি৷
সেই ছেলেটিই আজকের নেতাজী সুভাষ৷ দেশে ও বিদেশে বহু দেশ–নায়ককেই আমরা দেখেছি ও দেখছি৷ কিন্তু যে বৈশিষ্ট্য নেতাজীকে অন্য সবার থেকে একক স্বাতন্ত্র্য দান করেছে তা হ’ল তার অবিরাম আদর্শ মগ্ণতা৷ যে যতবড় নেতাই হোন্ – সবারই একটা ব্যষ্টিগত জীবন আছে – যার ওপর ভর করে যে যার সাধ্যমতো ভাবাদর্র্শময় সমষ্টিকে জীবন–সাগরে অবগাহন করে গেছেন বা যাচ্ছেন৷ কিন্তু নেতাজী ব্যষ্টি–জীবনের ভূমির ওপর থেকে পায়ের আঙ্গুলের ডগার স্পর্শটুকুও তুলে নিয়ে নিজেকে ওতঃপ্রোতভাবে সামিল করে দিয়েছেন সমষ্টি–জীবনের গতি–প্রবাহে৷ সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁর জীবনের ভিন্নতর কোনো রূপ–রেখা অঙ্কন করা সম্ভব নয়৷ এটাই নেতাজীর ব্যষ্টিত্বকে তুলনাহীন ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর করে তুলেছে৷
নেতা দর্শনের গতি–প্রকৃতি অনুধাবন করতে হলে প্রথমেই একটা কথা ভেবে নেওয়া দরকার তা হলো – নেতাজী একজন দর্শনানুরাগী ও দর্শন–বেত্তা পুরুষ, কোনো নতুন দর্শনের তিনি স্রষ্টা নন৷ তিনি অতি অল্প বয়সেই বিশ্বের প্রায় সম্যক দর্শন চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন৷ স্বীয় ভাবাদর্শময় কর্ম জীবনের অবিরাম গতিময়তাকে দর্শনানুগ পথে পরিচালিত করেছেন প্রতিনিয়ত৷ তার ফলে তাঁর দর্শন চিন্তার গতি প্রবাহে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে এক বিবর্তনের ধারাবাহিকতা৷ নেতাজীর গতিময় জীবনে তাই কখনো কোনো বিশ্বাসকেই স্থবিরতা পেয়ে গোঁড়ামির সৃষ্টি করতে দেখি না৷ তাঁর দর্শন চিন্তার এই স্বাভাবিক ও সুস্থ পরিবর্তনশীলতাকে সমসাময়িক বন্ধুরা অনেকেই সঠিকভাবে মূল্যায়িত করতে পারেননি৷ তাদেরকে বোঝাতে গিয়ে নেতাজী প্রায়ই হাসতে হাসতে Emerson– সেই উক্তিটি উদ্ধৃত করতেন ‘‘There is nothing wrong in this – for, a foolish consistency is the hobgoblin of little minds. Moreover what is progress if it does not involve change?’’ (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments